parbattanews

শিল্পায়নে পিছিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম

সম্ভাবনার পাহাড়- ১

কর্ণফুলি পেপার মিল

জাহিদুল ইসলাম, পার্বত্য অঞ্চল থেকে ফিরে:

দিগন্ত ছাড়িয়ে ফাঁকা মাঠ। এরপর এক সারি পাহাড়; শেষে আবারও ফাঁকা জমি। কোথাও আবার লতাগুল্মের ঝোপ-ঝাড়। দেশের মোট আয়তনের এক-দশমাংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়েই মিলবে এ দৃশ্য। সারা দেশের তুলনায় প্রায় জনবিরল এ অঞ্চলের জমির যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। চাষাবাদে ব্যবহার হচ্ছে জমির সামান্য অংশ। অথচ বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে বর্তমানে জমির স্বল্পতা সবচেয়ে বড় বাধা। তৈরি পোশাকসহ শ্রম ঘন শিল্প খাতের দেশীয় উদ্যোক্তারাও সাম্প্রতিক সময়ে জমিস্বল্পতার কথা বলছেন। ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও রফতানি বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু চট্টগ্রামের পাশেই পার্বত্য এলাকা শিল্পায়নে পিছিয়ে রয়েছে।

সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ অর্থনৈতিক শুমারির হিসাবে, সারা দেশে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৭৮ লাখ ১৮ হাজার ৫৬৫। এর মধ্যে পার্বত্য অঞ্চলের তিন জেলায় বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৭৮ হাজার ৯৫৭টি। বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও পার্বত্য এলাকায় শিল্পায়নের হার দেশের যে কোনো এলাকার চেয়ে কম।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যোগাযোগ অবকাঠামোর দুর্বলতার কারণে পার্বত্য অঞ্চলে পর্যাপ্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে না। এখানে বিদ্যুতের সরবরাহ চাহিদার তুলনায় অনেক কম। পাহাড়ের অনেক এলাকা এখনও বিদ্যুৎ সংযোগের বাইরে রয়েছে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও নিয়মিত চাঁদাবাজির কারণে এ অঞ্চলে শিল্পায়নের সম্ভাবনাও কাজে লাগছে না। চাঁদার দাবিতে অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, এমনকি হত্যাকা- ঘটাতেও পিছপা হচ্ছে না সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো। জমি হস্তান্তরে সনাতনী নীতিমালার কারণে ইচ্ছে থাকলেও পার্বত্য অঞ্চলে জমি পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা।

সর্বশেষ অর্থনৈতিক শুমারি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সারা দেশে প্রতি বছর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ হারে বাড়ছে। আর পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটিতে বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান বাড়ছে ৩ দশমিক ৮১ শতাংশ হারে। বান্দরবানে শিল্পপ্রতিষ্ঠান বৃদ্ধির হার প্রতি বছর ৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ। খাগড়াছড়িতে শিল্পপ্রতিষ্ঠান বাড়ছে ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ হারে। তিন জেলায় মাত্র ২ লাখ ৯২ হাজার মানুষ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়েজিত রয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাঙ্গামাটি জেলায় ২০০১ সালে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল প্রায় ২২ হাজার। ২০১৩ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৩ হাজারে। একই সময়ে খাগড়াছড়ি জেলায় প্রায় ১৪ হাজার থেকে বেড়ে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দাঁড়ায় সাড়ে ২৯ হাজারে। আর বান্দরবান জেলায় সাড়ে ১০ হাজার থেকে বেড়ে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৩ হাজারে। একই সময়ে সারা দেশে ৩৭ লাখ ৮ হাজার ১৫২ থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা উন্নীত হয় ৭৮ লাখ ১৮ হাজারে।

এ বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার বলেন, বিদ্যুতের সরবরাহ ও সড়ক অবকাঠামো বিবেচনায় পার্বত্য অঞ্চলে ভারি শিল্প বিকাশের সম্ভাবনা কম। তবে এ অঞ্চলে খাদ্য ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণের মতো শিল্পের ব্যাপক বিকাশের সম্ভাবনা রয়েছে।

তিনি বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে ব্যাপক হারে মশলার চাষ হয়। পাহারে আনারস, কমলা, কলাসহ বিভিন্ন ফলের চাষ হয়। এসব ফসলকে কেন্দ্র করে শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিভাজনের কারণে শিল্পায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি। চাঁদাবাজির কারণে জননিরাপত্তা ব্যাহত হচ্ছে বলেও স্বীকার করেন আওয়ামী লীগের এই নেতা।

খাগড়াছড়ির এক ব্যবসায়ী বলছেন, আঞ্চলিক দলগুলোর চাঁদাবাজি অহরহ ঘটছে। চাঁদাবাজিতে তারা কারও চেয়ে কেউ পিছিয়ে নেই। কোনো পরিবহন মাল নিয়ে খাগড়াছড়ি ঢোকার সময় অথবা বের হওয়ার সময় চাঁদা দিতে হয়। একেক সময় তারা একেক স্থান থেকে চাঁদা তোলে। চাঁদা না দিলে গাড়ি থামিয়ে কর্মীদের মারধর করা হয়, অনেক ক্ষেত্রে গাড়ি পুড়িয়ে দেয়। চাঁদা না দেয়ায় সম্প্রতি প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের একটি গাড়ি পুড়িয়ে দেয় স্থানীয় সন্ত্রাসীরা।

সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি ফিরোজা বেগম চিনু বলেন, চাঁদাবাজি এখানে ওপেন-সিক্রেট বিষয়। তবে ভয়ে কেউ মামলা করছে না। সশস্ত্র গ্রুপ চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণ করে পাহাড়কে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা করছে। পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা সব পর্যায়ে চাঁদা আদায় করে থাকে। তাদের চাঁদাবাজির কারণে এলাকার লোকজন অতিষ্ঠ। চাঁদাবাজি বন্ধ না হলে পার্বত্য অঞ্চলে কেউ শিল্প স্থাপন করতে চাইবে না বলেও তিনি মনে করেন।

সূত্র: আলোকিত বাংলাদেশ

Exit mobile version