parbattanews

রোহিঙ্গার চাপে বাড়তি দুর্ভোগ কমছেনা স্থানীয়দের

জীবন বাঁচাতে এক কাপড়ে এদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গারা। প্রথম থেকেই রোহিঙ্গাদের কষ্টের ভাগিদার হয়েছে এদেশের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার লোকজন। সরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ত্রাণ তৎপরতা অংশ নেয় স্থানীয় ও সারা দেশের মানুষ। রোহিঙ্গাদের চিকিৎসার জন্য স্থাপন করা হয়েছে অনেকগুলো মেডিকেল ক্যাম্প। বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে সবচেয়ে বেশি চাপের মধ্যে পড়েছেন উখিয়া-টেকনাফের স্থানীয় জনগোষ্ঠী।

নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য, যাতায়াত, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানামুখী ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন তারা। স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৮০ শতাংশ কোটা ভিত্তিক চাকুরীতে স্থানীয়দের নিয়োগ দেওয়ার দাবী জানিয়ে আসলেও তার এখনও বাস্তবায়ন করেনি সংশ্লিষ্ঠ এনজিও সংস্থা।

জানা গেছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে স্বাস্থ্য, ত্রাণ কার্যক্রমসহ বিভিন্ন সেবা নামের বর্তমানে দেড় শতাধিক দেশি-বিদেশি এনজিও ও আইএনজিও সংস্থা কর্মরত রয়েছে। এতে প্রতিদিনই উখিয়া-টেকনাফে ভীড় করছেন সারাদেশ থেকে আসা প্রচুর এনজিও সংস্থার মানুষ। তাদের যাতায়াতের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে এখানকার ছোট-বড় ৫ হাজারের অধিক পরিবহন। বাইরের এসব লোকজনের জন্য কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে দেখা দিয়েছে পরিবহন সংকট।

রাস্তায় দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেও যানবাহন মিলছে না স্থানীয়দের। পরিবহন সংকটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পরিবহন ভাড়া। কক্সবাজার থেকে উখিয়া পর্যন্ত অটোরিক্সা ভাড়া ৭০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১০০ থেকে ১২০টাকা। উখিয়া থেকে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের যে ভাড়া ১০টাকা ছিল এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০টাকায়। সেই সঙ্গে বেড়েছে বাস ভাড়া।

বিগত ২ বছর ধরে ধরে এভাবেই স্থানীয়দের যাতায়াতে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। উখিয়ার সিএনজি মালিক সমিতির সভাপতি মোক্তার আহমদ জানান, ভাড়া আগের নিয়মে নেওয়ার জন্য সিএনজি সমিতির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

কক্সবাজার থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াতে স্থানীয়দেরও প্রতিটি চেক পোস্টে দেখাতে হচ্ছে জাতীয় পরিচয়পত্র। এ নিয়ে অনেকেই পড়ছেন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। অন্যদিকে কক্সবাজার-টেকনাফে সড়কটি এমনিতেই আঁকাবাকাঁ এবং সরু। ত্রাণ তৎপরতায় নিয়োজিত প্রচুর ট্রাক, বাস ও প্রাইভেট গাড়ির কারণে চাপ বেড়ে গেছে এ সড়কে। সেই সাথে বৃষ্টিতে সড়কের বিভিন্ন স্থানে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত। এসব গর্তে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা।

উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে করেছে সরকারের মন্ত্রীসহ দেশি-বিদেশী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ। তাদের প্রোটোকলের কারণে সে চাপ আরও দ্বিগুন বেড়েছে। ফলে যানজট লেগে থাকছে দীর্ঘসময়। নষ্ট হচ্ছে প্রচুর কর্মঘণ্টা।

উখিয়া-টেকনাফের শিক্ষাক্ষেত্রেও তৈরি হয়েছে নানা জটিলতা। নিয়মিত ছাত্ররা লোভে পড়ে কিছু কিছু এনজিও সংস্থায় চাকুরিরত থাকার কারনে উখিয়া উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উখিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ও উখিয়া বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজে কমেছে ছাত্র/ছাত্রীর সংখ্যা। চলতি এইচএসসি পরীক্ষায় উখিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের পাশের হার ছিল ৩৩%। যাহা উখিয়ার জন্য বড় ধরনের লজ্জাজনক। এমন অবস্থায় ভবিষ্যত মেধাবী প্রজন্ম হারাতে বসতে পারে উখিয়া। এতে অভিভাবকদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে ক্ষোভ।

উখিয়ার সরকারি পরিচালিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রতিদিনই ভর্তি হচ্ছে নানা রোগে আক্রান্ত শত শত রোহিঙ্গা রোগী। যাদের কারণে স্থানীয় অসুস্থদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় চাপ পড়ছে। উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা প্রকল্প কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান জানান, বিপুল সংখ্যক রোগাক্রান্ত রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই চাপ বেড়েছে। তবে সরকারের বিশেষ পদক্ষেপের মাধ্যমে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা স্বাভাবিক রয়েছে।

উখিয়ার বনভূমিতে রোহিঙ্গা বসতি গড়ে উঠার কারনে একদিকে নষ্ট হয়েছে সামাজিক বনায়ন অন্যদিকে ব্যক্তি মালিকানাধীন পতিত জমিতেও ও প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র। ফলে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে স্থানীয়দের মধ্যে তৈরি হচ্ছে মতবিরোধ। সামাজিক বনায়নের সুফলভোগী হাবিবুর রহমান, মুফিজুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী জানান, রোহিঙ্গারা নির্ধারিত সামাজিক বনায়নে আশ্রয় নেওয়ার কারণে গাছগাছালি কেটে সাবাড় করে ফেলেছে।

উপজেলা সহকারি বন সংরক্ষক রফিকুল ইসলাম জানান, রোহিঙ্গারা বসতির কারনে বন সম্পদের অপূরনীয় ক্ষতি হয়েছে। রোহিঙ্গা বসবাসের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কতিপয় স্থানীয় প্রভাবশালী লোকজন বেশ কিছু বনভূমি অবৈধ দখলে নিয়েছে। এসব বনভূমি উচ্ছেদের জন্য ইতিমধ্যে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা আন্তর্জাতিক সমস্যা। এ সমস্যা থেকে আমাদেরকে পরিত্রান পেতে হলে দেশি-বিদেশি এনজিও ও আইএনজিওদের প্রতি নজরদারী বাড়াতে হবে। কারণ এসব এনজিও ও আইএনজিও সংস্থা গুলো রোহিঙ্গাদের পুঁিজ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য রোহিঙ্গা সমস্যা জিয়ে রাখার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। যার ফলে বার বার প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া হোঁচট খাচ্ছে।

উপজেলা নির্বাহী নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ নিকারুজ্জামান চৌধুরী জানান, রোহিঙ্গার ইস্যুকে পুঁজি করে কেউ যদি নিত্যপণ্য সহ যেকোন মালামালে অতিরিক্ত মূল্য আদায় করে থাকে তাহলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়াও দেশ ও জাতির ক্ষতি হয় এমন কাজ কেউ করে থাকলে তাকেও আইনের আওতায় আনা হবে।

উল্লেখ্য যে, গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংসতা শুরুর পর প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে সাড়ে ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবরসহ বিভিন্ন সময়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাসহ এখন উখিয়া ও টেকনাফ আশ্রয় শিবিরে অবস্থান নিয়েছে প্রায় ১১ লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা।

Exit mobile version