শান্তি চুক্তির পর সহিংসতার নজির নেই, ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে সম্প্রীতি বান্দরবান
পার্বত্য জেলা রাঙামাটি-খাগড়াছড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এই সহিংসতায় চারজন নিহত ও অনেকে আহত হয়েছেন। সম্প্রতি ওই দুই জেলায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও পরিবেশ শান্ত রয়েছে বান্দরবানে। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর থেকে এখন পর্যন্ত বান্দরবান জেলায় কোনো হামলা ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে এমন নজির নেই। এখনো পাহাড়ি-বাঙালি ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে রয়েছে সম্প্রীতি বান্দরবান জেলাটিতে।
তিন পার্বত্য জেলা মধ্যে একমাত্র বান্দরবান জেলাতে মারমা, চাকমা, ম্রো, ত্রিপুরা, লুসাই, খুমি, বম, খেয়াং, চাক, পাংখোয়া, তঞ্চঙ্গ্যা ও বাঙ্গালীসহ ১২টি জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। শান্তিচুক্তি পর থেকে এই জেলায় এখনো পর্যন্ত কোন সহিংসতায় জড়াইনি কোন জাতি। এই জেলায় পাহাড়ি ও বাঙালিরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে রয়েছে। একে অপরের প্রতি সম্প্রীতি বজায় রেখে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। বিভিন্ন উৎসব উদযাপনে ধর্ম যার যার বলা হলেও প্রতিটি উৎসবে মেতে উঠেন সকল সম্প্রদায়ের জাতিগোষ্ঠিরা। বিভিন্ন সমস্যা সম্মুখীন হলে বিপদে হাত বাড়ান একে অপরের প্রতি। বান্দরবানে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে এখনো সহাবস্থান বিরাজমান রয়েছে।
বান্দরবান দুর্নীতি দমন কমিশনের সভাপতি ও মানবাধিকার কর্মী অংচমং মার্মা বলেন, শান্তি চুক্তি পর থেকে এই জেলায় এখনো কোন সহিংসতা ঘটনা ঘটেনি। তবে ভবিষ্যতে কখনো সংঘর্ষ হবে না, এটা বলার সুযোগ নেই। কেননা দিনদিন যেভাবে লোকজন অ্যাগ্রেসিভ (উত্তেজিত) হয়ে উঠছে তাতে অঘটন ঘটার সম্ভাবনা লক্ষ্যে করা যাচ্ছে। তবুও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি ভবিষ্যতেও যেন সম্প্রীতি বন্ধন অটুট থাকে।
১৯৯৫ সালে ১৫ মার্চ পিসিপি (পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ) সম্মেলনকে কেন্দ্র করে দু’ পক্ষে সংঘর্ষ হয়েছিল। পিসিপি যে স্থানে সমাবেশ আয়োজন করার জন্য প্রশাসনের অনুমতি নিয়েছিল। ঠিক একই জায়গায় বাঙালিরাও সমাবেশ আয়োজন করার অনুমতি চাইলে ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। পিসিপি তাদের নির্ধারিত কর্মসূচি পালন করতে চাইলে তখন দুপক্ষে সংঘর্ষ বাধে। এই সংঘর্ষ জের ধরে রাতে মধ্যম পাড়ায় আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। সেদিন প্রায় ৩০-৪০টি ঘরবাড়ি আগুনে পুড়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল অনেক সাধারণ মানুষজন। এরপর ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তি হলে আর কোনো সহিংসতা হয়নি।
বান্দরবান সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গির বলেন, আমরা কোনো দাঙ্গা বা সহিংসতা চাই না। রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির ঘটনাকে কেন্দ্র করে কতিপয় কিছু ব্যক্তি চেষ্টা করছেন দাঙ্গা সৃষ্টি করার। তাই ১৯৯৫ সালের পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় সে বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
৪ হাজার ৪শত ৭৯ দশমিক শূন্য ৩ বর্গ কিঃমিঃ আয়তনে জেলা বান্দরবান। জেলাটিতে জনসংখ্যা ৪লক্ষ ৮১ হাজার ১০৯ জন মানুষের বসবাস। ১২টি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ এই জেলাতে সম্প্রীতিভাবে দীর্ঘকাল থেকে শান্তিপূর্ণ ভাবে বসবাস করে আসছে। রয়েছে যে যার ঐতিহ্য সংস্কৃতি, বর্ণমালা। কিন্তু খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি এই দুই জেলায় ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিছুটা অশান্তি বিরাজ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। সবশেষে মানুষের মাঝে যে সম্প্রীতি বন্ধন রয়েছে সেটিকে ভেবে আর অশান্ত হয়ে উঠেনি বান্দরবান। তবে রাজনৈতিক ইস্যুর কারণে পাহাড়ে অশান্তি এসব সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে রাজনৈতিক মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করার পাশাপাশি পাহাড়ে দীর্ঘদিনে যে সংঘাত সেটিও সমাধানের পথ তৈরি করতে হবে বলে মনে করছেন অনেকেই।
বান্দরবানে জেলায় ৩০ বছর ধরে সাংবাদিকতা করছেন বুদ্ধজ্যোতি চাকমা। তিনি বলেন, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর থেকে বান্দরবানে বড় ধরনের কোনো সহিংসতা হয়নি। আগামীতেও শান্তি বজায় যাতে থাকে সে কারণে সব পক্ষকে মিলে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
এদিকে দুই পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি খাগড়াছড়িতে অপ্রীতিকর ঘটনাকে কেন্দ্র করে গেল শুক্রবার জেলা প্রশাসক সম্মেলন কক্ষে পাহাড়ি-বাঙালি নেতাদের মাঝে শান্তির আলোচনা শুরু হয়। আলোচনায় বলা হয়- অপর দুই পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি খাগড়াছড়িতে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেও বান্দরবান শান্তি ও সম্প্রীতির জায়গা। এই জেলাতে পাহাড়ি বাঙালি ১২টি সম্প্রদায় দীর্ঘ কাল ধরে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে বসবাস করে আসছে। কোনোরকম আপত্তিকর ঘটনা ঘটলে প্রশাসনিকভাবে কঠোর হাতে দমন করা হবে। আর এখানে যাতে কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সেজন্য সবাই একসাথে কাজ করার অঙ্গীকার করে প্রস্তুতি বদ্ধ হন পাহাড়ি-বাঙালি নেতারা।
বান্দরবান জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হোসাইন মো. রায়হান কাজেমী বলেন, বান্দরবানে এখনো কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেনি। সারাবছর পাহাড়ি ও বাঙালিরা একসঙ্গে কাজ করছেন। বান্দরবানে কোনো সময় সহিংসতা হয়নি।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, হামলা এড়াতে একটি কোর কমিটি করা হয়েছে। পাহাড়ি-বাঙালি উভয়ই পক্ষের প্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে সভা করা হয়েছে। সভায় পাহাড়ি ও বাঙালি দুই পক্ষের প্রতিনিধিরা সম্প্রীতি বজায় রাখা পাশাপাশি তারা কোনো ধরনের সহিংসতায় যাবেন না বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।