শান্তিচুক্তির দুইযুগ: শীতার্ত পাহাড়ে ‘সমুখে শান্তি পারাবার’

fec-image

ক্যালেন্ডার নির্ধারিত ঋতুচক্রের হিসাবে নয়, পাহাড়ে শীত নামে প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মে। নভেম্বর (২০২১)-এর শেষে চলছে অগ্রহায়ণ মানে মধ্য হেমন্ত। শহরে শীত ‘আসি আসি’ করলেও পাহাড়, ঝরনা, ঝিরি ও কৃত্রিম লেক সমৃদ্ধ পার্বত্য জনপদ দস্তুরমত শীতকাতুরে হয়ে রয়েছে। বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামের শীতার্ত পাহাড়ি প্রকৃতির সবুজে-শ্যামলে আচ্ছাদিত অবয়ব দেখে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের গানের কলি: ‘সমুখে শান্তি পারাবার’। যেন, ৩৬০ ডিগ্রি উন্মুক্ত দিগন্তের পুরোটাই পার্বত্য সবুজের অতলান্ত শান্তির নকশি চাদরে জড়ানো।

সামনেই ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্পর্শ করবে দুইযুগ। দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী-ভ্রাতৃঘাতী সশস্ত্র সন্ত্রাস ও হিংসার অবসানে শান্তিচুক্তি পাহাড়ে এনেছে শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের বাতাবরণ। যোগাযোগ, শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি, স্বাস্থ্য ইত্যাদি মানবিকভাবে অতি প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে এসেছে ইতিবাচক রূপান্তর।

রাঙামাটির প্রত্যন্ত গ্রামে থেকেও করোনাকালের সঙ্কুল পরিস্থিতিতে অনলাইনে ক্লাস করতে পেরেছে পাপিয়া চাকমা। বিগত প্রায় দেড় বছর ক্যাম্পাসে না গিয়েও সচল থেকেছে তার শিক্ষাজীবনের যাবতীয় কার্যক্রম। বিদ্যুৎ, ইন্টারনেটের অকল্পনীয় সুযোগ পেয়ে উদ্ভাসিত পাপিয়ার মতো পার্বত্য তারুণ্য।

রাস্তা নির্মিত হয়েছে দুর্গম ও বিপদ সঙ্কুল প্রাকৃতিক পরিবেশকে জয় করে। খাগড়াছড়ির পর্যটকস্থল সাজেকের পথে মসৃণে পথে সহজ যাতায়তের সুবিধা পাচ্ছেন অসংখ্য ভ্রমণ পিয়াসু মানুষ। দেখতে পাচ্ছেন পার্বত্য সৌন্দর্যের অদেখা ভূগোল।

কত অনিন্দ্য সুন্দর জায়গা আছে পাহাড়ের কোণে কোণে, তা বলে শেষ করা যাবে না। খাগড়াছড়ির আলুটিলা, আলুটিলা গুহা, কমলক ঝর্ণা, কেন্দ্রীয় শাহী জামে মসজিদ, তকবাক হাকর (গুহা), তৈদুছড়া ঝর্ণা, দীঘিনালা ঝুলন্ত ব্রিজ, পানছড়ি রাবার ড্যাম, পুরাতন চা বাগান, রিছাং ঝর্ণা এবং আরো কতকিছু। রাঙামাটিতে লেক, সেতু, বনানীর অপরূপ সৌন্দর্যের তুলনা নেই। বান্দরবানের শৈল শিখর চিম্বুক, উপত্যকা-সদৃশ্য থানচী, বগা লেক প্রাকৃতিক শোভার অবারিত জগতের মতো।

যোগাযোগের সুবিধার জন্য পর্যটনের মতোই উৎপন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে কৃষক উৎপাদনকারীর। বেড়েছে বিপণনের সুবিধা। শিশুদের স্কুলে যাওয়া, স্বাস্থ্য ও নানাবিধ সুযোগ চলে এসেছে হাতের নাগালের মধ্যে। কথা হলে এমন অভিব্যক্তিই রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানের সাধারণ মানুষের মুখে।

শান্তিচুক্তির প্রধান অর্জন দীর্ঘ সংঘাত ও সশস্ত্র নাশকতার অবসান। শান্তি, সম্প্রীতি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের বাতাবরণ তৈরি করেছে শান্তিচুক্তি। ‘চুক্তির আগে ও পরের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। সর্বক্ষেত্রে পাঁচগুণ এগিয়েছে পার্বত্যাঞ্চল। রাস্তাঘাটের পরিমাণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের সংখ্যায় তা স্পষ্ট’, বললেন পাহাড়ের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী উপেন্দ্র ত্রিপুরা।

পাহাড়ি-বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্য আগের চেয়ে বেশি আস্থা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসকারী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতারা। তাদের মতে, ‘পাহাড়ের বাসিন্দারা আগের চেয়ে শান্তিতে আছে।’

তবে, প্রায়শই প্রত্যন্ত পাহাড়ের দুর্গম অঞ্চলে বিভিন্ন অস্ত্রধারী গোষ্ঠীর অপতৎপরতার ঘটনা ঘটছে। হত্যা, খুন, গুম, অপহরণ, চাঁদাবাজি পাহাড়ের শান্তি বিনষ্ট করছে। কোনো কোনো মহল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি হানিকর কাজ করছে। অস্ত্রধারী গ্রুপগুলোর নিজের অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ঘটনায় বিষিয়ে উঠছে শান্তির পরিবেশ।

সর্বশেষ একটি সন্ত্রাসী ঘটনায় রাঙামাটির সদর উপজেলাধীন বন্দুকভাঙ্গা এলাকায় প্রতিপক্ষ স্বজাতীয় পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের গুলিতে জেএসএস-এর আবিষ্কার চাকমা (৪০) নিহত হয়েছেন। নিহতের বাড়ি বাঘাইছড়ির সারোয়াতলী ইউনিয়নের সিজক এলাকায়। তার পিতা মিন্টু চাকমা ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। মঙ্গলবার (৩০ নভেম্বর) ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনকালীন প্রতিপক্ষের অতর্কিত সশস্ত্র হামলায় আবিষ্কার চাকমা নিহত হন। তিনি সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস এর শীর্ষ পর্যায়ের নেতা এবং একাধিক মামলার আসামি বলে স্থানীয় ও নিরাপত্তা বাহিনীর দায়িত্ব্শীল সূত্রে জানা গেছে।

এইসব অনাকাঙ্ক্ষিত সশস্ত্র ও রক্তক্ষয়ী ঘটনায় পার্বত্যাঞ্চলের শান্তি, সম্প্রীতি ও নিরাপত্তা নিয়ে তৈরি হচ্ছে সঙ্কটের ঘূর্নাবর্ত। যদিও এইসব ঘটনা বিচ্ছিন্ন, তথাপি বৃহত্তর পাহাড়ের সর্বস্তরের বাসিন্দাদের মধ্যে আস্থা ও নিরাপত্তার মনোভাব সুসংহত রাখার প্রয়োজনে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য। আশাবাদী মানুষ সন্ত্রাস ও সংঘাত নয়, চায় শান্তি, সমৃদ্ধি, সম্প্রীতি, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন। যেমনটি ধ্বনিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের অম্লান সঙ্গীতের চিরায়ত বাণীতে: ‘সমুখে শান্তিপারাবার/ভাসাও তরণী হে কর্ণধার/ তুমি হবে চিরসাথি/লও লও হে ক্রোড় পাতি/অসীমের পথে জ্বলিবে জ্যোতি ধ্রুবতারকার/মুক্তিদাতা, তোমার ক্ষমা তোমার দয়া/হবে চিরপাথেয় চিরযাত্রার/হয় যেন মর্তের বন্ধনক্ষয়/বিরাট বিশ্ব বাহু মেলি লয়/পায় অন্তরে নির্ভয় পরিচয়/মহা-অজানার।’

ফলে শান্তির জন্য কর্ণধার রূপে মানুষকেই স্ব স্ব অবস্থান থেকে সচেষ্ট হতে হবে, শুভবোধের সম্মিলিত শক্তিতে এগিয়ে আসতে হবে শান্তির মহাসড়কে।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন