parbattanews

রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় দেয়া আইসিজে’র আদেশ উপেক্ষা করছে মিয়ানমার

রোহিঙ্গা জেনোসাইড বন্ধ ও অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতের (ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস, সংক্ষেপে আইসিজে) অন্তর্বর্তী আদেশ মানা বাধ্যতামূলক হলেও তা মানছে না মিয়ানমার। গত শুক্রবার রাতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ আটটি দেশ যৌথ বিবৃতিতে আইসিজের আদেশ মেনে চলতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

এদিকে গত ২৮ জানুয়ারি আইসিজের দেওয়া ওই আদেশের কপি পাওয়ার পরপরই জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস তা নিরাপত্তা পরিষদে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু আট মাস হয়ে এলেও নিরাপত্তা পরিষদ আইসিজের আদেশ কার্যকরে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ আটটি দেশের বিবৃতির মধ্য দিয়েও মিয়ানমার ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদে মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য চীন, রাশিয়াসহ অস্থায়ী সদস্য ইন্দোনেশিয়া, নাইজার, সেন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড দ্য গ্রেনাডাইন্স, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভিয়েতনাম ওই বিবৃতিতে যুক্ত হয়নি।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, আইসিজের আদেশ বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার কথা থাকলেও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ তাতে ব্যর্থ হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক বিচারিক কাঠামোকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানালেও বিবৃতিতে কৌশলগতভাবে অনেক শব্দ এড়িয়ে গেছে। যেমন—আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতেও (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট, সংক্ষেপে আইসিসি) যে মিয়ানমারকে জবাবদিহি করানোর চেষ্টা চলছে তা নিরাপত্তা পরিষদের আট সদস্য রাষ্ট্রের যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখ নেই। এর কারণ সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র সাম্প্রতিক সময়ে নিজেই আইসিসির বিচারিক এখতিয়ারকে অস্বীকার করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। এমনকি আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধের তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া আইসিসির প্রসিকিউটরের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ‘বার্মা ক্যাম্পেইন, ইউকে’র পরিচালক মার্ক ফ্রেমনার বলেছেন, তাঁরা মনে করেন রোহিঙ্গাদের নিরাপদে ফেরার অর্থ হলো তাঁদের ওপর সংঘটিত নিপীড়নের জবাবদিহি নিশ্চিত করা। অথচ তারা আইসিজে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলায় গাম্বিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়নি। যুক্তরাজ্য মিয়ানমার পরিস্থিতির তদন্তের দায়িত্ব আইসিসিকেও দেয়নি। যুক্তরাজ্য রোহিঙ্গাদের নিরাপদে মিয়ানমারে ফেরার কথা বলেছে, অথচ এই ফেরার জন্য যে নাগরিকত্ব অপরিহার্য তা তারা উল্লেখ করে না।

অন্যদিকে চীন এখনো মিয়ানমারের পক্ষে জোরালোভাবে অবস্থান নিয়ে আছে। তাই নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা ইস্যুতে শিগগিরই সিদ্ধান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, আগামী দিনগুলোতেও রোহিঙ্গা ইস্যু জাতিসংঘে আলোচনায় আসবে। তবে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহী রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা নেওয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। মিয়ানমারবিষয়ক জাতিসংঘের সাবেক স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার বিগত বছরগুলোতে রাষ্ট্রগুলোকে নিজ নিজ উদ্যোগে বা কিছু রাষ্ট্র মিলে ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিষদের যে আটটি দেশ গত শুক্রবার রাতে আলোচনা শেষে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে, তারাও চাইলে নিজ নিজ অবস্থান থেকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।

সম্প্রতি মিয়ানমারে সরকারি মানচিত্রে রোহিঙ্গা গ্রাম মুছে দেওয়ার যে খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এসেছে তাও জেনোসাইডের আলামত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে বলে কূটনীতিক ও বিশ্লেষকরা মনে করছেন। সাবেক রাষ্ট্রদূত মুনশি ফয়েজ আহমেদের ভাষ্য, মিয়ানমারে সরকারি মানচিত্রে রোহিঙ্গা গ্রাম মুছে দেওয়ার বিষয়টি আইসিজের নজরে আনা উচিত।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, মিয়ানমার এখন আইসিজের নজরদারিতে আছে। জেনোসাইডবিরোধী সনদ লঙ্ঘন ও রোহিঙ্গা জেনোসাইড সংঘটনের দায়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়া আইসিজেতে যে মামলা করেছে তা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। গত ২৩ জানুয়ারি আইসিজে অন্তর্বর্তী আদেশকে হত্যা, ধ্বংস, শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির মাধ্যমে জেনোসাইড সংঘটন হওয়া ঠেকাতে মিয়ানমারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে জেনোসাইডের আলামতগুলো সুরক্ষা করতেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমার তা পালন করছে না। আগামী নভেম্বর মাসে মিয়ানমারে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে তা থেকে রোহিঙ্গাদের বাদ রাখা হচ্ছে। একই সঙ্গে রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের পর থেকে তাদের নাম-নিশানা মুছে ফেলার প্রক্রিয়া চলছে। সামগ্রিকভাবে মিয়ানমারের এসব উদ্যোগ রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমি থেকে নিশ্চিহ্ন করার অংশ বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন। তা ছাড়া মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে এখনো সশস্ত্র সংঘাত চলছে। এর শিকার হচ্ছে রোহিঙ্গারা। আইসিজের আদেশের পরও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় এবং বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ফেরাতে তেমন কোনো উদ্যোগই নেয়নি। বরং তাদের জাতিগত পরিচয়, অস্তিত্ব মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে।

সূত্র: South Asian Monitor

Exit mobile version