parbattanews

লক্ষ্মীছড়িতে অন্যায় দাবী আদায়ের জিম্মী সাধারণ মানুষ: দূর্বিষহ জনজীবন

Khagrachai-Laxmichari Pic 02

বিশেষ প্রতিবেদক, লক্ষীছড়ি থেকে ফিরে:

খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান সুপার জ্যোতি চাকমার অস্ত্রসহ আটকের ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার ষড়যন্ত্র চলছে। নানা রং দিয়ে নিত্য নতুন ইস্যু সৃষ্টি পায়তারা চলছে। অন্যায় আবদার আদায়ে লক্ষ্মীছড়ির সাধারন পাহাড়িদের দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করছে। আর এ ক্ষেত্রে প্রধান সেনাপতির ভূমিকা পালন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান অংগ্যপ্রু মারমাসহ ইউপিডিএফ সমর্থিত বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধি।

এদিকে কথিত সুপার জ্যোতি মুক্তি সংগ্রাম কমিটির লক্ষ্মীছড়ি বাজার বয়কট ঘোষণার কারণে বাজারের প্রায় আড়াই শতাধিক ব্যবসায়ী পথে বাসার উপক্রম হয়েছে। অদৃশ্য শক্তির বাধার কারণে বাজারে আসতে না পারায় সাধারণ পাহাড়িরা মানবেতর জীবন-যাপন করছে। বিশেষ করে উপজাতীয় বিক্রেতা ও ব্যবসায়ীরা। লক্ষ্মীছড়িতে সরেজমিন ঘুরে ও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সাথে কথা এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, প্রতি রবিবার ও বুধবার লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার একমাত্র ‘লক্ষ্মীছড়ি বাজারটি’ হাট বসে। প্রতি হাটের দিন পাহাড়ি বাঙালি হাজারো ক্রেতা-বিক্রেতার মিলন মেলায় পরিণত হতো বাজারটি।

কিন্তু রবিবার(১৫ জানয়ারি) সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ক্রেতা বিক্রেতার পদচারণায় কোলাহলময় লক্ষ্মীছড়ি বাজারটি শুনশান নীরবতা। হাট বাজারের মূল উপজীব্য প্রান্তিক ক্রেতা বিক্রেতারা বাজারে না আসায় বেকায়দায় পড়েছেন বাজার ফান্ড অনুমোদিত লক্ষীছড়ি বাজারের আড়াই শতাধিক পাহাড়ি-বাঙালি দোকানদার। দোকানিরা পসরা সাজিয়ে বসে থাকলেও প্রান্তিক এলাকার ক্রেতারা বাজারে আসেনি।

বাজার কেন্দ্রিক জনগণ ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ছাড়া বাহির থেকে কোন ক্রেতা বিক্রেতা আসেনি। হাটবারের দিনের সাধারণ পণ্য: কলা, জুমের ফসলসহ অন্যান্য সবজি ও হাঁস মুরগী বিক্রি করতে দেখে যায়নি পাহাড়ীদের।

গত ১ জানুয়ারী মধ্যরাতে অস্ত্রসহ গ্রেফতার হন লক্ষীছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান সুপার জ্যোতি চাকমা। আর তার নি:শর্ত মুক্তিসহ কয়েক দফা দাবী তুলে ৩ জানুয়ারি পুরো জেলায় বাজার বয়কটের ডাক সুপার জ্যোতি মুক্তি সংগ্রাম কমিটি সড়ক অবরোধ এবং একটি নিছক তুচ্ছ ঘটনায় ৪ জানুয়ারি থেকে লক্ষ্মীছড়ি বাজার বয়কট কমিটি নামে পোষ্টার সর্বস্ব একটি সংগঠন। যাদের নৈপথ্যে শক্তির যোগান দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে পাহাড়ের অনিবন্ধিত আঞ্চলিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ) এর বিরুদ্ধে।

দু’টি সংগঠনের মধ্যে সুপার জ্যোতি মুক্তি সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন, লক্ষীছড়ি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অংগ্যপ্রু মারমা, সংরক্ষিত ভাইস ভাইস চেয়ারম্যান বেবী রাণী বসু, দুল্যাতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ত্রিলন চাকমা দয়াধনসহ বেশ কয়েকজন ইউপিডিএফ’র নেতাকর্মী।

গত ৩ জানুয়ারী “নির্বাচিত জুম্ম প্রতিনিধি সংসদ” নাম সংবলিত একটি ই-মেইল থেকে সুপার জ্যোতি মুক্তি সংগ্রাম কমিটি আত্মপ্রকাশ ঘটে।

মূয়রখীল, মঙ্গলপাড়া ও মেজর পাড়া এলাকার বৈদ্যুতিক খুটিঁ, চায়ের দোকান ও বসতবাড়ির সামনে সাটাঁনো হয়েছে “সর্বাত্মকভাবে লক্ষীছড়ি বাজার বয়কট করুন” পোষ্টার। পোষ্টারে গ্রেফতার হওয়া লক্ষীছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সুপার জ্যোতি চাকমাকে ইউপিডিএফ’র ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের প্রতিষ্ঠা সদস্য হিসেবে দাবী করা হয়েছে।

এছাড়া সুপার জ্যোতি চাকমা’র নি:শর্ত মুক্তি, ৩ জানুয়ারী লক্ষীছড়ি বাজারে হামলায় ক্ষতিগ্রস্থদের ক্ষতিপূরণ ও হামলাকারীদের গ্রেফতার ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ বন্ধের দাবী জানানো হয় পোষ্টারে।

লক্ষীছড়ি বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অজিত বিকাশ দত্ত পার্বত্যনিউজকে জানান, লক্ষীছড়ি বাজারে ক্রেতা বিক্রেতা না আসায় অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। বাজারের অধিকাংশ ব্যবসায়ীদের সাথে ভেতরের খুচরা ব্যবসায়ীদের লেনদেন রয়েছে। কিন্তু তারা বাজারে না আসায় অর্থনৈতিক ভাবে অনেক ব্যবসায়ী বেকায়দায় পড়েছেন। অচিরেই এ অচলাবস্থার নিরসন হওয়া দরকার।

লক্ষীছড়ি উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক বিল্লাল হোসেন বেপারী পার্বত্যনিউজকে জানান, ইউপিডিএফ’র ইন্দনেই কুচক্রী একটি মহল বাজার বয়কটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।

লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি ফেরকান হাওলাদার পার্বত্যনিউজকে জানান,মিথ্যা অজুহাতে একটি আঞ্চলিক সংগঠন পাহাড়ি ক্রেতা-বিক্রেতাদের বাজারে আসতে বাধা দিচ্ছে। এতে করে বাজারের ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি দূর্গম এলাকার পাহাড়িরাও সীমাহীন কষ্টে দিন পার করছে।

লক্ষ্মীছড়ি বাজারে দোকান খুলে বসে আসেন, পাহাড়ি ব্যবসায়ী দম্পতি বিন্দাবন চাকমা ও লাল মতি চাকমা। তারা দু’জনে জানান, দোকান খুলে আছি। কিন্তু ক্রেতা নেই। তাই দারুন অভাব-অনটনে দিন পার করছেন তারা। এই দুই দম্পতি দ্রুত এ সংখটের অবসান চান।

নাম প্রকাশ না করা অনুরোধ করে এক ব্যবসায়ী জানান, লক্ষীছড়ি উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান অংগ্যপ্রু মারমা বাজার বয়কটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি প্রশাসনের সামনে ব্যবসায়ীদের পক্ষে কথা বললেও ভেতরে ইউপিডিএফ’র নির্দেশেই বাজার বয়কট কর্মসূচীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

কয়েকজন জনপ্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করে জানান, বাজার বয়কট কর্মসূচীর ডাক অপরাজনৈতিক কৌশল। তাদের ভয়ে জনগণ বাজারে আসতে পারছেন না। এতে করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীরা অত্যন্ত দূর্ভোগে পড়েছেন।

উপজেলা পরিষদ এলাকায় রতন চাকমা নামে এক যুবক জানান, সুপার জ্যোতি চাকমাকে মুক্তি না দেয়া পর্যন্ত জনগণ বাজারে আসবে না। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বাইরের বাজারগুলো থেকে ক্রয় করছেন গ্রামবাসী।

রবিবার দুপুর পৌনে ১ টার দিকে লক্ষ্মীছড়ি বাজারে দেখা হয় উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান অংগ্যপ্রু মারমার সাথে। সাংবাদিকরা তার সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি উপজেলা পরিষদের চায়ের দাওয়াত দেন। বলেন, অফিসে বসে কথা হবে। পরক্ষণে তার কথা মত অফিসে গেলে তাকে আর পাওয়া যায়নি। এর পর দফায় দফায় তার সেল ফোনে কল দিলেও তিনি আর কল রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। একইভাবে কথা বলার চেষ্টা হয় উপজেলা ইউপিডিএফ’র সংগঠক রত্তিম চাকমার সাথে। তিনিও ফোন না ধরায় তার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

লক্ষীছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) মোহাম্মদ আরিফ ইকবাল পার্বত্যনিউজকে জানান, বাজারে আসতে কাউকে বাঁধা দেয়া হয়েছে এমন কোন অভিযোগ শুনা যায়নি।

প্রসঙ্গত, গত ১ জানুয়ারী রাতে অবৈধ অস্ত্র রাখার অভিযোগে লক্ষীছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সুপার জ্যোতি চাকমাকে সরকারি বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে নিরাপত্তা বাহিনী। পরের দিন আদালতের নির্দেশে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। ৪র্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ইউপিডিএফ’র সমর্থনপুষ্ট হয়ে তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন বলে লোকশ্রুতি রয়েছে।

Exit mobile version