রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাড়তি চাপে পড়লো বাংলাদেশ

fec-image

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা গ্রহণ করে ১২ মাসের মধ্যে নতুন নির্বাচন দেয়ার কথা বলেছে। তারা ১২ মাস থাকবে নাকি ১২ বছর ক্ষমতায় থাকবে তা ভবিষ্যতই বলে দেবে।

রাষ্ট্রের ক্ষমতা সামরিকবাহিনী কর্তৃক দখল করার ব্যাপারে ব্যাপক মিল রয়েছে তাদের সাথে পাকিস্তানের।

বিশ্বের গণতন্ত্রের পতাকাধারী পরাশক্তিগুলো যখন মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সমস্বরে চিৎকার করছিল, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তখন সুকৌশলে গণতন্ত্রী নেতা সু কি র সঙ্গে আলোচনা করে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে দেশ পরিচালনার ব্যাপারে, সমারিক বিাহিনীর ভূমিকা নিশ্চিত করে, ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে। সু কির দল নির্বাচিত হয়ে তাই শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতায় যায়।

কিন্তু ২০২০ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময়কালে এসে পৃথিবী বদলে গেছে।

ট্রাম্প ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকাকালে নিজে হয়ে উঠেছিলেন একনায়ক; একই সাথে তিনি সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন বিভিন্ন দেশে ‘গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করার জন্য।

নব্য স্বৈরাচারেরা নিশ্চিত ছিল যে, দ্বিতীয় টার্মে ট্রাম্প সহজেই জয়ী হবেন আর পরবর্তী চার বছর সময়কালে অনন্তকাল ক্ষমতায় থাকার রূপরেখা ও পদ্ধতি তারা তৈরি করে ফেলতে পারবেন।

এমন যখন পরিস্থিতি, গণতন্ত্রের যখন মরণদশা, পৃথিবীব্যাপী গণতন্ত্র যখন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে, মিয়ানমারের সমারিক বাহিনী তখন ঝোপ বুঝে কোপ মেরে ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে।

বিশ্বের পরাশক্তিগুলি, যারা গণতন্ত্রের নেতৃত্ব দেয়, এতে তারা হতবাক হয়ে গেল। গণতন্ত্রকে কোরামিন দিয়ে বাঁচানোর দেশ যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের সামরিকবাহিনীকে হুমকি দিয়ে বলেছে, গণতন্ত্র ফেরত দিতে হবে, সঙ্গে তার মিত্র অষ্ট্রেলিয়াও একই সুরে কথা বলেছে। ভারত হয়েছে মহা উদ্বিগ্ন, ‘নিমা গুন্ডা মে ফাঁস গিয়া’ গল্পের মতো। আর চীন রয়েছে তার প্রেসিডেন্টের মুখায়বের মতো নির্বিকার।

গত বছর (২০২০ সাল) পুরাটা সময় বিশ্ব মিডিয়া চিৎকার করছিল নতুন স্নায়ু যুদ্ধ শুরু হওয়ার বিষয় নিয়ে। ১৯৪৮ সালের পর স্নায়ু যুদ্ধের সময় বিভিন্ন দেশে সামরিক অভ্যুথান এবং পাল্টা অভ্যুথানে সরকার পরিবর্তনের বিষয়টি ছিল সকাল-বিকেলের খবর। তাই নতুন স্নায়ু যুদ্ধ নিয়ে বিশ্ববাসী আশংকার মধ্যে ছিল। কখন যেন শুরু হয় পুরানো সেই খেলা।

খেলা শুরু হলো বাংলাদেশের পাশের দেশ এবং চীনের প্রতিবেশী মিয়ানমার দিয়ে।

বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগরে শত্রুপক্ষের যুদ্ধজাহাজের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য চীনের আর প্রয়োজন হবে না সুকির মতামতের। পরিস্থিতি বদলে গেছে। মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রের উৎকণ্ঠা  এখানেই।

আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, তাঁর দেশে এখন থেকে অন্যান্য দেশের সঙ্গে সরাসরিভাবে সম্পর্ক উন্নয়ন (এনগেজমেন্ট) করবে। ছয় মাস পূর্বে সাবেক সেক্রেটারি অফ স্ট্যাট মেডলিন অলব্রাইটও একই কথা বলেছিলেন ‘ইকোনমিস্ট’ পত্রিকার সাথে সাক্ষাৎকারে। প্রশ্ন হলো, তাহলে ইতোমধ্যে তাদের তৈরি করা আঞ্চলিক মুরুব্বীদের কী হবে?

বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কে ছেদ পরেনি কখনও। সরাসরি যোগাযোগ সবসময়ই ছিল। তবে, সম্প্রতি ভারতকে আঞ্চলিক মুরুব্বী বানাতে গিয়ে আমেরিকা ঘুমন্ত চীনকে ‘জাগ্রত’ করেছে। নেপোলিয়ান ঘুমন্ত চীনকে জাগাতে বারণ করেছিলেন, কিন্তু আমেরিকা তার কথা শোনেনি।

ফলস্বরূপ বাংলাদেশের দোরগোড়ায় সামরিক শাসনের পদ্বধনি শোনা গেল। থাইল্যান্ডের অবস্থাও ভালো না। ভারত উদ্বিগ্ন তার ‘সেভেন সিস্টার’ নিয়ে। মায়ানমারের ক্ষমতায় রদবদল তাকে মহাচিন্তায় ফেলেছে।

অনুপচেটিয়ার আত্মসমর্পণের পর ভারত ঘোষণা করেছিল, উওর-পূর্ব ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু প্রথম আলো পত্রিকা মঙ্গলবার (২ ফেব্রুয়ারি ২০২১) ‘পরেশ বড়ুয়ার কাছে আবেদন আসামের বিজেপি নেতার’ শিরেনামে এক প্রতিবেদন করেছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে:

“উওর-পূর্বাঞ্চলীয় ভারতে বিজেপির (ভারতীয় জনতা পার্টি) সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা মনে করা হয় আসাম মন্ত্রিসভার হিমন্ত বিশ্বশর্মাকে। তিনি পূর্ব-ভারতের নিষিদ্ধ সংগঠন উলফার কাছে আবেদন জানালেন একটি সংস্থার অপহৃত কর্মীদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য। আসামের স্থানীয় একটি উৎসবে অংশগ্রহণের পরে হিমন্ত বিশ্বশর্মা বলেন, তিনি এ পবিত্র দিনে আবেদনটি জানচ্ছেন।

উলফা-ই (ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম-ইন্ডেপেন্ডেন্ট) এর কাছে আমি ওই কর্মীদের মুক্তি দেওয়ার জন্য আবেদন জানাচ্ছি। তারা দুজনেই সংস্থার একেবারে নিচের দিকের কর্মী । এঁদের অপহরণ করে কোনো লাভ হবে না। আমি পরেশ বড়ুয়ার (উলফা-ই-এর প্রধান) কাছে আবেদন জানাচ্ছি, জনগণের অনুরোধ শুনতে এবং এই দুই কর্মীকে মুক্তি দিতে।”

প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে বুঝা যায় পড়েশ বড়ুয়ার নেতৃত্বে লোকজন এখনও সক্রিয়। আর পড়েশ বড়ুয়া যত বেশি নড়াচড়া করবে, চীন ততবেশি লাভবান হবে।

মিত্র ভারতের শত্রু চীন যখন লাভবান হবে স্বভাবতই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিক্রিয়া দেখাবে এবং তার মাত্রা কতটুকু হবে তা দেখার বিষয়। তবে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পরিবর্তন বিশ্ব-ভূ-রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া থেকেই বুঝা যায়।

সামনে আসলে কী ঘটবে, মিয়ানমার সামরিক বাহিনী কীভাবে দেশ চালাবে, সেই বিষয়ে নিশ্চিত ধারণা পাওয়া কঠিন। তবে, নতুন মিয়ানমার অনেক বেশি চীননির্ভর হয়ে উঠবে। ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুরের এশিয়া রিসার্চ ইনিস্টিটিউটের গবেষক জেরার্ড ম্যাককার্থি বলেছেন, চীনের বইরের আন্তর্জাতিক অংশীদারদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে মিয়ানমার।

রোহিঙ্গা বিষয় নিয়ে তাই বাংলাদেশকে শুধুমাত্র চীনের উপরেই নির্ভর করতে হবে।

প্রতিবেশী দেশগুলোতে যখন এসব ঘটনা ঘটছে, তখন বাংলাদেশকেও তাই চিন্তাভাবনার মধ্যে পড়তে হবে।

পাশের বাড়িতে ডাকাতি হলে প্রতিবেশীকে সাবধান থাকতে হয়। বাড়তি চাপের মধ্যে পড়লো বাংলাদেশ।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন