লংগদুতে রুনা আক্তার এবং রুবেল চাকমার বিবাহ বিচ্ছেদ

fec-image

রাঙ্গামাটির লংগদুতে চার বছরের বেশি সময় সংসার করার পর বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে রুনা আক্তার এবং রুবেল চাকমার। বাঙালি মুসলিম মেয়ে রুনা আক্তার রুবেল চাকমাকে ভালোবেসে চট্টগ্রাম থেকে গিয়েছিলেন লংগদু উপজেলার আদারকছড়া ইউনিয়নের করল্যাছড়িতে। চাকমা সমাজের রীতিনীতি মেনে বিয়ে করেছিলেন রুবেল চাকমাকে। নিজের নাম বদল করে রেখেছিলেন এনজেলিন চাকমা।

ভালোবাসার বিয়ের সংসারে তাদের ১৫ মাস বয়সী এক ছেলেও আছে। কিন্তু এত কিছুর পরও টেকেনি তাদের বিয়ে-সংসার। শেষ পর্যন্ত ৩০ ডিসেম্বর ২০২২ চূড়ান্তভাবে আলাদা হয়ে যেতে হয়েছে তাদের। চাকমা সমাজের প্রথাগত শালিসে এই ডিভোর্সের সময় রুনা আক্তার (এনজেলিন চাকমা)র দাবি মতে ১ লক্ষ ৪৪ হাজার টাকা প্রদানের নির্দেশ দেয় রুবেল চাকমাকে। শালিসের রায় অনুযায়ী ইতোমধ্যে রুনাকে ১ লক্ষ টাকা প্রদান করেছেন রুবেল চাকমা। বাকি ৪৪ হাজার টাকা আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ দেয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছে। তবে রুনা আক্তার তার ১৫ মাস বয়সী ছেলেকে নিয়ে যেতে চাইলেও রুবেল দিতে রাজি হননি।

এ বিষয়ে রুনা আক্তার জানান, চট্টগ্রামে গার্মেন্টে চাকরি করার সুবাদে রুবেল চাকমার সাথে তার পরিচয় এবং সম্পর্ক তৈরি হয়। পরে তারা কোর্ট ম্যারেজ করেছেন এবং করোনা মহামারির সময় রুবেল চাকমা চাকরি ছেড়ে লংগদুতে গ্রামের বাড়িতে চলে আসায় তার সাথে তিনিও এখানে চলে আসেন।

লংগদুতে আসার কিছু দিন পর থেকেই তাদের মধ্যে শুরু হয় মনোমালিন্য। এর ফলে প্রায়ই তাদের মধ্যে ঝগড়া হতো। রুবেল চাকমার বাবা-মা তাকে সহ্য করতে পারতো না। ছেলেকে উসকানি দিয়ে রুনাকে মারধর করাতো। আগে রুবেল চাকমার মদ খাওয়ার অভ্যাস ছিল না, কিন্তু পরে তার বাবা-মা ছেলেকে মদ খাওয়ার অভ্যাস করায়। আর রুবেল চাকমা মদ খেয়ে মাতলামি করে এবং মাতাল অবস্থায় তাকে মারধর করতো। এসব সহ্য করতে না পেরেই শেষ পর্যন্ত ডিভোর্স নিতে হয়েছে।

তাছাড়া, আগে রুবেল চাকমা ভিতরের কোনো পার্টির সাথে ছিল না। কিন্তু কিছুদিন আগে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকে যোগ দিয়েছে। পার্টির লোকজনও তাকে নিয়মিত মদ খাওয়ার অভ্যাস করায়। তাছাড়া পার্টির লোকজনের তো জীবনের কোনো নিরাপত্তা নাই। যেকোনো দিন যেকেউ গুলি করে মেরে ফেলতে পারে। তাই রুনা আক্তার তার স্বামীর পার্টিতে যোগ দেয়ার বিষয়টিও মানতে পারেননি। সেসব নিয়েও তাদের মধ্যে ঝগড়া হতো।

শুরুতে তাদের ঝগড়াঝাটি হওয়ার পেছনের আরো একটি কারণ জানা যায়। সেটি হলো, ভালোবেসে রুবেল চাকমাকে বিয়ে করার জন্য নিজের ধর্ম পরিবর্তন করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করলেও বাস্তবে চাকমা সমাজের রীতিনীতি-চালচলনের সাথে মানিয়ে চলা রুনার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে, মদ-শূকরের মাংস কোনোভাবেই মেনে নিতে পারতেন না। ফলে নিজের জন্য আলাদা রান্না করে খেতেন। এক পর্যায়ে স্বামী রুবেল চাকমাকে মুসলিম হওয়ার জন্যও পরামর্শ দিয়েছেন। স্বামী রাজি না হওয়ায় অবশেষে নিজে মুসলিম থাকতে চেয়েছেন কিন্তু রুবেল চাকমা এবং তার পরিবার সেটা মেনে নেয়নি। সেকারণেই শেষ পর্যন্ত ডিভোর্স নিতে বাধ্য হয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রুবেল চাকমা জানান, ২০১৯ সালে রুনা আক্তারকে তিনি বিয়ে করেছিলেন সামাজিকভাবে। তবে শুরুতে তিনি এ বিয়েতে রাজি ছিলেন না। চট্টগ্রামে গার্মেন্টে চাকরি করার সময় একই বিল্ডিংয়ে থাকতেন, সেখানেই পরিচয়। সেই বিল্ডিংয়ে রুবেল চাকমার ফুফাত বোনও থাকতেন। একবার তার বোনের সাথে রুনা আক্তার আদারকছড়াতে বেড়াতে এসেছিল। এখানে এসে রুনা আক্তার নিজেকে রুবেল চাকমার স্ত্রী বলে পরিচয় দেন। কিন্তু তখনও তাদের বিয়ে হয়নি এবং রুবেল চাকমা চট্টগ্রামেই ছিলেন।

এই খবর পাহাড়ের ভেতরের সশস্ত্র গ্রুপগুলোর কাছেও চলে যায়। তখন তারা রুবেল চাকমাকে ফোন করে হুমকি দিতে থাকে দ্রুত বিয়ে করার জন্য। তারা বলে, আমাদের অনেক চাকমা মেয়ে বাঙালি ছেলেদের ঘরে চলে যাচ্ছে, আমরা কিছু করতে পারছি না। এখন একটি বাঙালি মেয়ে তোমাকে বিয়ে করতে চাইছে, তুমি কেন রাজি হচ্ছো না। তাছাড়া, লংগদুতে এমন আরো ৩ জন বাঙালি মুসলিম মেয়ে চাকমা ছেলের ঘরে আছে, তাহলে তোমার সমস্যা কী। এসব কারণেই পরে আমি রুনাকে বিয়ে করতে রাজি হই।

কিন্তু বিয়ের পর ৩ মাসও আমাদের সম্পর্ক ভালো ছিল না। সব সময় ঝগড়া লেগে থাকতো। রুনা আমার গায়ে হাত তুলতো, এমনকি আমার মা-বাবাকেও কয়েকবার মেরেছে। এসব নিয়ে বেশ কয়েকবার বিচার-শালিসও হয়েছে। এটা ঠিক যে, কোনো কোনো সময় আমিও তার গায়ে হাত তুলেছি, কিন্তু একটা-দুইটা চড়-থাপ্পড় দেয়া ছাড়া অন্যকিছু করিনি।

শুরুতে আমাকে ভালোবেসে আমাদের খাবার-দাবার সবই সে খেয়েছে। পরে আস্তে আস্তে এসব সহ্য করতো না। আর আমার মদ খাওয়ার ব্যাপারে আমার মা-বাবার কোনো দোষ নেই। এটা আমাদের চাকমাদের সমাজে সবাই খায়, আমিও খাই। একসময় সে আমাকে মুসলিম হওয়ার জন্যও বলেছে, কিন্তু আমি মা-বাবাকে ছেড়ে কীভাবে মুসলিম হবো? আমি তাতে রাজি হইনি। আর তাছাড়া আমি এখন ইউপিডিএফ (গতান্ত্রিক)-এর লংগদু উপজেলার সাধারণ সম্পাদক। আমি এটাও ছাড়তে পারবো না।

ছোট বাচ্চাকে তার মাকে নিয়ে যেতে দেননি কেন জানতে চাইলে রুবেল চাকমা বলেন, আমার ছেলে এখন ভাত খেতে পারে। সে আমার কাছে ভালো আছে। আমি তাকে নিয়ে যেতে দিব না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আদারকছড়া ইউনিয়নের মহিলা মেম্বার স্বরনিকা চাকমা বলেন, শালিসের শুরু থেকে আমি ছিলাম না। পরে যখন জানতে পারলাম, ছেলেকে না দিয়েই তাদের মধ্যে ডিভোর্সের জন্য ১ লাখ ৪৪ হাজার টাকার চুক্তি হয়েছে, তখন আমি স্বাক্ষর করেছি। কিন্তু তাও স্বাক্ষর করেছি সিল ছাড়া। কারণ, এটাকে আমার কাছে অমানবিক মনে হয়েছে। তারা যদি একসাথে থাকতে না পারে, তাহলে আমরা আর কী করতে পারি।

আদারকছড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অজয় চাকমা মিত্র জানান, অনেক দিন থেকেই রুনা এবং রুবেল চাকমার পরিবারে অশান্তি। এটা নিয়ে বেশ কয়েকবার বিচার-সালিশ করতে হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের আর বনিবনা হচ্ছে না। সে কারণেই এই ডিভোর্স হয়েছে।

চাকমাদের মধ্যে ডিভোর্সের নিয়ম সম্পর্কে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান জানান, ছেলে এবং মেয়ে যদি উভয়েই আলাদা হয়ে যেতে চায়, তাহলে পাড়া বা সমাজের মুরুব্বীরা শালিসের মাধ্যমে তাদের আলাদা থাকার নির্দেশ দিয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে মেয়ের যদি কোনো দাবি থাকে তাহলে সেটা ছেলের পক্ষ থেকে দিতে হয়।

 

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন