parbattanews

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সেবার নামে ব্র্যাকের লোপাট: বিল উত্তোলনে ঠিকাদারদের দৌঁড়ঝাপ

উখিয়া প্রতিনিধি:

কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শরণার্থীদের মানবিক সেবা ও পূর্ণবাসন কর্মসূচি বাস্তবায়নের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ক্যাম্প ভিত্তিক ঠিকাদার সিন্ডিকেট। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত এনজিও সংস্থা ব্র্যাকের কতিপয় কর্মকর্তার সাথে গোপন আঁতাত করে কাজ না করেই ও নিম্নমানের বাঁশ সরবরাহ এবং নামমাত্র নলকূপ, স্যানিটারি ল্যাট্রিন, গোসলখানা তৈরি করে কোটি কোটি টাকার বিল উত্তোলনের পায়তারা চালাচ্ছে বলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট পরবর্তী মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কর্তৃক বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে “মানবিক সেবার নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করছে ব্র্যাক” শিরোনামে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে প্রশাসনসহ ব্র্যাক সদর দপ্তরকেও নাড়া দেয়।

দায়িত্বশীল সূত্রে জানা যায়, গণমাধ্যমে সংবাদের সূত্র ধরে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত টিম ব্র্যাকের মানবিক সহায়ক কর্মসূচি স্যানিটেশন, ওয়ার্টার, ওয়াস ও শেড নির্মাণ সামগ্রী সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে তদন্ত টিম অসংখ্য নলকূপ অকেঁজো হয়ে বিকল অবস্থায় পড়ে থাকার দৃশ্য দেখতে পায়। এছাড়াও স্যানিটারি ল্যাট্রিনের বেহাল অবস্থা ও নড়বড়ে গোসলখানা দেখে তারা অসন্তোষ প্রকাশ করে। তদন্ত টিম পরিদর্শনের পর দীর্ঘদিন ধরে ব্র্যাকের মদদপুষ্ট ঠিকাদার জাহাঙ্গীর আলম, মেম্বার সালাউদ্দিনের মালিকানাধীন মের্সাস সালাউদ্দিন এন্ড ব্রার্দাস ও এস আর কনেকট্রাকশন বিল উত্তোলনে সমস্যায় পড়ে বলেও জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নিকারুজ্জামান চৌধুরী রবিন বলেন, ব্র্যাকের কাজ নিয়ে অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়ে আমাদের কাছে অনেক খবর আছে। রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ততা থাকায় ব্র্যাকের কাজ তদন্ত করা যাচ্ছে না। শীঘ্রই ব্র্যাকের কাজের গুণগত মান তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা আইওএম, অক্সফাম, গ্লোবাল ফাউন্ডেশন, ইউএসআইডি ও ইউনিসেফ থেকে লাখ লাখ মার্কিন ডলার সংগ্রহ করে এনজিও সংস্থা ব্র্যাক। গুরুতর অভিযোগ উঠেছে বিনা টেন্ডারে ও গোপনে আঁতাতের মাধ্যমে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মানবিক সেবার নামে লুটপাট চালাচ্ছে এ সংস্থায় কর্মরত কর্মকর্তারা।

তাদের মদদপুষ্ট চিহ্নিত ঠিকাদার সিন্ডিকেটকে কাজ পাইয়ে দিয়ে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের বেশ কয়েক জন ব্র্যাক কর্মকর্তা রাতারাতি আঙ্গুলফুলে কলাগাছ বনে গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ১২টি অস্থায়ী অনিবন্ধন ক্যাম্পে প্রায় ১০ লাখের অধিক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। বিপন্ন রোহিঙ্গাদের মানবিক সেবা ও পূর্ণবাসনে আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় এনজিও সংস্থা বিভিন্ন কার্যক্রম শুরু করে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ব্র্যাকের কর্মকাণ্ডে অন্তোষ প্রকাশ করে রোহিঙ্গা নাগরিক মো. ইউনুছ ও নবী হোছন জানান, ব্র্যাক এনজিও সংস্থা স্যানিটারি ল্যাট্রিন, টিউবওয়েল স্থাপনের কয়েকদিন পর থেকে পানি উঠে না আর ল্যাট্রিন গুলোও ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এখনো তারা যে কাজ করছে সব কাজেই অনিয়ম হচ্ছে।

এদিকে ব্র্যাক সংস্থাটি শুধুমাত্র দুইটি রিং দিয়ে ল্যাট্রিন তৈরি ও পাশাপাশি টিউবওয়েল স্থাপন মারাত্বক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে রোহিঙ্গারা। এ প্রসঙ্গে চরম আপত্তি তুলেন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তরের নিবার্হী প্রকৌশলী মো. সোহরাব হোসেন। ওই সময় ব্র্যাকের নানা অনিয়মের বিষয়টি চাওর হলে ক্যাম্পে দায়িত্বরত সেনাবাহিনী ব্র্যাকের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, ক্যাম্পে এনজিও সংস্থা গুলোর কাজ নিয়ে ইতোমধ্যে নানা বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। রোহিঙ্গাদের সেবার নামে কিছু কিছু এনজিও ক্যাম্প ভিত্তিক কাজ করে ফায়দা লুটছে। বিশেষ করে এনজিও সংস্থা ব্র্যাক রোহিঙ্গা আসার পর থেকে ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের জন্য স্যানিটেশন, ওয়াশ প্রোগ্রাম ও টিউবওয়েল এবং শেড নির্মাণের জন্য বাঁশ সরবরাহ করে আসছে। এসব কাজে হাত দিয়ে ব্র্যাক তাদের পছন্দের ঠিকাদারকে গোপনে কাজ দিয়ে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করছে। সচেতন মানুষ ব্র্যাকের বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতির কারণে ফুঁসে উঠছে। ব্র্যাকের এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির কাজ তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তিনি উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

তিনি আরো বলেন ব্র্যাক এনজিও লুটপাট ও অনিয়ম দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য জনগণকে সাথে নিয়ে সড়ক অবরোধসহ কঠোর আন্দোলনের ডাক দিবেন বলে জানান।

ব্র্যাক কর্মকর্তা বিমল চন্দ্র শীল জানান, এ পর্যন্ত ৮ লাখ বাঁশ সরবরাহ করা হয়েছে। চলতি জানুয়ারি মাসে ২৫ লাখ বাঁশ সরবরাহের টার্গেট রয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এ পর্যন্ত ২ হাজার টিউবওয়েল ও ১৪ হাজার স্যানিটারি ল্যাট্রিন বসানো হচ্ছে।

ব্র্যাকের অনিয়ম ও দুর্নীতির কথা অস্বীকার করে ব্র্যাকের বিমল চন্দ্র শীল জানান, এই টেন্ডারের মাধ্যমে যোগ্যতা সম্পন্ন ঠিকাদারকে কাজ দেওয়া হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েক জন ঠিকাদার অভিযোগ করে বলেন, গোপনে ক্যাম্প ভিত্তিক এসব ঠিকাদারকে উচ্চ মূল্যে কোটি কোটি টাকার কাজ দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট করা হচ্ছে। অনেক ঠিকাদার ২৫৫ টাকায় প্রতি পিচ বোরাক বাঁশ সরবরাহের জন্য দরপত্র দিলেও ব্র্যাকের কর্মকর্তা রহস্যজনক কারণে ২৫৮ টাকায় বাঁশ ক্রয় করছে। ঠিকাদারকে উচ্চ মূল্যে কোটি কোটি টাকার কাজ পাইয়ে দিয়ে তারাও হাতিয়ে নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী বলেন, ব্র্যাকের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ সহ স্বচ্ছপ্রক্রিয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবি জানান।

পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান এম. গফুর উদ্দিন চৌধুরী রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়ক কর্মসূচির নামে ব্র্যাকের অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতিসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে চরম অন্তোষ প্রকাশ করে উখিয়া উপজেলা আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক সভায় বক্তব্য প্রদান করেন বলে উপস্থিত সদস্যরা জানান।

ব্র্যাক কক্সবাজারের প্রজেক্ট ইনচার্জ আবদু সালামের কাছে চলমান প্রকল্পের কাজ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি একটি মিটিংয়ে থাকার কথা বলে বিস্তারিত জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

এ প্রসঙ্গে জানাতে ঢাকা হেড অফিসের ব্র্যাকের এরিয়া ম্যানেজার মাহাবুবুল আলম এবং কক্সবাজার জেলা প্রতিনিধি অজিত কুমার নন্দীকে একাধিকবার চেষ্টা করেও মোবাইল রিসিভ না করায় তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

Exit mobile version