প্রত্যাবাসনে প্রস্তুত বাংলাদেশ

রোহিঙ্গা সঙ্কটের ৩ বছরেও থমকে আছে প্রত্যাবাসন!

fec-image

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সঙ্কটের ৩ বছর পূর্ণ হচ্ছে মঙ্গলবার (২৫ আগস্ট)। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা-নির্যাতনের শিকার হয়ে টেকনাফের ১২টি পয়েন্ট দিয়ে প্রাণ ভয়ে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গারা। তারা আশ্রয় নেয় উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার ৩৪টি আশ্রয় শিবিরে।

সরকারি হিসাব মতে, প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে বায়োমেট্টিক নিবন্ধন করা হয়েছে। বর্তমানে উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস করছে রোহিঙ্গারা। সবকিছু হিসেব অনুযায়ী সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে পরিণত হয় উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প।

আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে মাঝে মধ্যে বেশ তোড়জোড় হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি এখন পর্যন্ত। শুধু চুক্তি আর চিঠি আদান-প্রদানেই রয়ে গেছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন।

রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসনের পরিবর্তে বারবার উপহার দিচ্ছে বাংলাদেশী লাশ। ইতোমধ্যে ২০১৮ সালের ২১ নভেম্বর ও ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসের প্রক্রিয়া বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সম্পন্ন করলেও রোহিঙ্গারা যেতে রাজি না হওয়ায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ভেস্তে যায়। এতে করে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে যায় স্থানীয়রা। যার ফলে উখিয়া-টেকনাফসহ পুরো জেলায় নানামূখি সমস্যায় জর্জরিত হয়ে উঠেছে।

এভাবে চলতে থাকলে স্থানীয়দের চলাচলে চরম অস্থিরতা দেখা দিবে। বিপর্যয়ে পড়বে সাধারণ মানুষ। এখন পর্যন্ত কক্সবাজার-টেকনাফ-উখিয়া সড়কের কাহিল অবস্থা, শ্রমবাজার রোহিঙ্গাদের দখল ও সমস্ত পণ্যের দাম আকাশচুম্বি হয়ে উঠেছে। বলতে গেলে-রোহিঙ্গাদের দখলে চলে গেছে সবকিছু। তাদের কারনে বেড়েছে মাদক পাচার।

স্থানীয়দের দাবি, বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার চাপ সামলাতে ইতোমধ্যে সামাজিক, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যয় ঘটেছে। খুব দ্রুত রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ারও সম্ভাবনা নেই।

এ অবস্থায় উখিয়া-টেকনাফের জন্য আরো বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে বলে মনে করে সচেতন মহল। তাদের দাবি, দ্রুত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

বন বিভাগ সত্রে জানা গেছে, নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে প্রায় ১১/১২ হাজার একর বনভূমিতে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প বিস্তৃত হয়েছে। রোহিঙ্গারা আসার পর থেকে পাহাড়, জঙ্গল সংরক্ষিত বনভূমি সবকিছুর বিশাল ক্ষতি হয়েছে। রোহিঙ্গারা যদি দীর্ঘমেয়াদি হয় তাহলে কক্সবাজার জেলার পরিবেশ, জীববৈচিত্রসহ আনুষাঙ্গিক অনেক কিছুর জন্য সমস্যা হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে তাদের অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী হলে নিরাপত্তা, রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংকটের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। কিন্তু কুটনৈতিক জটিলতা আর কোভিড ১৯ পরিস্থিতির কারণে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসন কখন শুরু হবে তাও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

উখিয়া-টেকনাফের প্রায় সাত হাজার একর গভীর বনাঞ্চলে ৩৪ ক্যাম্পে বর্তমানে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। ইউএনএইচসিআর-এর তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এসব রোহিঙ্গাদের খাদ্য চিকিৎসাসহ বিভিন্ন সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।

সরকারের পক্ষ থেকে শরনার্থী ত্রান ও প্রত্যাবাসন কমিশন অফিস ৩৪টি শরনার্থী শিবির প্রশাসনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। প্রায় এক মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর বাংলাদেশ সরকার প্রথমে মিয়ানমারের সাথে দ্বি-পাক্ষিক বৈঠকের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়।

ইতোমধ্যে দু’দফা তারিখ দিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের চেষ্টা চালিয়েও রোহিঙ্গাদের অমড় মনোভাবের কারণে প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়নি। রোহিঙ্গাদের দাবি তাদের অধিকার ফিরিয়ে না দিলে তারা মিয়ানমারে ফিরে যাবেনা।

অপরদিকে উখিয়া ও টেকনাফে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা বসবাসের কারণে পরিবেশ প্রতিবেশগত নানা সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যেও সামাজিক অর্থনৈতিক কারণে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি হচ্ছে। তাই যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফিরে যাক এটাই কামনা স্থানীয়দের।

রোহিঙ্গাদের মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি জোরদার করার জন্য জাতিসংঘ, আইএনজিও এবং সরকারের কাছে সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে কক্সবাজার সিএসও এনজিও ফোরাম (সিসিএনএফ)।

শরনার্থী ত্রান ও প্রত্যাবাসন কমিশন অফিস সূত্র জানায়, ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনে সময় লেগেছিলো ১০ বছর।

মঙ্গলবার (২৫ আগস্ট) যদি ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর প্রত্যাবাসন শুরুও হয়, তবে তা সম্পন্ন হতে এক দশকেরও বেশি সময় লাগবে, তাই এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে অলস অবস্থায় রাখা উচিত নয়।

তাদের মানবিক মর্যাদার সুবিধার্থে তাদের জন্য সহজে বহন ও স্থানান্তরযোগ্য ঘর, শিক্ষা, উপার্জনমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত।

সিসিএনএফ রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায় স্থানীয়দের অংশ গ্রহণ, খরচ কমিয়ে আনা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে ১১ দফা সুপারিশমালার পুনরুল্লেখ করেন সিসিএএনএফ।

সেগুলো হলো:

(১) সরকারের নেতৃত্বাধীন একটি একক ব্যবস্থাপনা এবং সকল তহবিল ব্যবস্থাপনার একটি একক চ্যানেল বা মাধ্যম থাকতে হবে।

(২) জাতিসংঘের সংস্থাগুলোকে সরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ করতে হবে, সরকারের বিকল্প সামান্তরাল প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়।

(৩) রোহিঙ্গা শিবিরে ত্রাণ ও মানবিক কর্মীদের যাতায়াত খরচ কমিয়ে আনতে এবং কক্সবাজার শহরের উপর চাপ কমাতে ত্রাণ কর্মসূচিতে সম্পৃত্ত সংস্থাগুলোর কার্যালয় টেকনাফ বা উখিয়া স্থানান্তর করা উচিত।

(৪) শরণার্থীদের জন্য সহজে স্থানান্তরযোগ্য আবাসন, শিক্ষা এবং আয়বর্ধনমূলক প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

(৫) মানবিক এবং ত্রাণ কর্মীদেরকে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে প্রয়োজনে ২৪ ঘণ্টা কার্যক্রম পরিচালনা করার অনুমোদন দেওয়া উচিৎ, যাতে ক্যাম্পগুলোতে মাদক ব্যবসা, মানব পাচার, নারীর প্রতি সহিংসতা এবং বিশেষত উগ্রপন্থী কোনও কার্যক্রম হতে না পারে।

(৬) স্থানীয় এনজিও এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইএসসিজি এবং আরআরসিসি’র সভাগুলোতে এবং জাতীয় টাস্ক ফোর্সে (এনটিএফ) অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে।

(৭) অর্থ সহায়তার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে, ব্যবস্থাপনা খরচ এবং কর্মসূচির খরচ সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা পেতে এ সম্পর্কিত পরিস্কার তথ্য প্রকাশ করতে হবে, যাতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সরাসরি কত খরচ হচ্ছে সে বিষয়ে তথ্য জানা যায় এবং এসব বিষয়ে জনগণের নজরদারি নিশ্চিত হতে পারে।

ডিসেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবারের জন্য প্রতি মাসে প্রায় ৪৪৯ ডলার বরাদ্দ ছিলো এবং সর্বমোট এটি প্রায় ২.৫ বিলিয়ন ডলার।

সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দই উল্লেখ করেছেন যে, জাতিসংঘ মোট অর্থের প্রায় ৬৫%ই খরচ করে তাদের পরিচালন ব্যয় বাবদ।

(৮) বিদেশীদের উপর নির্ভরতা কমাতে স্থানীয়দের কাছে কিভাবে প্রযুক্তি-দক্ষতা স্থানান্তরিত করা হবে তার একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

(৯) স্থানীয় এনজিওদের জন্য একটি বিশেষ তহবিল (পুলড ফান্ড) গঠন করতে হবে এবং মাঠ পর্যায়ের সকল কার্যক্রম স্থানীয় এনজিওদেরকে দিয়ে করতে হবে।

(১০) জাতিসংঘের সমস্ত অঙ্গ সংস্থা এবং আইএনজিওগুলোকে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য সামনে রেখে অংশীদারিত্ব নীতিমালা অনুসরণ করা উচিত, অংশীদারিত্বে স্থানীয় এনজিওদের অগ্রাধিকার দিতে হবে, অংশীদার বাছাই প্রক্রিয়াকে হতে হবে স্বচ্ছ এবং প্রতিযোগিতামূলক।

(১১) আইএনজিওদের কক্সবাজার এবং বাংলাদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা উচিত নয়, তাদের উচিত তাদের নিজ নিজ দেশ থেকে তহবিল সংগ্রহ করা।

টেকনাফের সমাজসেবক ও রাজনীতিবীদ সরওয়ার আলম বলেন, সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য যে নির্দিষ্ট ক্যাম্প করে দিয়েছে, সেখানে সঙ্কুলন না হওয়ায় শত শত রোহিঙ্গা দল বেঁধে রাতের আঁধারে স্থানীয়দের ফসলি জমি এবং পাহাড়ি বন দখল করে জোরপূর্বক ঘর নির্মাণ করছে।

স্থানীয়রা প্রশাসনের কাছে বিচার দিলে বিচার পাচ্ছে না। এ ছাড়া প্রশাসন চেষ্টা করলেও তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না। তারা জেলার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। চালাচ্ছে সন্ত্রাসী কার্যক্রম।

রোহিঙ্গারা গতবছর হ্নীলা জাদিমোরায় স্থানীয় ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা ওমর ফারুককে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। এভাবে তো তাদের লালন পালন করে এদেশে রাখা যাবে না।

পালস’র নির্বাহী পরিচালক এবং সিসিএনএফ’র কো-চেয়ার আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, কক্সবাজারে উন্নয়নের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে।

সরকার জেলায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার প্রকল্প শুরু করেছেন, কিন্তু অনেক প্রত্যাশা ইতোমধ্যে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে।

কক্সবাজার জেলাটি ইতোমধ্যে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যবৃদ্ধি, এবং যোগাযোগের অবকাঠামোর দূরাবস্থাসহ নানা সমস্যায় ভূগছে।

আর তাই রোহিঙ্গাদেরকে মায়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার জন আমাদের সরকার, জাতিসংঘ এবং আইএনজিওসহ সমস্ত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা দ্বিগুণ করতে হবে।

মিয়ানমারের জান্তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া উচিত এবং রোহিঙ্গা এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য মানবিক সহায়তার জন্য অর্থের সংস্থান করা প্রয়োজন।

কোস্ট ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক এবং সিসিএএনএফ’র কো-চেয়ার রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, সিসিএনএফ কক্সবাজারে মানবাধিকার রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে, স্থানীয় এনজিও, স্থানীয় সংগঠন এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো প্রত্যাবসনের পূর্ব পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের মানবিক মর্যাদা সমুন্নত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে এই স্থানীয় এনজিও এবং স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলিকে রোহিঙ্গা সংকট ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে।

কক্সবাজার শরনার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন কমিশনার মাহবুব আলম তালুকদার (যুগ্মসচিব) জানান, বিশ্বব্যপী কোভিড ১৯ পরিস্থিতিতে দ্বি-পাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক কুটনীতিতে ভাটা পড়েছে। তার উপর মিয়ানমারের সাথে রোহিঙ্গা ইস্যুতে দ্বি-পাক্ষিক আলোচনা থমকে আছে।

কুটনৈতিক জটিলতা থাকলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের একনম্বর এবং একমাত্র চাওয়া হলো রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন। মিয়ানমার যখনই চাইবে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে প্রস্তুত রয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: বন বিভাগ, বায়োমেট্টিক নিবন্ধন, মিয়ানমার
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন