“মিয়ানমারের কূটচাল, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের তৎপরতা, বাংলাদেশের কূটনৈতিক ব্যর্থতাসহ নানা কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হয়েছে।”

রোহিঙ্গাদের দুঃখ শোনে না পৃথিবী

fec-image

নিজ দেশে ফিরতে কে না চায়? শিকড়ের টান তো সব মানুষই অনুভব করে। তাহলে যাদের জমিজিরাত সবই ছিল, তারা কেন নিজের ভিটেমাটিতে ফিরতে চায় না? বিশেষ করে অন্য কোনো দেশেও যখন নেই কোনো ঠিকানা, নেই এমনকি কাজ করার অধিকার? তাহলে কী কারণে মাটির টানেও সীমানা পাড়ি দিতে পারেন না তারা? ভিটেমাটি ছেড়ে কেন তারা জীবন পার করবেন খুপরি ঘরেই?

গত এক সপ্তাহ ধরে চলছে এই হিসাব-নিকাশ। কেউ বলছেন, রোহিঙ্গারা এদেশে আরাম-আয়েশে থাকায় দেশে যেতে চাইছেন না। আবার কারও কারও অভিযোগ, এনজিওসহ সুবিধাভোগী গোষ্ঠী, মিয়ানমারের কূটচাল, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের তৎপরতা, বাংলাদেশের কূটনৈতিক ব্যর্থতাসহ নানা কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হয়েছে। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বেশ কয়েকটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে এসব অভিযোগের সত্যতা যেমন মিলেছে, তেমনি রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমে ফেরার আকাঙ্ক্ষাও লক্ষ্য করা গেছে। তবে তারা সে দেশে ফিরতে চান, যে দেশে মৃত্যু তাড়া করবে না। যে দেশে আগুনে পুড়িয়ে কোলের শিশুকে অঙ্গার করা হবে না। তারা চান তাদের নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, বাড়িঘর এবং গণহত্যার বিচার। অবশ্য অধিকাংশ মানুষ নাগরিকত্ব ও জীবনের নিরাপত্তাকেই বড় করে দেখছেন।

কিন্তু কেমন পরিবেশ অপেক্ষা করছে নাফ নদের ওপারে এই রোহিঙ্গাদের জন্য? রোহিঙ্গাদের ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে শরণার্থী ক্যাম্পের ছোট ছোট টিনের ঘরের ছবি- যেগুলো তাদের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এসব ঘরের ছবি দেখিয়ে তারা বলছেন, ক্যাম্প থেকে আরেক বন্দিশিবিরে যাবেন না। ফিরলে নিজেদের বাড়িতেই ফিরবেন। টেকনাফের শালবাগান ক্যাম্পে রোহিঙ্গা নারী আমেনা বেগমের চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। ঘরের দরজায় উদ্বিগ্ন হয়ে বসে আছেন। সাংবাদিক পরিচয়ে অভয় দিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি মেলে ধরেন অতীতের দুঃসহ স্মৃতি। বলেন, চোখের সামনে ১৩ জনকে গুলি করে মারতে দেখেছি। সাত দিন পাহাড়-পর্বত-নদী পেরিয়ে প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেছি। মিয়ানমার সরকারকে আর বিশ্বাস করতে পারছি না। দেশের জন্য এখনও মন কাঁদে, কিন্তু যেখানে মরণের ভয়, সেখানে কীভাবে যাব? মাঝে মাঝে নিজেকে খুব অসহায় লাগে। এ বিশাল পৃথিবীতে কোনো দেশ নেই, কোনো ঠিকানা নেই, নেই কোনো লাইসেন্স; তাও কি হয়? রোহিঙ্গা ভাষায় তিনি বলেন, ‘মানুষ হিসাবে আরারে হন কিয়ে মানি লইত ন-চায়, মরার ডর পুয়ারে লই এক আন্ধা জিন্দেগি পার গরির। দুনিয়ার হন কেউ রোহিঙ্গার হষ্টর কথা ন পুনে।’ [অর্থাৎ, মানুষ হিসেবেই আমাদের কেউ মেনে নিতে চাচ্ছে না। মৃত্যুভয় সঙ্গী করে পার করছি অনিশ্চিত এক অন্ধকার জীবন। পৃথিবী রোহিঙ্গাদের দুঃখ শোনে না।]

বাংলাদেশে থাকলেও মাঝেমধ্যে মিয়ানমারের খবর নেন আমেনা বেগম। তাদের ভিটেমাটি দখল হয়ে গেছে বলে জানান তিনি। শুনেছেন ভিটেমাটির কোনো চিহ্নও নেই। তাদের নিয়ে বন্দিশিবিরে আটকে রাখা হবে। এর চেয়ে এখানেই ভালো আছেন।

নিউইয়র্ক টাইমসও মিয়ানমারের প্রত্যাবাসন কেন্দ্রের চিত্র তুলে ধরেছে। জানিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে যে রোহিঙ্গারা ফিরবে, তাদের জন্য ২০১৮ সালের জুলাইয়ে উত্তর রাখাইনে তৈরি করা হয়েছে এন খু ইয়া প্রত্যাবাসন কেন্দ্র। চারপাশের দেয়াল আর ওপরে টিনের ছাউনির ঘরগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায় প্রত্যাবাসনের এই আশ্বাস কতটা ফাঁপা ছিল। গাছগাছালিহীন মরুভূমির মতো জায়গাটা এমনই চুপচাপ যে, একটি কুকুরও নির্বিঘ্নে চারপাশে হেঁটে গন্ধ শুঁকে যেতে পারে। এমনকি ওয়াচ টাওয়ার থেকে নজর রাখার জন্যও কোনো সৈনিক মোতায়েন করা নেই। দেখার কেউ নেই।

এ তো গেল রোহিঙ্গাদের জন্য তৈরি করা ঘরের চিত্র। কিন্তু যে ভিটেমাটি রেখে তারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে সেসবের কী দশা এখন- তাও ছবিসহ তুলে ধরেছে নিউইয়র্ক টাইমস। জানিয়েছে, মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া যে কোনো রোহিঙ্গাই এখন আমূল বদলে যাওয়া এক চিত্র দেখতে পাবে। রাখাইনকে বদলে দেওয়ার জন্য সরকার কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালছে। গড়ে উঠছে নতুন নতুন শক্তিকেন্দ্র, সরকারি দালানকোঠা। বিশেষত সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষীদের ঘাঁটিও গড়ে উঠছে। নতুন নতুন স্থাপনাগুলো গড়ে উঠছে জাতিগতভাবে নির্মূল করার লক্ষ্যে পরিচালিত অভিযানের শিকার রোহিঙ্গা আবাসভূমির ছাইভস্মের ওপর।

মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ কখনও খোলাসা করে বলেনি, ফিরিয়ে নিয়ে রোহিঙ্গাদের কোথায় রাখা হবে। যদিও প্রত্যাবাসী রোহিঙ্গা পরিবারদের জন্য বসতি স্থাপনের রেকর্ড বাজিয়ে চলেছে তারা। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কিংবা নিরাপত্তা নিয়েও তারা কোনো বক্তব্য দেয়নি, আশ্বস্ত করেনি। প্রত্যাবাসন শুরুর সম্ভাব্য তারিখ ২২ আগস্ট টেকনাফের শালবাগান ক্যাম্পে মিয়ানমারের একজন নাগরিক উপস্থিত থাকলেও তিনি সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি। জাতিসংঘ বলছে, যেখানে সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নেই, সেখানে কোনো উদ্বাস্তু ফেরত পাঠানোর প্রশ্নই আসে না। যদি জোর করে তাদের পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়, তা হবে আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইনের দৃশ্যপট আসলেই পরিবর্তন হয়েছে, তা প্রমাণ এবং নিশ্চিত করার চেষ্টা মিয়ানমার সরকারও করছে না বললেই চলে। এ ছাড়া বিতর্কিত আরও একটি বিষয় নিয়ে আসা হয়েছে- তা হলো, যারা ফেরত আসতে চায়, তাদের পরিচয়পত্র নিতে হবে। মিয়ানমার সরকার এমনকি ‘রোহিঙ্গা’ নামটিও মেনে নিতে নারাজ। যারা ফিরে যাবে, তাদের তারা পরিচিতিপত্র দেবে বাঙালি হিসেবে। বলা হবে, এরা বাংলাদেশ থেকে আসা বিদেশি অনধিকার প্রবেশকারী। রাখাইন থেকে আগত কোনো জাতিগত গোষ্ঠী নয়। পেছনে জ্বলন্ত বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।

বাংলাদেশে এখন যে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী আছে, তার বড় অংশই আসে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর। এর আগেও তারা ১৯৭৮, ১৯৯১-১৯৯২, ২০১২, ২০১৫ ও ২০১৬-২০১৭ সালে সামরিক নির্যাতন এবং দমনের মুখোমুখি হয়ে মিয়ানমার ছেড়ে পালিয়ে এসেছে। কিছু বিচ্ছিন্ন দেশান্তরের ঘটনা বাদ দিলে ১৯৭৮ এবং ১৯৯২ সালে রোহিঙ্গা আসে যথাক্রমে প্রায় দুই লাখ ও তিন লাখ। ১৯৭৮ সালের সবাই ফেরত গেছে। ১৯৯২ সালে আসা রোহিঙ্গাদের প্রায় ১৯ হাজার রয়ে যায়। সুদিন ফেরার আশায় তারা দেশে ফিরলেও বারবার তাদের সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে হয়েছে। যতবারই তারা আশ্রয় নিয়েছে, ততবারই কমবেশি মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো গেছে। কিন্তু ২০১৭ সালের আগস্টে যে সাত লাখ রোহিঙ্গা এখানে এসেছে তাদের একজনও রাখাইনে ফিরে যায়নি। ফলে তাদের চাপে এখন বিপর্যস্ত কক্সবাজার।

এবার দুই দফায় তারিখ ঠিক করেও রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে না পারার কারণ কী? এমন প্রশ্ন ছিল ১৯৯২ সালে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রত্যক্ষদর্শী সাবেক সরকারি কর্মকর্তা মোহাম্মদ হানিফের কাছে। তিনি তখন রাঙামাটির সহকারী কমিশনার ছিলেন। পরে অবসর নিয়েছেন অতিরিক্ত সচিব হিসেবে। তিনি বলেন, সে সময়ের প্রেক্ষাপট আর এখনকার প্রেক্ষাপট এক নয়। সে সময়ের তুলনায় মিয়ানমারের শক্তি এখন অনেক বেড়েছে। তখন মিয়ানমার খানিকটা হলেও আন্তরিক ছিল। মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল তখন এদেশে এসে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেছে। তাদের বুঝিয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝিদেরও রাজি করিয়েছে। ফলে তারা স্বেচ্ছায় দলে দলে সীমান্ত পার হয়েছে।

মোহাম্মদ হানিফ বলেন, এবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করাই বড় চ্যালেঞ্জ। তাদের অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা দূর করার মতো কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি। গত দুই বছরে সবগুলো সংস্থা রোহিঙ্গাদের নাগরিক সুবিধার দিকে জোর দিয়েছে- প্রত্যাবাসন নিয়ে কোনো কাজ করেনি। রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরতে উদ্বুদ্ধ করেনি। এর আগে ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গারা নিজেদের গ্রামে নিজেদের বাসভূমিতেই ফিরে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু এবার তাদের জন্য তৈরি করা হয়েছে ভিন্ন স্থানে শরণার্থী ক্যাম্প- যা তাদের অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

সাবেক অতিরিক্ত সচিব হানিফ বলেন, ১৯৯২ সালে ১৩টি ক্যাম্পে বিভক্ত ছিল রোহিঙ্গারা। ক্যাম্পের অভ্যন্তরে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া অন্য কেউ ঢুকতে চাইলে ক্যাম্প ইনচার্জের অনুমতি নিতে হতো। জাতিসংঘ উদ্বাস্তুবিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর) এবং অক্সফামের (স্যানিটেশন কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত) প্রতিনিধি ছাড়া আর কোনো বিদেশি বিনা অনুমতিতে ক্যাম্পে ঢুকতে পারতেন না। সরকারি কর্মকর্তারা সারাবছর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করতেন।

সংকট উত্তরণে কিছু পরামর্শ দিয়ে মোহাম্মদ হানিফ বলেন, জাতিসংঘ বলেছে- রাখাইন রাজ্যে প্রত্যাবাসনে যাবতীয় শর্ত পূরণের দায় মিয়ানমার সরকারের। তাই যদি হয়, তাহলে এ ব্যাপারে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াতে হবে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে। কোনো অজুহাতেই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা যাবে না।

এবারের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে মিয়ানমারের ‘ধোঁকাবাজি’ আখ্যা দিয়ে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মুহিব উলল্গাহ বলেন, তিন হাজার ৫৪০টি পরিবারের যে তালিকা মিয়ানমারের পক্ষ থেকে করা হয়েছে- সে তালিকাতেও ঝামেলা আছে। পরিবারের সবার নাম তালিকায় নেই। তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসনের খবর জেনেছে এক-দু’দিন আগে। ১২ লাখ মানুষের মধ্যে মাত্র তিন হাজার ৫৪০টি পরিবারকে পাঠানোর সিদ্ধান্তও হাস্যকর। রোহিঙ্গাদের যদি নাগরিকত্বই দেওয়া না হয়, তাহলে তারা কেন আবার মৃত্যুর দিকে যাবে?

তিনি বলেন, এটা ঠিক, একটা সময় রোহিঙ্গারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনই ছিল না। কিন্তু সব হারানো রোহিঙ্গারা এখন পৃথিবীতে একটু বেঁচে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা বাংলাদেশে থেকে নিজের দেশে অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে গত ২৫ আগস্ট লাখো রোহিঙ্গার সমাবেশ হয়েছে। স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে রোহিঙ্গারা এখানে তাদের অধিকার ফিরে পাওয়ার দাবি বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছে।

সূত্র: সমকাল

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: দুঃখ শোনে না পৃথিবী, ভিটেমাটিতে ফিরতে চায় না, রোহিঙ্গাদের
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন