রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংকট: চীনের ওপর কতটা ভরসা করতে পারে বাংলাদেশ?

fec-image

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তীব্র আপত্তির কারণে মিয়ানমারে তাদের প্রত্যাবাসন শুরু করার আরেকটি প্রয়াস কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। তবে বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন যে, তারা এখনও হাল ছাড়ছেন না এবং আশা করছেন রোহিঙ্গাদের রাজী করানো সম্ভব হবে।

এই আশাবাদের কারণ, বাংলাদেশের কূটনৈতিক দেন-দরবারের কারণে প্রথমবারের মত চীন এবার এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় সরাসরি সম্পৃক্ত হয়েছে।

কিন্তু চীনকে সম্পৃক্ত করেও তেমন কোনও সাফল্যের লক্ষণ এখনও নেই।

রোহিঙ্গাদের মনে নিরাপত্তার ভরসা তৈরি করতে মিয়ানমার যে উল্লেখযোগ্য কিছু করছে তার কোন ইঙ্গিত দেখা যায়নি।

তাহলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চীনের ওপর এতটা ভরসা করা কতটা সঙ্গত হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য?

এ ব্যাপারে কুয়ালালামপুরে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব চায়নার অধ্যাপক ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “মিয়ানমার ও বাংলাদেশের বাইরে তৃতীয় দেশ হিসেবে শুধুমাত্র চীন রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে সাহায্য করতে পারে।”

“তবে অর্থনৈতিক, ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত নিরাপত্তাসহ আরও নানা ইস্যুতে মিয়ানমার ও চীন একে অপরের ওপর অনেক নির্ভরশীল। তাদের মধ্যে সম্পর্কও বেশ ঘনিষ্ঠ। চীনের সমর্থন ছাড়া মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের মদদ পাওয়া বেশ কঠিন।”

কাজেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সফল করতে, বাংলাদেশের সহায়তায় চীন কতোটা এগুবে সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায় বলে, উল্লেখ করেন মিঃ আলী।

চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণ কী?
এর পেছনে দুটি কারণকে চিহ্নিত করেছে মিঃ আলী। প্রথমত, মিয়ানমারের সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা রক্ষায় চীনের স্বার্থ।

এবং দ্বিতীয়ত চীনের গ্যাস এবং জ্বালানি তেল সরবরাহ নিশ্চিত করতে মিয়ানমারের সম্পৃক্ততা। চীন এমন কয়েকটি ক্ষেত্রে মিয়ানমারের ওপর নির্ভরশীল।

এ কারণে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের ওপর চীন বড় কোন চাপ প্রয়োগ করবে বলে তিনি মনে করেন না।

মিঃ আলী জানান, মিয়ানমারের ভেতরে চীনের বহু দশকের বিনিয়োগ রয়েছে।

বিশেষ করে ষাটের দশক থেকে মিয়ানমারের সামরিক প্রশাসন এবং অতি সম্প্রতি যে দলীয় রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তাদের সঙ্গেও চীনের সম্পর্ক ক্রমশ ঘনিষ্ঠ হয়েছে।

এর কারণ মিয়ানমারের স্বার্থ নয়। এর কারণ চীনের একটা বিশাল অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তা বিষয়ক স্বার্থ রয়েছে।

চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই -র সঙ্গে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থিন কিয়াও।
এছাড়া দক্ষিণ চীন সাগরের মলাক্কা প্রণালী দিয়ে চীনের ৮৫% তেল এবং জ্বালানি গ্যাস সরবরাহ হয়।

সেই প্রণালীতে শত্রু ভাবাপন্ন দেশের নিয়ন্ত্রণ থাকায় চীনকে নানারকম সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।

চীনের বড় আশঙ্কা হল এই প্রণালীকে তারা যদি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে না নিতে পারে, তাহলে যে কোন সময়, তাদের ব্যবসা বাণিজ্য বিশেষ করে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

সেজন্য তারা মিয়ানমার, পাকিস্তান এবং অন্যান্য দেশের মাধ্যমে তাদের জ্বালানি সরবরাহের বিকল্প একটি ব্যবস্থা করে রেখেছে।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উপকূলে চাউথিউ নামের একটি বন্দরে চীন সম্প্রতি বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে।

চীন মূলত মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল এবং জ্বালানি গ্যাস আমদানি করে, যা কিনা এই বন্দরে নামানো হয়।

এই তেল এবং জ্বালানি গ্যাস সরবরাহের জন্য চীনারা গত কয়েক বছর ধরে কোটি কোটি ডলার ব্যয়ে ওই বন্দর দিয়ে দুটি পাইপলাইন বসিয়েছে এবং এজন্য মিয়ানমারকে তাদের অনেক অর্থ দিতে হয়েছে।

ওই পাইপলাইন দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের তেল এবং জ্বালানি গ্যাস চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিংয়ে পাঠানো হয়।

পাইপলাইনের যেন কোন ক্ষতি না হয় এবং জ্বালানি তেল/গ্যাসের সরবরাহ যেন নিরবচ্ছিন্ন থাকতে পারে, সেজন্য চীন কিছুটা মিয়ানমার সরকারের কাছে দায়বদ্ধ বলে মনে করেন মিঃ আলী।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এবং মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচির দফতরবিষয়ক মন্ত্রী কিয়াও তিন্ত সোয়ে।

কাজেই এই পাইপলাইন যেহেতু রাখাইন অঞ্চলের ভেতর দিয়ে যায়। তাই রাখাইন রাজ্য যেন মিয়ানমার সরকারের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণে থাকে, সেটা চীনের স্বার্থের মধ্যেও পড়ে।

“যখন মিয়ানমার সরকার দাবি করছে যে, আরাকানি বিদ্রোহীরা মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী অর্থাৎ পুলিশ, আধাসামরিক ও সামরিক বাহিনীর ওপর হামলা চালাচ্ছে এবং মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীও ওই বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নিচ্ছে, তখন চীন এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারছেনা।”- বলেন মিঃ আলী।

এদিকে ক’দিন আগেই মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করেছেন মিয়ানমারের সেনাপ্রধান।

সেসময় চীনা রাষ্ট্রদূত আবারও জোর দিয়ে বলেছেন যে, রোহিঙ্গা প্রশ্নে যেকোনো আন্তর্জাতিক চাপ সামাল দিতে চীন সবসময় মিয়ানমারের পাশে থাকবে।

ভারত বাংলাদেশের মিত্র দেশ হলেও মিয়ানমার প্রশ্নে তারা চীনের মতো নীতিমালা অনুসরণ করছে।

ভারত ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক বৈরি হলেও মিয়ানমার প্রশ্নে এই দুই দেশ গত দুই তিন দশক ধরে একই নীতিমালা অনুসরণ করে আসছে বলে জানান মিঃ আলী।

আর তা হল, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে যাই ঘটুক না কেন, বাইরে থেকে তারা কোন ধরণের চাপ আসতে দেবেনা।

ভারত বাংলাদেশের মিত্র দেশ হওয়া সত্ত্বেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে নেই।

মিঃ আলীর মতে, চীন বা ভারত কোন দেশই নিজেদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গিয়ে বাংলাদেশের স্বপক্ষে এসে দাঁড়াবেনা। এটা বাংলাদেশ যতো দ্রুত অনুধাবন করতে পারবে ততোই মঙ্গল।

উখিয়ায় একের পর এক পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হয়েছে রোহিঙ্গা বসতি।
এদিকে, বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের নিয়ে এই সংকটপূর্ণ অবস্থা চলতে থাকলে সন্ত্রাসবাদ জন্ম নিতে পারে এমন আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।

কিন্তু এই বিষয়টাকে আদৌ কতোটা গুরুত্ব দিচ্ছে মিয়ানমার, চীন বা ভারত?

এমন প্রশ্নে মিঃ আলী বলেন, “সন্ত্রাসবাদের এই আশঙ্কাকে মিয়ানমার, চীন বা ভারত সবাই আমলে নিয়েছে। কিন্তু আপাতত তারা এই মুহূর্তে তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আপেক্ষিক স্বার্থের দিকগুলোকেই বেশি বিচার-বিবেচনা করছে।”

বাংলাদেশের সামনে তাহলে উপায় কী?
রোহিঙ্গা সংকট সামাল দিতে বাংলাদেশকে আরও বাস্তবসম্মত নীতিমালা গ্রহণ করার পাশাপাশি, স্বনির্ভর হয়ে ওঠা প্রয়োজন বলে মনে করেন মিঃ আলী।

“অন্য দেশের ওপর অতি নির্ভরশীলতা কমাতে বাংলাদেশের উচিত হবে অর্থনৈতিক নীতিমালা শক্তিশালী করা, দেশের অভ্যন্তরে সমর্থনের যে ঘাঁটি রয়েছে সেটা গড়ে তোলা। যেন বাংলাদেশ নিজের দেখাশোনা নিজেই করতে পারে।”

গত ৭০ বছর ধরে অমীমাংসিত ফিলিস্তিন সংকট সেইসঙ্গে সাম্প্রতিক কাশ্মীরের অস্থির পরিস্থিতির উদাহরণ টেনে মিঃ আলী বলেন,

“এটি শুধু রোহিঙ্গাদের বিষয় নয়। যেকোনো দুর্বল জনগোষ্ঠী কোন সবল জনগোষ্ঠীর বিপক্ষে উঠে দাঁড়ায়, তখন তাদেরকে কেউই সমর্থন করেনা বা সমর্থন করলেও অতি সীমিত সমর্থন করে। তেমনি বাংলাদেশ বা রোহিঙ্গা কারও ব্যাপারেই কোন রাষ্ট্র নিজের স্বার্থ বাদ দিয়ে অন্য রাষ্ট্রকে সমর্থন করতে যাবেনা।”

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন