রোহিঙ্গা জাতিগত নিধনে আরাকান আর্মি কি মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে?
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর দীর্ঘদিন ধরে চলা নৃশংস অত্যাচারের যেন শেষ নেই। রোহিঙ্গারা সেই জনগোষ্ঠী– যারা শুধুমাত্র একটি আশ্রয়ের জন্য, বেঁচে থাকার অধিকার চেয়ে পৃথিবীর কাছে আর্তনাদ করছে, তাদের জন্য পৃথিবী যেন কোনো সহানুভূতি দেখাতে অপারগ। মায়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বরতার কুখ্যাত ইতিহাস সকলেই জানে, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি আরও ভয়ানক আকার ধারণ করেছে আরাকান আর্মির নিষ্ঠুর অত্যাচারে। বুথিডং ও মংডুতে বেসামরিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নির্বিচারে হত্যা ও নির্যাতনের বেশ কিছু তথ্য ও ছবি প্রকাশ করে infoবাংলা। বেশিরভাগ ছবি ও ফুটেজ এতোটাই নৃশংস যে, তা প্রকাশ করার উপযোগী নয়।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির নৃশংসতা: একটি হৃদয়বিদারক তুলনা
রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমার সেনাবাহিনী (তাতমাদাও) ও আরাকান আর্মির সহিংসতা এমন এক বেদনার ইতিহাস যা কেবল রক্তে রঞ্জিত নয়, মানবতার পরাজয়ের দৃষ্টান্ত। ২০১৭ সালে তাতমাদাও যে গণহত্যা চালিয়েছিল, তা ছিল সুসংগঠিত এক রাষ্ট্রীয় অত্যাচার। সেই নারকীয় অভিযানে প্রায় সাত লক্ষ রোহিঙ্গা তাদের ঘরবাড়ি, পরিবার ও স্বপ্ন সবকিছু হারিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। নারী, শিশু, বৃদ্ধ—কেউই রক্ষা পায়নি। ধর্ষণ, হত্যা আর ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে পুরো জনগোষ্ঠীকে এক অমানবিক মৃত্যুতে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল।
এগুলো ছিল তাতমাদাওয়ের কার্যক্রম, কিন্তু আজ, ২০২৪ সালে এসে, আরাকান আর্মি একই নিষ্ঠুরতার পথে চলছে। বুথিডং ও মংডু এলাকায় শত শত গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ড্রোন ও আর্টিলারি হামলায় জীবন হারিয়েছে রোহিঙ্গাদের অসংখ্য শিশু, নারী ও বৃদ্ধ। ২০২৪ সালের মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত, আরাকান আর্মি তাদের সামরিক শক্তি প্রদর্শনের নামে এমন এমন নৃশংসতা চালিয়েছে, যা রোহিঙ্গাদের পুরো অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছে।
আরাকান আর্মির সাম্প্রতিক সহিংসতা
২০২৪ সালের মে মাসে পাউং জার ও লা বাও জার গ্রামে ঘটে যাওয়া আরাকান আর্মির আক্রমণ আমাদের চোখের সামনে এক ধ্বংসাত্মক চিত্র এঁকে দেয়। প্রায় সাত হাজার রোহিঙ্গা তাদের গ্রাম ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়, কারণ তাদের সামনে একমাত্র বিকল্প ছিল মৃত্যু। মায়ানমার সেনাবাহিনীর বিমান হামলায় এই সময় চারজন নিহত হয় এবং ৪০টিরও বেশি ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়। যারা পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল, তাদের জন্যও মুক্তি ছিল না। আরাকান আর্মি গুলি ছুঁড়ে তাদের পথ রুদ্ধ করে দেয়।
পরে বুথিডং এলাকার প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা গৃহহীন হয়ে পড়ে, কারণ তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। শিশুদের করুণ আর্তনাদ আর মায়েদের কান্না যেন সেই ধ্বংসের সাক্ষী হয়ে আছে, কিন্তু দুনিয়া নীরব।
অপহরণ ও হত্যার নির্মমতা
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর আরাকান আর্মির নিষ্ঠুরতা এখানেই থেমে নেই। ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে থা ইয়েত ওক গ্রামের পাঁচজন রোহিঙ্গাকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়। তাদের মৃতদেহগুলো সেতুর পাশে ফেলে রাখা হয়েছিল, যেন তারা কোনও মূল্যহীন জীব। আবার জুন মাসে বুথিডং থেকে ৮৭ জন যুবক এবং সিন্দি পারাং গ্রাম থেকে ১৩৫ জন পুরুষকে অপহরণ করা হয়। এসব যুবক ছিল রোহিঙ্গা সমাজের ভবিষ্যৎ, তাদের মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা ছিল, কিন্তু তাদের প্রাণ কেড়ে নিয়ে আরাকান আর্মি পুরো এক জনগোষ্ঠীর স্বপ্নকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
আর্টিলারি ও ড্রোন হামলা: আধুনিক অস্ত্রে মৃত্যুর মিছিল
২০২৪ সালে আরাকান আর্মির ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তি প্রকাশ পায় তাদের আর্টিলারি শেল এবং ড্রোন হামলার মাধ্যমে। এপ্রিলের ৬ তারিখে থি হো কিউন গ্রামে আর্টিলারি শেলের আঘাতে ছয়জন নিরীহ মানুষ নিহত হয়। তাদের মধ্যে দুটি শিশু ছিল, যারা জীবনের অর্থও হয়তো বুঝতে পারেনি।
এরপর আগস্ট মাসে, এক মর্মান্তিক ড্রোন হামলায় বুথিডংয়ের প্রায় ২০০ রোহিঙ্গা নিহত হয়। সেই ক্ষতবিক্ষত দেহগুলো যেন আর্তনাদ করছে, “আমরা কি মানুষ নই?” শিশু, নারী—সবাই একইভাবে এই নিষ্ঠুর মৃত্যুর শিকার হয়েছে।
নৃশংস ঘটনাগুলোর হৃদয়বিদারক বিবরণ
২০২৪ সালে আরাকান আর্মির নৃশংসতা যেন মৃত্যুর তালিকাই দীর্ঘায়িত করেছে:
৬ মে: পাউং জার ও লা বাও জার থেকে ৭ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
১৮ মে: বুথিডংয়ের ৩৫টি গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়, এক লাখ মানুষ গৃহহীন।
১০ জুন: মংডুর আলে থান কিয়াও গ্রাম থেকে ২৮টি রোহিঙ্গা পরিবারকে জোরপূর্বক বের করে দেয়া হয়।
৫ আগস্ট: ড্রোন হামলায় নিহত ২০০ রোহিঙ্গা, তাদের মধ্যে নারী ও শিশুরাও ছিল।
মানবিকতার ধ্বংস এবং আন্তর্জাতিক বিচারের দাবি
তাতমাদাও এবং আরাকান আর্মির এই অত্যাচার আমাদের মানবতার চরম অপমান। দুই বাহিনীরই লক্ষ্য ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু তারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে একইভাবে ধ্বংস করেছে। তাতমাদাওয়ের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত ছিল সুসংগঠিত গণহত্যা। আর আরাকান আর্মি তাদের বিদ্রোহী অবস্থান ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের ওপর আধিপত্য স্থাপন করতে চায়। দুই পক্ষের লক্ষ্য ভিন্ন হলেও, ফলাফল এক—মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং এক নিষ্ঠুর জাতিগত নিধন।
রোহিঙ্গাদের প্রতি আরাকান আর্মির এই নৃশংস অত্যাচার কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। মানবতা আজ আর্তনাদ করছে, আর তাই সময় এসেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার। আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার হওয়া প্রয়োজন। এমন অপরাধীদের শাস্তি না হলে, এই পৃথিবী মানবাধিকারের কথা আর কীভাবে বলবে?
রোহিঙ্গাদের প্রতি আরাকান আর্মির সহিংসতা মায়ানমার সেনাবাহিনীর অতীত সহিংসতাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তাদের গণহত্যা, অপহরণ, হত্যাকাণ্ড ও ড্রোন হামলা বিশ্ববাসীর হৃদয় ভেঙে দিচ্ছে। আমাদের এখনই জেগে উঠতে হবে, আমাদের মানবিকতা আজ আর্তনাদ করছে—এগিয়ে আসার, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার, এবং আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচারের দাবি তোলার সময় এসেছে।
সূত্র: infoবাংলা