রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন যদি না হয়?
রোহিঙ্গাদের আরাকানে ফেরৎ পাঠানো যদি সম্ভব না হয় তাহলে কি ঘটবে? এটা নিয়ে বাংলাদেশে দুই ধরনের চিন্তা কাজ করছে এমন মনে হয়ঃ
১। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মনে করে রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশ ভবিষ্যৎে নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হবে। এই সমস্যা কি এবং এর স্বরূপ কি? এনিয়ে মতভেদ চিন্তার বিচিত্রতা আছে। সামনে আলোচনায় এসব আসবে।
২। একদল মানুষ সমস্ত বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে দেখার চেষ্টা করছেন। তাদের ধারণা রোহিঙ্গারা ধর্মপ্রাণ এবং এদের ধর্মীয় আদর্শে সহজে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব। অতএব রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে থেকে গেলে কোনো এক সময় তাদের রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগিয়ে দলের বা সংগঠনের শক্তি বৃদ্ধি করা যাবে।
৩। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গ্রুপের অনেকের নজর থাকতে পারে এই রোহিঙ্গাদের প্রতি। তাদের কাজে লাগিয়ে এই অঞ্চলে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের পরিধি বিস্তার করার- যা মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে এখন চলমান।
এসবই ধারণা। তবে বিশ্বের অন্যান্য অসমাপ্ত উদ্বাস্তু সমস্যার দিকে তাকালে আমরা যা দেখি রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে তেমনি হবে এমন ভাববার কোনো কারণ নাই। তার পরেও অনেক ক্ষেত্রে মিল খুঁজে পাওয়া যেতে পারে বা যাবে।
১৯৪৮ সালে প্যালেষ্টাইন যুদ্ধে ৭১১০০০ ইহুদী ও মুসলমান রিফিউজি হয়। অভ্যন্তরীণভাবে অনেক মানুষ বাস্তচ্যুত হয়ে নিজ দেশে পরবাসি হয়ে পশ্চিম তীর, গাজা স্ট্রিপে ও খোদ ইসরাইলের অধিবাসী হয়। বর্তমানে এদের সংখ্যা ১৩ লক্ষের উপরে।
২০১৫ সালে প্যালেষ্টাইন যুদ্ধে রিফিউজিদের বংশধরদের মোট সংখ্যা দাড়িয়েছে ৫১ লাখের মতো। এই উদ্বাস্তুরা ছড়িয়ে রয়েছে ইরাক, সিরিয়া, জর্ডন, মিশর, আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে। ১৯৪৮ সালের উদ্বাস্তুদের মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ এখনও জীবিত আছেন।
রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে এমনই ঘটবে বলা যায়। কারণ গত ২০ মাসের পরিসংখ্যান বলছে কক্সবাজারের রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পসমুহে ১ লক্ষ মানব শিশুর জন্ম হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে এদের অবস্থাও প্যালেষ্টাইন উদ্বাস্তুদের বংশধরদের মতোই হবে ভবিষ্যতে বলা যায় সংখ্যার দিক থেকে।
বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের আরাকানে প্রত্যাবাসন যদি দীর্ঘায়িত হয় তাহলে কক্সবাজারের অঞ্চলে তাই ঘটবে যা ১৯৪৮ সালের পরে ইসরাইলের তরফ থেকে প্যালেষ্টাইনে ঘটেছিল।
আমরা জানি নেশা হিসাবে ইয়াবা একটি বহুল প্রচলিত নাম বাংলাদেশে। এদেশের প্রায় সকল পরিবারে এই নেশার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। বাংলাদেশে যাদের মাধ্যমে আরাকান থেকে বা মিয়ানমার থেকে ইয়াবা বাংলাদেশে আসতো এই ইয়াবা চোরাচালানী রহিঙ্গাদের প্রায় সবাই এখন বাংলাদেশে উদ্বাস্তু হয়ে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে।
যত দিন যাবে এই রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পগুলি ইয়াবাসহ নানা ধরনের নেশার নিরাপদ গুদামে পরিনত হবে। এখনই অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে স্থানীয় মানুষের পক্ষে রাতের বেলা রহিঙ্গাদের ক্যাম্পে প্রবেশ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষেও রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পগুলি আর নিরাপদ নয়।
যেহেতু ইয়াবাসহ অন্যান্য নেশা দ্রব্য বাংলাদেশে পাচারের সাথে স্থানীয় চোরাচালানী ও মাদক ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট জড়িত তাই অল্প সময়ে রোহিঙ্গারা অনেক টাকার মালিক হয়ে স্হানিয় প্রভাবশালীদের সহায়তায় স্থানীয় বাসিন্দাদের ভয়ভীতি ও লোভ দেখিয়ে তাদের বসতবাড়ী এবং জোতজমি কিনে সেখানে বাড়ী তৈরী করে বসবাস আরম্ভ করবে।
এই কৌশলে ধীরে ধীরে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পগুলি জনশুন্য হতে শুরু করবে। কিন্তু এরা এখানেই থেমে থাকবে না। এই একই প্রভাবশালীদের সহায়তায় এরা জাতীর পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট সংগ্রহ করে পুরোদমে বাংলাদেশী হয়ে যাবে। এবং এই পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ার মতো দেশেসমুহে দলে দলে কর্মসংস্থানের জন্য পাড়ি জমাবে।
এইতো সেদিন এক সংবাদে দেখলাম, এক রোহিঙ্গার মেয়ের নাক ফোড় অনুষ্ঠানে উপহার পড়েছে ৫০ লক্ষ টাকা। এরা সন্ত্রাসী, ডাকাত, মাদক চোরাচালান ও মানুষ পাচারের সাথে জড়িত। এদের টাকার কোনও অভাব নাই।
কারণ এই রোহিঙ্গাদের কনট্যাক্ট রয়ে গেছে আরাকানে ও মিয়ানমারের বিভিন্ন শহরে। সেখান থেকে তারা সমানে মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। বাড়তি সুবিধা হিসাবে এরা এখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্হান করে নিরাপদে মাদক ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের ঘরবাড়ি, জোতজমি কিনে ফেলার পরে অবশেষে টেকনাফ রূপান্তরিত হবে পশ্চিম তীর ও গাজা স্ট্রিপে, যেখান থেকে রোহিঙ্গারা আরাকানে প্যালেষ্টাইনিদের মতো কাটুশা মিসাইল নিক্ষেপ করবে। এর জন্য আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গ্রুপগুলি অপেক্ষায় আছে। টেকনাফ দখলের কাজ শেষ হলেই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গাদের নিয়ে তাদের কর্মকান্ড শুরু করবে এমন ধারনা পোষণ করি।
ইসরাইলের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে একবার টেকনাফ কিনে ফেলার পরে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে বের করা আর সম্ভব হবেনা। এরা তখন তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ধর্মকে আবেগের সাথে ব্যবহার করে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দল এবং ধর্মীয় সংগঠনের শক্তির আনুকুল্য লাভ করে নিজ শক্তিতে আবির্ভূত হয়ে আন্তর্জাতিক শক্তির সমর্থন লাভে সক্ষম হবে।
কিংবা আন্তর্জাতিক শক্তি রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে ফেলবে। যার অপেক্ষায় তারা আছে মনে হয়। এমনকি মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও অর্থ সহায়তা দিয়ে টেকনাফ দখল করতে সাহায্য করতে পারে এমন ধারনা উড়িয়ে দেয়া যায়না।
এমন অবস্থায় নিপতিত বাংলাদেশের অবস্থা হবে তখন আফগানিস্তান/ইরাকের মতো। এটা হলে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের পরিস্থিতি তৈরী হবে। ভবিষ্যৎে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপে কক্সবাজার ও আরাকানকে নো ফ্লাই জোন ঘোষণা করে তা ইউএন নিয়ন্ত্রনে নিয়ে সেখানে শান্তি রক্ষী মোতায়েনের সম্ভবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
উপরে যা বর্ণীত হলো সবই ধারণা প্রসূত ফলাফল যা চলমান বিশ্বকে সামনে রেখে ধারণা করা হয়েছে। এর বিপরীতে কারো উন্নত যুক্তি আমার ধারণাকে অসার প্রমাণিত করলে সবচেয়ে খুশী হবো আমি নিজে।
তবে আমি একটি বিষয় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি” হাতের পাঁচ” কখনো ছেড়ে দিতে নাই। এটা বাংলার একটি বহুল পরীক্ষিত প্রবাদ। অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অবস্থানের সময় দীর্ঘ করা যাবেনা। এতে সমুহ বিপদের সম্ভবনা আছে।
লেখক: সাবেক ডিজি, বাংলাদেশ রাইফেলস।