লকডাউনের কবলে রসালো ফল আনারস: পুঁজি নিয়ে শঙ্কায় চাষী ও পাইকার

fec-image

 খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা প্রকৃতিগতভাবে উচুঁ-নিচু সবুজ পাহাড়ে ঘেরা। এসব পাহাড়কে স্বর্ণের খনি মনে করেন কৃষকরা! আধুনিক চাষাবাদ, কৃষিবিদের পরামর্শ ও কৃষকের স্বদিচ্ছায় পাহাড়ে যা ইচ্ছে তাই ফলানো সম্ভব। ফলে এখানকার উঁচু-নিচু টিলা ভূমির পরতে পরতে সাধারণত চৈত্র-বৈশাখ বা মে-জুন মাসের ফল আনারস। কিন্তু কালের আবর্তে এখন আগাম চাষাবাদে সফলতা পাওয়ায় রসালো ফল আনারস চাষে নজির সৃষ্টি করছে খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি-রামগড়-গুইমারা উপজেলার সর্বত্র। আর এই রসালো ফল চাষাবাদে ৩ উপজেলার অন্তত সহস্রাধিক পরিবার কোন না কোনভাবে এ পেশায় জড়িয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছেন। গত বছরের ন্যায় এবারও বৈশ্বিক মহামারী করোনার লকডাউনে হাট-বাজারে জনস্রোত না থাকা এবং লকডাউন অব্যাহত থাকার আশঙ্কায় পঁচনশীল ফল আনারস নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় রয়েছেন এখানকার চাষী ও পাইকাররা!

সরজমিনে দেখা গেছে, খাগড়াছড়ির প্রবেশদ্বার পাহাড়-সমতলে ঘেরা মানিকছড়ি, রামগড় ও গুইমারার সীমান্তবর্তী এলাকা জুড়ে বিগত কয়েক বছর ধরে পাহাড়ের পরতে পরতে আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি, কৃষিবিদের পরামর্শ ও কৃষকের কঠোর সাধনায়’ অবাধে চাষাবাদ হচ্ছে অনেক গুণে গুনান্বিত রসালো ফল আনারস। আনারসে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন এ, সি, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম ও ফসফরাস। যা মানুষের দেহে পুষ্টির অভাব পুরণ, ওজন নিয়ন্ত্রণ, হাড় গঠন, দাঁত ও মাড়ি এবং চোখের সুরক্ষা, হজম শক্তি বৃদ্ধি, রক্ত জমাটে বাধা দেয়াসহ গরমের তীব্রতা নিরসনে শ্রমজীবী মানুষ এই রসালো ফল খেতে বেশ পছন্দ করেন।

ফলে প্রতি বছর এই মৌসুমে রাজধানী ঢাকা, বাণিজ্য নগরী চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখানকার আনারসে সয়লাব থাকে। আর আনারস ব্যবসাকে ঘিরে খাগড়াছড়ির এই তিন উপজেলায় সহস্রাধিক কৃষক, শতাধিক পাইকার কোটি কোটি টাকা পুঁজি বিনিয়োগ করেন। এবারও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। বরং গত বছরে করোনার লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থ পুষিয়ে নিয়ে এবার আগে-ভাগেই ক্ষেতে রোগ-বালাই প্রতিরোধ ও ভালো ফলন প্রত্যাশায় পুঁজি, শ্রম, আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি অনূকরণ ও কৃষিবিদের পরামর্শে কৃপণতা করেনি কেউ। যার ফলে পাহাড়ের পরতে পরতে সারি সারি ক্ষেতে এখন শোভা পাচ্ছে আনারস আর আনারস।

টানা ৩-৪ মাস আনারস বিক্রি করে অন্তত অর্ধশত কোটি টাকা আয়ের স্বপ্ন দেখছেন এখনকার কৃষক ও পাইকাররা। গত মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে প্রতি পিস আনারস ক্ষেতে (পাইকারী) বিক্রি হয়েছে গড়ে ১৩-১৪ টাকা। প্রতি পিস উৎপাদনে খরচ ৬-৭ টাকা। আর এসব আনারস ঢাকাসহ সমতলে বিক্রি হচ্ছিল গড়ে ২০-২৫ টাকা। কিন্তু এপ্রিল মাসের শুরুতে বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সরকার ঘোষিত লকডাউনে হাঁট-বাজারে ক্রেতার উপস্থিতি কমে যাওয়ায় এবং পচনশীল রসালো ফল আনারস বাজারজাত নিয়ে ব্যাপক ক্ষতির আশংকা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার শ্রমজীবী মানুষ কর্মস্থল ত্যাগ করায় ঢাকার হাঁটে-বাজারে এখন পাহাড়ের আনারসের ছড়াছড়িতে বাজার সয়লাব। ক্রেতা শুন্য বাজারে পাইকাররা আনারস নিয়ে গরাগরি করছে!

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ৫/৭বছর ধরে মানিকছড়ি, রামগড় ও গুইমারার পাহাড়ী(টিলা) পতিত জমিতে হত-দরিদ্র কৃষকরা দলবেঁধে নিজের কিংবা পরের জমি বর্গা নিয়ে দলে দলে আনারস চাষ করে আসছেন। ভাল ফলন ও ন্যায্য দাম পাওয়ায় প্রতি বছরই বাড়ছে চাষীর সংখ্যা। এ বছর তিন উপজেলার প্রায় ১২০ হেক্টর জমিতে দুইশতাধিক কৃষক আনারসের বাগান সৃজন করেছেন। আনারস চাষ লাভজনক হলেও প্রকৃতির ওপর নির্ভর করেই কৃষকের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। যেমন গত বছর করোনার লকডাউনে হাঁট-বাজারে ক্রেতা উপস্থিতি কম থাকায় এবং পচনশীল রসালো ফল আনারস চাষে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখিন হতে হয়েছিল! এবারও তাই ঘটার আশঙ্কা রয়েছে!

এই এলাকার উদীয়মান পাইকার (ব্যবসায়ী) মো. নুর আলম জানান, অনেক আশা-ভরসা নিয়ে নিজের ও অন্যের জমি বর্গা নিয়ে আনারস চাষ এবং অন্যের উৎপাদিত ফল পাইকারী কিনে ব্যবসার উদ্দেশ্যে ২০/২৫ লক্ষ টাকা পুঁজি বিনিয়োগ করেছিলাম। জানি না কপালে কী ঘটতে যাচ্ছে! এই লকডাউন অব্যাহত থাকলে আমার মতো অর্ধশত ব্যক্তি এবং শত শত কৃষক পুঁজি হারিয়ে সর্বস্বান্ত( রাস্তার নামার উপক্রম) হবে!

তিনি আরও জানান, প্রতি একর জমিতে ৩৪/৩৫ হাজার আনারস উৎপাদনে খরচ ২লক্ষ ২০ হাজার থেকে ২ লক্ষ ৪৫ হাজার টাকা। আর ফলন ভালো হলে বিক্রি কমপক্ষে সোয়া ৪ লক্ষ টাকা থেকে সাড়ে ৪ লক্ষ টাকারও অধিক। সরজমিনে প্রতিটি আনারস গড়ে পাইকারী বিক্রি ১৩-১৪ টাকা। যা ঢাকা-চট্টগ্রামে গড়ে বিক্রি ২০-২৫ টাকা। মোট কথা আনারস চাষে ৪৫-৫০% লাভ করা সম্ভব। বর্তমানে এখান থেকে গড়ে প্রতিদিন ১৪/১৫ ট্রাক আনারস রাজধানীসহ সমতলে যায়।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হাসিনুর রহমান বলেন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আনারস চাষে কৃষক এবার আগাম ফলন আনতে সক্ষম হয়েছে। আমরা সাধারণত আধুনিক পরামর্শ ছাড়া কৃষকদের তেমন সহযোগিতা দিতে পারি না। অনেকে কৃষিবীদদের পরামর্শ ছাড়াই গাছ ও ফলে মাত্রাতিরিক্ত হরমোন ব্যবহারের ফলে অকালে-অসময়ে গাছ পরিপক্ক না হয়েই ফল আসতে শুরু করে। তবে এই ফল সু-স্বাদু কম। প্রতিটি গাছ রোপনের পর কমপক্ষে ২২-২৩টি পাতা গজালে তারপর গাছে ফল আসার সময় হয়। ওই সময় যথা নিয়মে হরমোন ব্যবহার করলে এক সাথে গাছে ফল আসে, ফল পরিপক্ক হয় এবং পাকা শুরু করে। এই নিয়ম মেনে পাহাড়ে রসালো ফল আনারস চাষ করলে কৃষকরা অল্প পুঁজিতে অধিক লাভবান হওয়া সম্ভব। তবে এবার অনাবৃষ্টি থাকায় আগাম এবং একযোগেই গাছে আনারস পাকার ধুম পড়েছে। যার ফলে লকডাউন অব্যাহত থাকলে পাহাড়ে আনারস চাষে বিপর্যয় ঘটবে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন