সংকীর্ণ হয়ে আসছে কাছিমের ডিম পাড়ার জায়গা, ৫ বছরে ৪০ হাজার অবমুক্ত


সমুদ্রের ঝাড়ুদার খ্যাত কাছিমের ডিম পাড়ার জায়গা দিন দিন সংকীর্ণ হয়ে আসছে। দুই বছর আগেও সোনাদিয়া থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত সমুদ্র সৈকতের ৫৪টি বালিয়াড়ি পয়েন্টে কাছিম ডিম পাড়ত। আর তা এখন কমে দাঁড়িয়েছে ৩৪টি’তে।
কারণ হিসেবে জানা যায়, কাছিমের ডিম পাড়ায় জায়গায় পর্যটকদের অবাধ বিচরণ, জেলেদের কাছিম নিধন, অসচেতনতা, কুকুর-শিয়ালের দৌরাত্ম্য, কুচক্র মহল ও উপজাতির ডিম-কাছিম সংগ্রহসহ নানা প্রতিকূলতা।
এদিকে কাছিম সংরক্ষণ ও প্রজননে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতে যৌথভাবে কাজ করছে পরিবেশ-বনবিভাগ ও ‘নেকম’ (নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট)। যৌথ প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে জনগণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি, কাছিমের নিরাপদ বিচরণ, ডিম পাড়ার সুষ্ঠু পরিবেশ ও সমুদ্রে বাচ্চা অবমুক্ত। তারা গত ৫ বছরে সংরক্ষিত ৫০ হাজার ডিম থেকে প্রায় ৪০ হাজার কাছিম সমুদ্রে অবমুক্ত করেছে।
এছাড়া এই বছর তারা রেকর্ড পরিমাণ কাছিম অবমুক্ত করছে। যার সংখ্যা ৮ হাজার। কাছিম অবমুক্তির ধারাবাহিক প্রক্রিয়া হিসেবে বুধবার (১৫ মে) দুপুরে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের পেঁচার দ্বীপে ‘সামুদ্রিক কাছিম সংরক্ষণ ও প্রজনন কেন্দ্র সংলগ্ন পয়েন্টে ২৫০টি কাছিম অবমুক্ত করা হয়। দেখা যায় বুকের উপর ভর দিয়ে একটু একটু করে হামাগুড়ি দিয়ে বালিয়াড়ি থেকে সমুদ্রের দিকে ছুটছে কাছিমের ছানা। তারা হয়ত সমুদ্র পরিষ্কারের মধ্য দিয়ে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ডিম দিতে আবারো ফিরে আসবে সাগর পাড়ে।
প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন ‘নেকম’ ম্যানেজার আব্দুল কাইয়ুম জানান, সাগরে মাছের পোনা খেয়ে ফেলা জেলিফিশ, পাথরে জমে থাকা ফোম খাওয়াসহ ক্ষতিকর আবর্জনা পরিষ্কারের মধ্য দিয়ে সাগরের জীববৈচিত্র রক্ষার্থে বড় ভূমিকা রাখে কাছিম। কিন্তু মানবসৃষ্ট নানা প্রতিকূলতার কারণে আজ কাছিম হুমকির মুখে। দিন দিন সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে ডিম পাড়ার জায়গা। ২০২১-২২’এ ‘নেকমে’র জরিপ অনুযায়ী সোনাদিয়া থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত বালিয়াড়ির ৫৪টি পয়েন্টে কাছিম ডিম পাড়ত। তা এখন কমে দাঁড়িয়েছে ৩৪টি’তে। ডিমছাড়া জায়গায় পর্যটন সমাগম সহ নানা কারণে এমনটা হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, পরিবেশ, বন বিভাগ ও নেকম যৌথভাবে ২০ বছর যাবত কাছিমের সংরক্ষণ ও প্রজনন নিয়ে কাজ করছে। গত ৫ বছরে ৫০ হাজার ডিম থেকে প্রায় ৪০ হাজার বাচ্চা সমুদ্রে অবমুক্ত করা হয়েছে। এ বছর ১৫ হাজার ডিম থেকে ৮ হাজার বাচ্চা অবমুক্ত করা হয়েছে। এসব ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে সোনাদিনা, পূর্ব পাড়া, পশ্চিম পাড়া, মাদার বনিয়া, পেঁচার দ্বীপ, শিলখালী, শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্টমার্টিন হতে। কাছিম সুরক্ষায় সচেতনতার পাশাপাশি স্থানীয়দের ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে।
সমুদ্রের পাড়স্থ করাচিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ওসমান গণি জানান, ‘আমরা আগে কাছিম সম্পর্কে জানতাম না। আমি নিজেই কাছিমের ডিম ও বাচ্চা উপজাতিদের বিক্রি করেছি। কুকুর-শিয়ালেরা কাছিমের ডিম-বাচ্চা নষ্ট করলেও তেমন গুরুত্ব দিতাম না। এখন কাছিমের গুরুত্ব বুঝতে পেরে কাউকে নষ্ট করতে দেই না। ডিম পেলেই হ্যাচারিতে দিয়ে আসছি।
আব্দুল লতিফ নামে আরেক স্থানীয় ব্যক্তি জানান, ৮-১০ বছর আগেও কাছিমকে অপয়া মনে করে মেরে ফেলতাম। পরে নেকম’এর কাছ থেকে ট্রেনিং নিয়ে জানতে পারলাম কাছিম পরিবেশের বন্ধু। এখন কাছিমের ডিম সংরক্ষণ, নিরাপত্তা, যত্ন ও সাগরে অবমুক্ত নিয়ে নেকমের হয়ে কাজ করছি।
হিমছড়ি বিট কর্মকর্তা কামরুজ্জামান শোভন জানান, কাছিমের ব্যাপারে স্থানীয়দের সচেতন করছে বনবিভাগ। এছাড়া ডিম সংরক্ষণ করে হ্যাচারিতে পৌঁছেনো, সংরক্ষিত ডিম ৬০ দিন পর সাগরে অবমুক্তি করলে সহযোগিতা, অসাধু চক্র ও শিয়াল-কুকুর যেন ডিম নষ্ট না করতে পারে সে জন্য টহল জোরদারসহ ডিম পাড়তে আসা মা’ কাছিমের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করছে বন বিভাগ।
পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. নুরুর আমিন জানান, মানবসৃষ্ট নানা প্রতিকূলতার কারণে দিন দিন কাছিম কমে যাচ্ছে। যা পরিবেশের জন্য হুমকি বটে। পরিবেশ-প্রকৃতি রক্ষার্থে কাছিমের উপযুক্ত পরিবেশ দিতে সচেতনতার পাশাপাশি সম্মিলিত প্রচেষ্টার বিকল্প নেই। তাদের ফিরিয়ে দিতে হবে নিজস্ব পরিবেশ। তখনই কাছিম রক্ষার পাশাপাশি রক্ষা পাবে সমুদ্রের জীববৈচিত্র।

















