parbattanews

শর্ত সাপেক্ষে পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন মেনে নিল পার্বত্য নাগরিক পরিষদ ও বাঙালী ছাত্র পরিষদ

 KHAGRACHARI-LANDCOMMITION+POTO+02.06.2013

বহুল বিতর্কিত পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন-২০১৩ ও  দেশের প্রচলিত ভূমি আইনের মাধ্যমে ভূমি সমস্যা সমাধান প্রসঙ্গে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

সরকার গৃহপালিত দালালদের দিয়ে একটি সমঝোতার নাটক করে দেশবাসীকে ধোঁকা দিয়ে অবৈধ ভূমি কমিশনের বৈধতা দিতে চায়- ওয়াদুদ ভুইয়া

উচ্চ আদালতে রীট করলে সংবিধান অনুযায়ী তা অবৈধ ঘোষিত হয়ে বাতিল হয়ে যাবে- এডভোকেট তাজুল ইসলাম

 মেহেদী হাসান পলাশ:

 পার্বত্য শান্তিচুক্তিকে অসাংবিধানিক দাবী করে হাইকোর্ট এর বিভিন্ন ধারা বাতিল করে দিলেও শান্তিচুক্তির আওতায় সৃষ্ট পার্বত্য ভূমি কমিশন শর্ত সাপেক্ষে মেনে নিল পার্বত্য নাগরিক পরিষদ ও পার্বত্য বাঙালী ছাত্র পরিষদ। বৃহস্পতিবার বিকাল ৩ ঘটিকার সময় রাজধানীর অস্থায়ী কার্যালয়ে পার্বত্য নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও পার্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা এবং উপদেষ্টা মন্ডলীর সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার আলকাছ আল মামুন ভূঁইয়ার সভাপতিত্বে পার্বত্য নাগরিক পরিষদ ও পার্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় ও জেলা নেতৃবৃন্দের সাথে একযৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় বহুল বিতর্কিত পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন-২০১৩ ও দেশের প্রচলিত ভূমি আইনের মাধ্যমে ভূমি সমস্যা সমাধান প্রসঙ্গে আলোচনা করে উক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

উল্লেখ্য, পার্বত্য শান্তিচুক্তির বিভিন্ন ধারাকে বাতিল করে দেয়া হাইকোর্টের রায় উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিতাবস্থায় বিচারাধীন রয়েছে। এ ব্যাপারে পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান, সাবেক এমপি ও খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপি’র সভাপতি ওয়াদুদ ভুইয়া বলেন, পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন একটি অবৈধ, অসাংবিধানিক, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রিয় অখণ্ডতা, উচ্চ আদালতের এখতিয়ার ও সরকারের কর্তৃত্ব বিরোধী সাম্প্রদায়িক কমিশন। এটি একান্তভাবেই প্রত্যাবাশিত উপজাতীয়দের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সংগঠন। এখানে কোনোভাবেই বাঙালীর স্বার্থ সংরক্ষণ সম্ভব নয়। কাজেই বাঙালী তথা সকল দেশপ্রেমিক নাগরিকের দায়িত্ব এর বাতিল দাবী করা । বিশেষ করে পার্বত্য বাঙালীদের তা একমাত্র দাবী হওয়া উচিত। তা না করে এর সংস্কার দাবী করা পার্বত্য ভূমি কমিশনকে শর্ত সাপেক্ষে মেনে নেয়ার সামিল। এটি বাঙালীর আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ও আত্মহত্যার সামিল। ওয়াদুদ ভুইয়া আরো বলেন, আদালত যেখানে পার্বত্য শান্তিচুক্তির অসাংবিধানিক ধারাগুলো বাতিল করে দিয়েছে, সেখানে ভূমি কমিশনও আদালতে অবৈধ হতে বাধ্য। কিন্তু শর্ত সাপেক্ষে আজ যারা অবৈধ ও বাঙালীর অস্তিত্ব বিরোধী ভূমি কমিশনকে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে তারা এই কমিউনিটির প্রতিনিধিত্ব করেনা।

তিনি আরও বলেন, এই একটি ঘটনা থেকেই স্পষ্ট এরা কারা? এরা ভুইফোড় ও সরকারী দালাল। সরকার এই গৃহপালিত দালালদের দিয়ে একটি সমঝোতার নাটক করে দেশবাসীকে ধোঁকা দিয়ে অবৈধ ভূমি কমিশনের বৈধতা দিতে চায়। আমি দেশবাসীকে বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল নির্যাতিত জনগণকে এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক থাকার আহ্বান করছি এবং একই সাথে অবৈধ ভূমি কমিশন বাতিলের দাবীতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।   

এদিকে, শান্তিচুক্তির বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রীটকারী আইনজীবী এডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের সমস্ত ভূখণ্ডের মালিক জনগণ। কিন্তু পার্বত্য ভূমি কমিশনের নামে রাষ্ট্রের একটি বিশেষ ভূখণ্ডের জমির উপর একটি নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর যেভাবে একচ্ছত্র আধিপত্য দেয়া হয়েছে তা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা, কর্তৃত্ব ও সম্পূর্ণরূপে সংবিধান বিরোধী। কাজেই উচ্চ আদালতে রীট করলে সংবিধান অনুযায়ী তা অবৈধ ঘোষিত হয়ে বাতিল হয়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, হাইকোর্টের রায়ে পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ সম্পূর্ণরূপে বাতিল হয়ে গেছে। এছাড়াও জেলা পরিষদের বৈষম্য সৃষ্টিকারী সকল ধারাও বাতিল হয়ে গেছে। কাজেই এই ভূমি কমিশনে বাতিল আঞ্চলিক পরিষদের ও জেলা পরিষদের বাতিল ধারায় আওতায় যেসব পার্টিসিপেশন থাকবে তাও বাতিল বলে গণ্য হবে। তাজুল ইসলাম আরো বলেন, ভূমি কমিশনে বাঙালী সংগঠনগুলো তিনজন বাঙালী সদস্যপদ সৃষ্টি সহ বিভিন্ন শর্ত মানার যে দাবী তুলেছে তা একটি অবৈধ ও অসাংবিধানিক আইনকে বৈধতা দেয়ার শামিল। এটি অবৈধ পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন মেনে নেয়ার শামিল। প্রচলিত ভূমি কমিশন কোনোভাবেই বাঙালীর স্বার্থ সংরক্ষিত হবে না। বাঙালীদের উচিত এটি সম্পূর্ণভাবে বাতিলের দাবী করা। কোনোভাবেই এতে তাদের পার্র্টিসিপেশন করা উচিত নয়।   

 এদিকে বৃহস্পতিবারের আলোচনা সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন – পার্বত্য নাগরিক পরিষদের মহাসচিব- এ্যাডভোকেট এয়াকুব আলী চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক- শেখ আহমেদ রাজু, পার্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত)- জনাব মমিনুল ইসলাম, বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারন সম্পাদক- আক্তার হোসেন, পার্বত্য নাগরিক পরিষদের রাঙ্গামাটি জেলা আহবায়ক বেগম নুরজাহান, পার্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় যুগ্ন সম্পাদক আব্দুল মজিদ, পার্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদ রাঙ্গামাটি জেলা সাধারন সম্পাদক   মোঃ আলমগীর হোসেন,  নাগরিক পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির জনাব কামাল হোসেন, আব্দুল হামিদ রানা ও আতিকুর রহমান প্রমুখ।

 আলোচকবৃন্দ বলেন,  বহুল বিতর্কিত, সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক, পাহাড়ী বাঙ্গালীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারী ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশন আইন-২০১৩ জাতীয় সংসদে চলতি অধিবেশনে পাশ করা হলে সরকার তার ভূমির কর্তৃত্ব হারাবে, পাহাড়ী বাঙ্গালীদের মধ্যে ভয়াবহ সংঘাত সৃষ্টি হবে বলে নেতৃবৃন্দ সভায় আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

 সভায় নেতৃবৃন্দ বলেন, গত ১৮/০৯/১৩ রোজ বুধবার ভূমি মন্ত্রনালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতির আহবানে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে পার্বত্য নাগরিক পরিষদ ও পার্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদ নেতাদের লিখিত ও মৌখিক যে  মতামত পেশ করা হয়েছে তা আমলে না নিয়ে যদি একচেটিয়াভাবে বহুল বিতর্কিত এই ভূমি কমিশন আইন মহান জাতীয় সংসদে পাশ করা হয়, তাহলে নিম্নোক্ত কর্মসূচী পালন করা হবে। কর্মসূচীগুলো হলো-

১। আগামী ২২/০৯/২০১৩ রোজ রবিবার তিন পার্বত্য জেলায় বিক্ষোভ মিছিল ।

২। আগামী ২৪/০৯/২০১৩ রোজ মঙ্গলবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে প্রতীক অনশন কর্মসূচী।

৩। মহান সংসদে উক্ত আইন পাশের পরবর্তী দিন থেকে লাগাতার হরতাল কর্মসূচী পালন করা হবে।

উল্লেখ্য, ১৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে বাঙালী নেতৃবৃন্দ ১০ দফা দাবী তুলে ধরেন। এতে বলা হয়েছে-

১।    পার্বত্যাঞ্চলের ভূমি সংক্রান্ত সকল বিষয়াদি নিরপেক্ষ, পক্ষপাত দুষ্টহীন, গ্রহণযোগ্য এবং দেশের প্রচলিত আইন ও সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তথা সাংঘর্ষিক না হবার লক্ষ্যে একটি গ্রহণযোগ্য আইন প্রনয়ন করা বাঞ্চলীয়। এক্ষেত্রে ভুমি কমিশনের ০২ জন প্রতিনিধি, পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত ০৩ জন বাঙ্গালী ও ০৩ জন জন উপজাতি প্রতিনিধিসহ সুপ্রিম কোর্টের ০২ জন বিজ্ঞ আইনজীবিদের নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য আইন প্রনয়ন কমিটি গঠন করতে হবে।
২।    ভবিষ্যতে দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা প্রশ্নবিদ্ধ কিংবা হুমকির মুখে পড়তে পারে এমন শর্তগুলো বাদ দিয়ে বিদ্যমান মূল আইনের আলোকে একটি আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে। প্রয়োজনে, আইন বিষয়ে দক্ষ বিজ্ঞ দেশী, বিদেশী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ভেটিং সম্পন্ন পূর্বক আইনটিকে যুগোপযোগী করা যেতে পারে।
৩।    ধারা ৬(ক)-তে অবৈধ বন্দোবস্ত ও প্রচলিত আইন, রীতি ও প্রথা শব্দগুলি (হিলট্রেক্ট ম্যানুয়েল-১৯০০) বাতিল করতে হবে।
৪।    কোন মহলের দুরভিসন্ধি বাস্তবায়নের কোন শর্ত ভুমি কমিশন কর্তৃক সংযুক্ত করা হয়ে থাকলে তা সংশোধনের সুযোগ রাখতে হবে।
৫।    সকল ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্থ এবং সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তির সুবিচারের সুযোগ তথা আপিলের সুযোগ রাখতে হবে।
৬।    কমিশনের বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তে পৌছাতে না পারার ক্ষেত্রে চেয়ারম্যানের একক ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষমতাকে মূল আইন অনুযায়ী বহাল রাখতে হবে।
৭।    সংশোধিত আইনটি সংসদে পাশ করার পূর্বে একটি শক্তিশালী ও বিশেষজ্ঞ কমিটি দ্বারা সম্পূর্ণরুপে ভেটিং করানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
৮।    বাঙ্গালীদের ভুমি অধিকারের বিষয়টি বিবেচনাপূর্বক ভূমি ব্যবস্থাপনায় বৈষম্যমুক্ত একটি গ্রহণযোগ্য আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সেনা বাহিনী ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের দীর্ঘ দিনের লব্দ অভিজ্ঞতাকে মূল্যায়ন পূর্বক বিলটি পর্যালোচনা এবং চূড়ান্ত করার কাজে একটি কমিটি গঠন করা হলে তাতে বর্ণিত ২টি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি রাখা যেতে পারে।
৯।    বাস্তবতার আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির কিছু সাংঘর্ষিক ধারাকে যুগোপযোগী করার জন্য একটি জাতীয় কমিটি গঠনের মাধ্যমে বিদ্যমান পার্বত্য বাঙ্গালী ও উপজাতীয়দের মনস্তাত্বিক দ্বন্দ্ব প্রশমনে একটি কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।
১০।    উক্ত আইন পাশ হলে এটি সংবিধান পরিপন্থি হবে এবং পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর স্বার্থ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। ফলে অস্তিত্বের সংকটে পড়ে বাঙ্গালী অধিবাসীগণ উপজাতীয়দের সাথে ব্যাপক সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে। ফলে অত্রাঞ্চলে উপজাতি-বাঙ্গালী সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টি হবার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যাবে তথা পরিস্থিতি চরম অস্তিতিশীল হয়ে পড়বে এবং সীমাহীন রক্তপাত ঘটবে। যা পরিহার করার জন্য এখনই সর্বজনগৃহীত একটি আইন পাশ করা যেতে পারে।

এ দাবীর ২-৭ ধারাগুলো শর্ত সাপেক্ষে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন মেনে নেয়ার শামিল বলে সচেতন মহল মনে করে। এদিকে বাঙালী ছাত্র পরিষদের জেলা পর্যায়ের অনেক নেতৃবৃন্দ নাম প্রকাশ না করার শর্তে পার্বত্য নিউজকে জানিয়েছেন, কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্ত তাদেরকে বিস্মিত, হতবাক ও মর্মাহত করেছে। তারা এই সিদ্ধান্তের সাথে একমত নয়। তারাও ভূমি কমিশনের সম্পূর্ণ বাতিল চায়।

Exit mobile version