parbattanews

শান্তিচুক্তির পরের কথা: রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া

Untitled-110

সাত.
এ চুক্তি দীর্ঘদিন যাবত অত্রাঞ্চলে বিরাজমান অস্থিরতা ও অরাজকতা দূর করবে বলে সমগ্র দেশবাসী আশায় বুক বেঁধেছিল। কিন্তু তাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এর পেছনে দায়ী পুরনো অপরাধী গোষ্ঠীর দুর্বৃত্তপূর্ণ মনোভাব এবং অসৎ নেতৃত্ব। এ চুক্তিতে দেশের সংবিধানকে লংঘন করে দেশের সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে, পার্বত্য অঞ্চলের স্থায়ীভাবে বসবাসরত প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী বাঙ্গালিদের সাংবিধানিক মৌলিক নাগরিক অধিকারকে মারাত্মকভাবে হরণ করা হয়েছে। সে কারণেই এই কালো চুক্তি স্বাক্ষরের দিনই সমগ্র পার্বত্য অঞ্চলসহ গোটা দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠে।

যার ফলে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো এ চুক্তিকে সাথে সাথেই প্রত্যাখ্যান করেছে। ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ তারিখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সম্পাদিত চুক্তি সম্পর্কে ৩ ডিসেম্বর জামায়াতের কেন্দ্রীয় অফিসে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক সংসদীয় দলের নেতা মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী নিম্নোক্ত বক্তব্য পেশ করেন-

“প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
আজ আপনাদের সামনে অত্যন্ত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা নিয়ে উপস্থিত হয়েছি। আপনারা জানেন গতকাল বেলা ১০টা ২৫ মিনিটে বাংলাদেশ সরকারের সাথে আধিপত্যবাদী ভারতের মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী তথাকথিত শান্তিবাহিনী তথা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে বাংলাদেশের সংবিধান, স্বাধীনতা ও তথা জাতীয় স্বার্থবিরোধী এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। আমরা আমাদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে গতকালই নির্বাহী পরিষদের জরুরি বৈঠক থেকে এক প্রস্তাবের মাধ্যমে জাতিকে চুক্তি সম্পর্কে অবহিত করার চেষ্টা করেছি।
চুক্তির ভূমিকায় “বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার প্রতি পূর্ণ ও অবিচল আনুগত্য রাখিয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বারান্বিত করা এবং বাংলাদেশের সকল নাগরিকের স্ব-স্ব অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে” মর্মে যে সব কথিকা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তা দেশবাসীর সাথে নির্লজ্জ প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা চুক্তিতে এর সম্পূর্ণ বিপরীত জিনিসই রয়েছে।
চুক্তির সাধারণ অধ্যায়ে উভয় পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করার বিষয়টি মোটেই সত্য নয়। ১৮৯০ সালে বৃটিশ সরকার কর্তৃক প্রণীত ম্যানুয়েলে চাকমাদের সেটেলার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আসলে ঐ এলাকায় বসবাসরত বাংলাবাসী জনগণ এবং অন্যান্য কিছু উপ-জাতিরাই আদিবাসী। বাংলাদেশের ইউনিটারী সিস্টেমের সংবিধানে কোন এলাকাকে কোন বিশেষ ধরনের উপজাতি বা গোষ্ঠীর জন্য নির্ধারিত করার কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া তথাকথিত শান্তিচুক্তিতে জনসংহতি সমিতিকে যেসব অধিকার ও কর্তৃত্ব দেয়া হয়েছে তাতে বাংলাদেশের সংবিধানের মর্যাদাকে ভুলুণ্ঠিত করা হয়েছে। জনগণের নির্বাচিত সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী সংস্থা জাতীয় সংসদকেও চ্যালেঞ্জ করার অধিকার দেয়া হয়েছে তথাকথিত জনসংহতি সমিতিকে। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদেরকে এমন ক্ষমতাও দেয়া হয়েছে তা কোন হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। অর্থাৎ সর্বোচ্চ আদালতের মর্যাদাও জনসংহতি সমিতির কাছে ভুলুণ্ঠিত করা হয়েছে। প্রবিধান ও প্রজ্ঞাপন জারির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ সরকারের চাইতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ক্ষমতা বেশি বলে চুক্তিতে পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে।

সশস্ত্র চাকমা বিদ্রোহীদের সাথে স্বাক্ষরিত তথাকথিত এই শান্তিচুক্তি একটি আত্মঘাতী চুক্তি এবং এর পরিণতিতে বাংলাদেশের একদশমাংশ এলাকা হাত ছাড়া হবে এবং উপজাতীয়দের বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার পথ প্রশস্ত হবে। এতটা নতজানু হয়ে একটি স্বাধীন দেশের সরকার দেশের এতবড় সর্বনাশ কি করে করতে পারলো তা আমাদের কাছে রীতিমত বিস্ময়ের ব্যাপার।
আওয়ামী লীগ সরকার এই চুক্তির মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় মর্যাদাক্ষুণ্ন করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার ও অস্ত্রধারী চাকমা বিদ্রোহীদের সংগঠন জনসংহতি সমিতিকে চুক্তির মাধ্যমে একই মর্যাদায় আসীন করা হয়েছে। প্রতিবেশি ভারতকে সন্তুষ্ট করার জন্য হোক অথবা তাদের চাপেই হোক চুক্তির ফাঁদে পা দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের সর্বনাশ করেছে এবং এ ধরনের একটি জাতীয় স্বার্থ বিরোধী, ভয়ানক চুক্তি বাংলাদেশের জনগণ মেনে নিতে পারে না।
চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের শতকরা ৫০% ভাগ অউপজাতীয়দেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে। এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কার্যতঃ কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। এই চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপজাতীয় অধ্যুষিত এলাকা স্বীকার করে প্রকারান্তরে অঘোষিত জুম্মল্যান্ডে এবং শেষ পরিণতিতে চাকমাল্যান্ড প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথকেই প্রশস্ত করা হয়েছে।
জনসংহতি সমিতির সাথে সম্পাদিত এই চুক্তি বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত অধ্যায়ের সাথে সাংঘর্ষিক এবং সরাসরি সংবিধানের ৩৬নং অনুচ্ছেদের খেলাপ-যেখানে বলা হয়েছে “জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংঙ্গত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা ইহার যে কোন স্থানে বসবাস ও বসতি স্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।”
সম্পাদিত চুক্তির (খ) অধ্যায়ে বর্ণিত ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩২ ধারায় কার্যতঃ সংবিধান ও রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন ক্ষমতা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। চুক্তির ’খ’ অধ্যায় ২৪, ২৬, ২৭ নং ধারায় “আপাতত” বলবৎ অন্য কোন আইনে যাহা কিছু থাকুক না কেন, অংশটি সংযোজিত করে চুক্তিকে সংবিধানের উপরে স্থান দেয়া হয়েছে। সংবিধানে বর্ণিত পদ্ধতিতে সংবিধান পরিবর্তন বা সংশোধন না করে কোন সরকারই এই অসাংবিধানিক কাজ করতে পারে না।
চুক্তির ২৮ নং ধারায়, “পরিষদ এবং সরকারি কর্তৃপক্ষের কার্যাবলীর মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজন দেখা দিলে সরকার বা পরিষদ নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করিবে এবং পরিষদ ও সরকারের মধ্যে পারস্পরিক  যোগাযোগের মাধ্যমে কাজের সমন্বয় বিধান করা যাইবে” শব্দগুলি দ্বারা বাংলাদেশ সরকার এবং পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদকে একই মর্যাদায় স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।
চুক্তির ২৯ ধারায়, “এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা পরিষদের সাথে আলোচনাক্রমে বিধি প্রণয়ন করিতে পারিবে এবং কোন বিধি প্রণীত হওয়ার পরেও উক্ত বিধি পুনঃবিবেচনার্থে পরিষদ কর্তৃক সরকারের নিকট আবেদন করিবার বিশেষ অধিকার থাকিবে।” এখানে উল্লেখ্য যে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিধি প্রণয়ন করার পরও বিধি পরিবর্তন বা পুর্নবিবেচনা করার জন্য আবেদনের বিশেষ অধিকারের মাধ্যমে পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদকে কার্যতঃ সরকারের চাইতেও বেশী মর্যাদা এবং ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।
চুক্তির ৩০নং ধারায়, ”সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে” শব্দগুলি বিলুপ্ত এবং তৃতীয় পংক্তিতে অবহিত “করিতে পারিবে” এই  শব্দগুলির পরিবর্তে নিম্নোক্ত অংশটুকু সন্নিবেশিত করা হইবেঃ তবে শর্ত থাকে যে, প্রণীত প্রবিধানের কোন অংশ সম্পর্কে সরকার যদি মতভিন্নতা পোষণ করে তাহা হইলে সরকার উক্ত প্রবিধান সংশোধনের জন্য পরামর্শ দিতে বা অনুশাসন করিতে পারিবে” এই ধারার মাধ্যমে পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদকে সরকারের অনুমোদন ছাড়াই প্রবিধান জারির ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। পরে কোন ব্যাপারে সরকার মতভিন্নতা পোষণ করলে পরামর্শ বা অনুশাসনের পদক্ষেপের পর পূর্বধারায় পরিষদকে যে মর্যাদা দেয়া হয়েছে তাতে তারা সেই পরামর্শ বা অনুশাসন মেনে না নিলে সরকার শেষ পর্যন্ত অসহায় হয়ে পড়বে, যা দেশের অখণ্ডত্বের জন্য হবে মারাত্মক।
৩২নং ধারায় “পার্বত্য জেলায় প্রযোজ্য জাতীয় সংসদ বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গৃহীত কোন আইন পরিষদের বিবেচনায় উক্ত জেলার জন্য কষ্টকর হইলে বা উপজাতীয়দের জন্য আপত্তিকর হইলে পরিষদ উহা কষ্টকর বা আপত্তিকর হওয়ার কারণ ব্যক্ত করিয়া আইনটির সংশোধন বা প্রয়োগ শিথিল করিবার জন্য সরকারের নিকট লিখিত আবেদন পেশ করিতে পারিবে এবং সরকার এই আবেদন অনুযায়ী প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করিতে পারিবে।” এই ধারায় জাতীয় সংসদকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদকে। একটি স্বাধীন দেশের আইন প্রণয়নকারী সংস্থাকে এমন ক্ষমতাহীন ও অমর্যাদা বেগম সরকার করতে পারে কি?
স্থায়ী সেনানিবাস (তিন জেলা সদরে ৩টি এবং আলী কদম, রুমা ও দীঘিনালা) ব্যতীত সামরিক বাহিনী, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সকল অস্থায়ী ক্যাম্প” প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অর্থাৎ দুর্গম পার্বত্য এলাকার ৭০টি ক্যাম্পসহ ৫৪৭টি সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করে আওয়ামী লীগ সরকার কার্যতঃ পার্বত্য চট্টগ্রামকে সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে দিচ্ছে এবং প্রতিবেশী আগ্রাসী ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয় এতদিন আমাদের স্বাধীনতার অতন্দ্রপ্রহরী সেনাবাহিনী চরম কষ্ট সহ্য করে অনেক জীবন ও রক্তের বিনিময়ে দেশের অখণ্ডতা ও নিরাপত্তা যেভাবে নিশ্চিত রেখেছিল তার প্রতিও উল্লেখিত চরম অসম্মান প্রদর্শন করেছে। তাদেরকে ক্যান্টনমেন্টে সীমাবদ্ধ রেখে কার্যতঃ পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ এবং জেলা পরিষদে নেতৃত্বদানকারী সেনাবাহিনীর সদস্যদের হত্যাকারীদের হাতে করুণার পাত্র বানানো হয়েছে।
সামগ্রিকভাবে উল্লেখিত চুক্তিটি বাংলাদেশের সংবিধান, স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা এবং জাতীয় স্বার্থ বিরোধী এবং এ চুক্তি দেশের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র।
জামায়াতে ইসলামি মনে করে দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা এবং জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নের আপোষহীন এবং তারা এই চুক্তি ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যান করছে এবং দেশপ্রেমিক জনগণ দেশের স্বাধীনতা ও অখণ্ডতা যে কোন মূল্যে রক্ষার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ।”

সংবিধান, দেশের স্বাধীনতা ও অখণ্ডতা বিরোধী চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে আজ বিকেলে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সকল জেলা শাখা বিক্ষোভ প্রদর্শন করবে। বিএনপিসহ অন্যান্য দলের সাথে পরামর্শ করে অন্যান্য কর্মসূচি দেয়া হবে।”

পার্বত্য চুক্তি সম্পর্কে বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া বেশ জোরালো বক্তব্য দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ক্ষমতায় আসলে তা বাতিল করা হবে।’  খালেদা জিয়া তাঁর বক্তেব্যে ১৮ দফা অভিযোগ করেছিলেন। অবশ্য এর জবাবও তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। ৭ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার আপত্তিওয়ারী জবাব তুলে ধরেন।

বিএনপির বক্তব্য ছিল, এই চুক্তির মাধ্যমে এই সরকার বাংলাদেশের এক-দশমাংশ অঞ্চল হতে স্বাধীন-সার্বভৌম এককেন্দ্রিক ক্ষমতা প্রত্যাহার করে একটি দেশের সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিয়েছে এবং স্বাধীনতার সঙ্কট সৃষ্টি করেছে।
হাসিনার ব্যাখ্যাঃ অভিযোগটি সর্বতোভাবে সত্যবিবর্জিত এবং অপপ্রচার। অভিযোগটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও অযৌক্তিকও বটে। কেননা, সংবিধানের আওতায় এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং বাংলাদেশের অখন্ডতা, সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও সংবিধানের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ও আস্থা রেখেই এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।

বিএনপিঃ এই চুক্তির মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশে বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ‘বিষবৃক্ষ’ রোপিত হয়েছে।
হাসিনার ব্যাখ্যাঃ এটি একটি অস্পষ্ট, অনির্দিষ্ট ও অপপ্রচারমূলক অভিযোগ। বরং এ চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গোষ্ঠী, জাতি ও জাতিসত্তার মধ্যে বিরাজমান বিভেদ দূরীভূত হবে এবং বিচ্ছিন্নতাবাদের অবসান ঘটবে। শান্তিবাহিনীর বৈরী তৎপরতা বন্ধ হবে এবং বিচ্ছিন্নতাবাদের পরিবর্তে জাতীয় ঐক্য ও উন্নয়ন মূল স্রোতধারায় উপজাতিদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

বিএনপিঃ চুক্তির মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দেওয়া হয়েছে।
হাসিনার ব্যাখ্যাঃ এ বিষয়টা পূর্ব অভিযোগের পুনরাবৃত্তি মাত্র। বিভিন্ন গোষ্ঠী, জাতি ও উপজাতির মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্য জিইয়ে রেখে বেআইনী ফায়দা লোটার অপকৌশল ও অপপ্রয়াস মাত্র।

বিএনপিঃ সংবিধানের ১নং ধারায় বলা আছে, বাংলাদেশ একটি একক স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। সুতরাং সংবিধানের পৃথক কোন আঞ্চলিক পরিষদ বা প্রদেশ করার বিধান নেই। চুক্তির ‘গ’ অধ্যায়ের ১ নং পংক্তিতে যে আঞ্চলিক পরষদ গঠনের বিধান রাখা হয়েছে তা সম্পূর্ণভাবে সংবিধানের ১নং ধারার পরিপন্থী।
হাসিনার ব্যাখ্যাঃ বক্তব্যটি সম্পূর্ণ অজ্ঞতা প্রসূত। সংবিধান সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা আছে এমন কেই এ বক্তব্য রাখতে পারে না। আঞ্চলিক পরিষদ বলতে মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩টি স্থানীয় পরিষদের সমন্বয়কারী সংস্থা। যা আমাদের সংবিধানের পরপন্থী তো নয়ই, বরং সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ৯ ও ১১ নং অনুচ্ছেদ, তৃতীয় ভাগের ২৮(৪) অনুচ্ছেদ ও চতুর্থ ভাগের তৃতীয় পরিচ্ছেদের ৫৯(১) ও ৬০ অনুচ্ছেদের পরিপূরক। সুতরাং অভিযোগটি বিভ্রান্তি ছড়ানোর একটি অপকৌশলমাত্র।

বিএনপিঃ বাংলাদেশের সংবিধানে অঞ্চলভিত্তিক মন্ত্রী নিয়োগের কোন বিধান নেই। চুক্তির মাধ্যমে একটি বিশেষ অঞ্চলের জন্য একটি বিশেষ মন্ত্রী নিয়োগ ও মন্ত্রণালয় সৃষ্টি এবং তাকে সহায়তা করার জন্য নির্দিষ্ট ঐ অঞ্চলভিত্তিক উপদেষ্টা পরিষদ এবং তার অধীনে একটি আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক নির্বাহী ও সর্বময় ক্ষমতার প্রয়োগ বাংলাদেশ সরকারের বিপরীতে একটি সমান্তরাল সরকার গঠনের শামিল বিধায় এই চুক্তি অবৈধ ও গ্রহণযোগ্য নয়।
হাসিনার ব্যাখ্যাঃ সংবিধানে মন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্রে যে সকল শর্তাবলী রয়েছে তা কোনক্রমেই কোন অঞ্চলভিত্তিক মন্ত্রী নিয়োগের পথে অন্তরায় নয়। বিশ্বের অনেক উন্নত ও গণতান্ত্রিক দেশে উপজাতি, আদিবাসী ও অঞ্চল বিশেষের জন্য মন্ত্রণালয় গঠন ও মন্ত্রী নিয়োগের বিধান রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যুক্তরাজ্য, স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ড বিষয়ক মন্ত্রী আছেন, কানাডা ও অষ্ট্রেলিয়ায় আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রী রয়েছেন। এমনকি মরহুম রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান চাকমা রাজমাতা বিনীতা রায়কে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সংখ্যালঘু বিষয়ক উপদেষ্টা (মন্ত্রী) নিয়োগ করেছিলেন। দ্বিতীয় সংবিধানের নবম ভাগের ১ম পরিচ্ছেদের ১৩৬ অনুচ্ছেদের সাথে মিলিয়ে পাঠ করলে দেখা যাবে যে মন্ত্রণালয় গঠন ও পুনর্গঠনের বিষয়টি সম্পূর্ণ সংবিধানসম্মত। বর্তমানে যে ‘বিশেষ কার্যাদি বিভাগ’ রয়েছে-যা বিএনপি শাসনামলেও পূর্ণরূপে কর্মরত ছিল তা কার্যত পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য বিশেষ অঞ্চল বিষয়ক একটি কর্ম বিভাগ বা মন্ত্রণালয়। অতএব বিএনপির এ বিষয়ক বক্তব্য কার্যত তাদের কৃত কর্মকান্ডের বিপরীত অবস্থান এবং পরস্পরবিরোধী।

বিএনপিঃ এই চুক্তি বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যে তথাকথিত অনগ্রসর শ্রেণীর জন্য বিশেষ বিধান করতে গিয়ে পাল্টা বৈষম্য সৃষ্টি করেছে যা সংবিধানের ২৯ নং ধারার পরিপন্থী।
হাসিনার ব্যাখ্যাঃ তাদের এ বক্তব্যটি সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী তো নয়ই, বরং ২৮(৪) অনুচ্ছেদের পরিপূক। এ বক্তব্যে তারা ‘‘তথাকথিত অনগ্রসর শ্রেণীর জন্য বিশেষ বিধান করতে গিয়ে’’ কথা কয়টি উল্লেখ করে কার্যত বিশেষ বিধান প্রণয়নের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাই স্বীকার করে নিয়েছেন। বস্তুত অনগ্রসর শ্রেণী গোষ্ঠীর জন্য কোন বিধানই ২৯ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী হতে পারে না। সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে নারী, মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী, উপজাতি এবং জেলা কোটা-এই বিশেষ বিধানের অধীনেই কার্যকর আছে এবং এ কোটা পদ্ধতি সংবিধানের ২৯ নং অনুচ্ছেদের পরিপন্থী একথা কেউ এখনো বলেননি বা বলার অবকাশও নেই। সমাজের অনগ্রসর শ্রেণীর জন্য কোন বিশেষ বিধান করা হলে অন্য কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এমনটি ভাবা অবান্তর।

বিএনপিঃ চুক্তি ‘গ’ খন্ডের ১৩ ধারার মাধ্যমে জাতীয় সংসদ কর্তৃক আইন প্রণয়নের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। এটা কখনো গ্রহণযোগ্য নয় এবং জাতীয় সংসদের প্রধান ক্ষমতা খর্ব করার সুস্পষ্ট চক্রান্ত। জাতীয় সংসদের সম্মান এবং সার্বভৌমত্ব নস্যাৎ করার এই প্রচেষ্টা দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
হাসিনার ব্যাখ্যাঃ এটা কোন সুনির্দিষ্ট বক্তব্য নয়। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংসদের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নাতীত। প্রকৃতপক্ষে যে কোন আইনের খসড়া সংসদে উপস্থাপনের পূর্বে মন্ত্রণালয়, আন্তঃমন্ত্রণালয়, আইন বিশেষজ্ঞ, সংশ্লিষ্ট মহল এবং মন্ত্রিসভা প্রভৃতি বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনা ও পর্যালোচনা হয়ে থাকে। এমন কি, সংসদে আইনের খসড়া উপস্থাপনের পরও কমিটি পর্যায়ে তা যাচাই-বাছাই আলোচনা-পর্যালোচনা হয়ে থাকে। এর অর্থ এই নয় যে, আইন প্রণয়নের এ সকল কর্মকান্ড সংসদের সার্বভৌমত্ব খর্ব করে। এমনকি সংসদও যে কোন আইন প্রণয়নের পূর্বে জনমত যাচাইয়ের জন্য প্রেরণ করতে পারে। বর্তমান সংসদেও বিএনপির সংসদ সদস্যগণ প্রায়শই বিভিন্ন আইনের খসড়া জনমত যাচাইয়ের জন্য প্রেরণ করার প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। সুতরাং তাদের এ বক্তব্যটি স্ববিরোধী।

বিএনপিঃ সংবিধানের ৩৬ ধারা বলে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরার, বাংলাদেশের যে কোনো স্থানে বসবাস ও বসতি স্থাপন একটি মৌলিক অধিকার। চুক্তির ‘গ’ অধ্যায়ের ২৬ নং পংক্তি সংবিধানে প্রদত্ত নাগরিকদের এই মৌলিক অধিকার লংঘন করা হয়েছে।
হাসিনার ব্যাখ্যাঃ বক্তব্যটি যেভাবে উত্থাপন করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ অস্পষ্ট, অনির্দিষ্ট ও অজ্ঞতাপ্রসূত। সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘‘জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে সর্বত্র চলাফেরা, ইহার যে কোন স্থানে বসবাস ও বসতি স্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশ পুনঃপ্রবেশ করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’’ বাংলাদেশ সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির ‘‘খ’’ অধ্যায়ের ২৬ নং পংক্তিতে বা চুক্তির অন্য কোথাও এমন কিছু নেই যা সংবিধানের ৩৬ নং অনুচ্ছেদ বা অন্য কোন অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। ৩৬ অনুচ্ছেদের বক্তব্য পাঠকালে সর্বদা একটি বিষয় স্মরণ রাখতে হবে যে, ‘‘জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিযুক্ত বাধানিষেধ’’- বলে যে কথা কয়টি রয়েছে তা গুরুত্বহীন নয়।

বিএনপিঃ সংবিধানের ৪২(১) ধারার অধীনে প্রত্যেক নাগরিকের সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর বা অন্যভাবে বিলিব্যবস্থা করার মৌলিক অধিকার রয়েছে। চুক্তির ২৬ নং পংক্তি বাংলাদেশের নাগরিকদের এই মৌলিক অধিকারকে খর্ব করেছে।
হাসিনার ব্যাখ্যাঃ এ অভিযোগটি সর্বৈব মিথ্যাচার এবং বক্তব্যের কোন ভিত্তি নেই। তাদের ৮ দফায় যা বলা হয়েছে এটিও অনুরূপ একটি বক্তব্য। কেননা, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪২(১) এ আইনের দ্বারা আরোপিত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে কথা কয়টি দিয়ে সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর বা অন্যভাবে বিলিব্যবস্থা করবার অধিকারকে শর্তাধীন করা হয়েছে। অধিকন্তু চুক্তির কোথাও অবাধ চলাচল বা সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর বা বিলি বন্টনের ক্ষেত্রে কোনরূপ শর্ত পূরণ সাপেক্ষে তা যথারীতি বহাল রাখা হয়েছে।

বিএনপিঃ বাংলাদেশ সরকারের যে কর্তৃত্ব এবং ক্ষমতা ভূমি বন্দোবস্ত, ভূমি অধিগ্রহণ, ইজারা এবং ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর রয়েছে সে ক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে এই সরকার এই চুক্তির মাধ্যমে আঞ্চলিক পরিষদের হাতে সমর্পণ করেছে। এতে সরকারের ক্ষমতা খর্ব হয়েছে।
হাসিনার ব্যাখ্যাঃ বিষয়টি সম্পূর্ণ সত্যের অপলাপ মাত্র। এ বক্তব্যের সাথে চুক্তির কোন ধারা, উপধারা বা বক্তব্যের কোন মিল নেই। তাদের অভিযোগের ৯ নং ধারা সম্পর্কে আমরা যে বক্তব্য রেখেছি-১০নং অভিযোগ সম্পর্কেও আমাদের একই বক্তব্য। চুক্তির কোথাও ভূমি বিষয়ে সরকারের ক্ষমতা খর্ব করা হয়নি। দেশের অন্যত্র ভূমি ব্যবস্থাপনায় সরকারের যে কর্তৃত্ব রয়েছে এক্ষেত্রেও তাই রয়েছে। কোনরূপ ছাড় দেয়া হয়নি। পার্বত্য জেলা সমূহে কর আদায়ের পদ্ধতি পূর্বে যা ছিল বর্তমানেও তাই রয়েছে।

বিএনপিঃ এই চুক্তির মাধ্যমে ঐ দেশের নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাংলাভাষী নাগরিকদের বিভিন্ন অধিকার হরণ করে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে। তাদের নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ সীমিত করে চাকরি, জীবিকা নির্বাহ ইত্যাদিতে বাধা সৃষ্টি করে এ দেশের সাধারণ নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছে।
হাসিনার ব্যাখ্যাঃ এ বক্তব্যটিও একটি মিথ্যা বিবৃতি। কেননা এ চুক্তির মাধ্যমে কোন বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়নি। বাঙ্গালিদের কোন নাগরিক অধিকারও ক্ষুণœ করা হয়নি। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৮(৪) এর নির্দেশানুসারে কতিপয় বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে মাত্র। তাদের চাকরি, জীবিকা নির্বাহ ইত্যাদি কোন ক্ষেত্রেই কারো কোন মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়নি।

বিএনপিঃ জেলা প্রশাসক পদ বিলুপ্তি ও কমিশনারের দায়িত্ব, ক্ষমতা ও কর্তব্য সীমিতকরণ ও সমস্ত সরকারি, আধা-সরকারি কর্মচারী, পুলিশ, শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীদের সরকারের অধীনে না রেখে বস্তুত পার্বত্য পরিষদের অধীনে ন্যস্ত করা হয়েছে। এতে একই দেশে দু’টি ভিন্ন প্রশাসনিক ব্যবস্থার জটিলতা সৃষ্টি এবং সরকারি/আধা সরকারি কর্মচারীদের মর্যাদা নিম্নমুখী করা হয়েছে। সরকারি প্রশাসনের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। এর সুদূর প্রসারী ফলাফল দেশের বাকি অংশেও জটিলতা বৃদ্ধি করবে।
হাসিনার ব্যাখ্যাঃ এ বক্তব্যটি সর্বৈব মিথ্যা ভাষণ। জেলা প্রশাসক পদ বিলুপ্ত করা হয়নি বা কমিশনারের দায়িত্ব, ক্ষমতা ও কর্তব্যও সীমিত করা হয়নি। আমরা দেশের প্রত্যেক জেলা-উপজেলা পরিষদ গঠন করার ব্যবস্থা নিচ্ছি। এসব পরিষদ স্ব স্ব ক্ষেত্রে নিজ নিজ আঞ্চলিক উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা করবে এবং সরকারের প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে সমন্বয় সাধন করে কাজ করবে। বিবেচ্য ক্ষেত্রেও তাই করা হয়েছে। একটি সমতল জেলায় জেলা পরিষদের পাশাপাশি জেলা প্রশাসক কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাবেন, তেমনি পার্বত্য জেলা পরিষদের পাশাপাশি জেলা প্রশাসকও থাকবেন এবং তিনি তার ওপর অর্পিত সরকারি দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে যাবেন। কমিশনারের দায়িত্ব, কর্তব্য বা ক্ষমতা কোন অংশেই খর্ব বা সীমিত করা হয়নি। শুধুমাত্র নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণের বিষয়ে কমিশনারের পরিবর্তে একজন বিচারপতি শপথ পাঠ করাবেন। এতে কমিশনারের ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্য কি করে খর্ব করা হলো তা আদৌ বোধগম্য নয়। অনুরূপভাবে কোন ব্যক্তি উপজাতীয় কি না বা তিনি কোন উপজাতির সদস্য সে সম্পর্কে সার্টিফিকেট প্রদানের দায়িত্ব জেলা প্রশাসকের পরিবর্তে সার্কেল চিফের ওপর দেয়া হয়েছে এবং এটাই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত। এতে জেলা প্রশাসকের পদ বিলুপ্ত করা হয়েছে মর্মে যারা উচ্চকিত হচ্ছেন, তারা বস্তুতপক্ষেই বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করে যাচ্ছেন মাত্র।

বিএনপিঃ উপজাতীয় মন্ত্রী নিয়োগ এই চুক্তিতে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সংবিধানে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ওপর শর্ত আরোপ করা হয়েছে। সামরিক বাহিনী, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর চলাফেরা সীমিতকরণ এবং তাদের পার্বত্য পরিষদের পরোক্ষভাবে অধীনস্থকরণের মাধ্যমে তাদের মর্যাদা, কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনের অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। যা বাংলাদেশের জন্য সম্মান এবং মর্যাদা হানিকর।
হাসিনার ব্যাখ্যাঃ বিএনপি উত্থাপিত ৫ নং অভিযোগ ও এ অভিযোগটি কার্যত একই অভিযোগ। মন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি/প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ওপর কোনরূপ শর্ত আরোপ করা হয়নি। এ বিষয়ে আমরা আমাদের বক্তব্য তাদের অভিযোগনামার ৫ নং ধারার উত্তরে যা বলেছি সেটাই এ ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

বিএনপিঃ সামরিক বাহিনী, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর চলাফেরা সীমিতকরণ এবং তাদেরকে পরোক্ষভাবে পার্বত্য পরিষদের অধীনস্থকরণের মাধ্যমে তাদের  মর্যাদা, কর্তব্য ও দায়িত্ব  পালনের অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। যা বাংলাদেশের জন্য সম্মান এবং মর্যাদাহানিকর।
হাসিনার ব্যাখ্যাঃ অভিযোগটি একেবারেই ভিত্তিহীন। সামরিক, আধা-সামরিক বা শান্তি-শৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত কোন বাহিনীর চলাচলের ওপরই কোন বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়নি বা সীমিতকরণ করা হয়নি। সামরিক, আধা সামরিক বাহিনী বা শান্তি রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীসমূহ সর্বদাই তাদের নির্দিষ্ট বিধিবিধানের আওতায় চলাচল করে থাকেন। যুদ্ধকালীন অবস্থা বা সিভিল কর্তৃত্বের সহায়ক হিসেবে কর্মরত অবস্থায় তাদের যে চলাচল শান্তিকালীন বা স্বাভাবিক সময়ে তাদের চলাচলে সর্বত্রই পার্থক্য থাকে। যে কোন আইনানুগ সশস্ত্র বাহিনীর চলাচল সর্বত্রই ও সর্বসময়েই আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রেও কোন ব্যতিক্রম করা হয়নি।

বিএনপিঃ এ অঞ্চলের প্রোটেকটেড বনাঞ্চল বহু জমির ওপর সরকারের অধিকার থাকা সত্ত্বেও চুক্তিতে বহু স্থানে এই সরকারি স্বার্থ তথা সমগ্র দেশের জনগণের স্বার্থ বিসর্জন দেয়া হয়েছে। এমনকি সরকারের নতুন জমি অধিগ্রহণের ক্ষমতাও প্রত্যাহার করা হয়েছে।
হাসিনার ব্যাখ্যাঃ এ বক্তব্যটি সর্বৈব মিথ্যাচার এবং অপপ্রচার। চুক্তির কোথাও এমন কথা উল্লেখ নেই। অনুরূপভাবে নতুন জমি অধিগ্রহণের ক্ষমতাও পূর্ববৎই রয়েছে।

বিএনপিঃ সরকার কর্তৃক নানা ধরনের ট্যাক্স, খাজনা, টোল আদায়ের ক্ষমতা প্রত্যাহার, ভূমি, পুলিশ, পর্যটন, বিচারের বিভিন্ন ব্যবস্থার মাধ্যমে শিল্পস্থাপনের অনুমতি সংরক্ষণ, খনিজ সম্পদ উত্তোলনের পরে লাভের কমিশন ব্যবস্থায় ইত্যাদি বহু বিষয়ে সরকার নিজস্ব অধিকার, ক্ষমতা ও রাজকোষে অর্থ উপার্জন সঙ্কুচিত করেছে।
হাসিনার ব্যাখ্যাঃ এটি একটি উদ্ভট, কাল্পনিক ও ভিত্তিহীন অভিযোগ চুক্তির কোথাও এমন কথা নেই।

বিএনপিঃ সরকার সহিংসতাবাদীদের পুরস্কার দিতে রাজি হয়েছে, নগদ অর্থ দান, জীবিকার ব্যবস্থার এবং মামলা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করেছে-অন্যদিকে নিরীহ অউপজাতীয়দের মধ্যে যাদের স্বজন নিহত হয়েছে এবং তাদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে সেগুলো প্রত্যাহার করার কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
হাসিনার ব্যাখ্যাঃ প্রত্যাবাসন প্রত্যাশীদেরকে পূর্বের সরকারসমূহও নগদ অর্থ, গৃহনির্মাণ সামগ্রী, জীবিকার ব্যবস্থা প্রদান করেছে। বর্তমান চুক্তিতেও তাই আছে। পূর্ববর্তী সরকারসমূহের সময়ে কোনরূপ স্থায়ী শান্তির ব্যবস্থা ছাড়াই প্রত্যাবাসন প্রার্থীদের মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। চুক্তিতে সে ব্যবস্থাই অব্যাহত রাখা হয়েছে। পার্থক্য এই যে, পূর্বে শান্তি স্থাপনের নিশ্চয়তা বিধান ব্যতিরেকেই আলোচ্য ব্যবস্থাসমূহ নেয়া হয়েছিল আর বর্তমানে শান্তি স্থাপনের নিশ্চয়তা বিধান করে এ সকল ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তাদের বক্তব্য তাদের পূর্বকৃত কর্মকান্ডের সম্পূর্ণ বিপরীত।

বিএনপিঃ পরিষদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া জমি, পাহাড়, বনাঞ্চল অধিগ্রহণ ও হস্তান্তর নিষিদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে সরকার নিজস্ব ক্ষমতা পরিষদের কাছে সমর্পণ করেছে।
হাসিনার ব্যাখ্যাঃ অভিযোগের ১৫ নং ধারায় যা বলা হয়েছে এ ধারাটি তার পুণরাবৃত্তি মাত্র। এ প্রসঙ্গে আমাদের বক্তব্য সুস্পষ্ট তারা একটি কাল্পনিক ও ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে ধরেছেন।

Exit mobile version