parbattanews

সংকুচিত হয়ে আসছে পাহাড়ের বাঁশ ক্ষেত্র: নেই গবেষণা, পরিকল্পনা ও পৃষ্ঠপোষকতা

01

আলমগীর মানিক, রাঙামাটি:
‘বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ঐ, মাগো আমার শ্লোক বলা কাজলা দিদি কই’- এমন কবিতা পড়ে আমরা স্মৃতিকাতর হলেও বাস্তবে এখন দেশে বাঁশ বাগান তেমন একটা নেই। অথচ মানুষের দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত কাজে লাগা বাঁশের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ঘর বানাতে বাঁশের ব্যবহার কিছুটা কমে গেলে বাঁশ ব্যবহারের ক্ষেত্র বেড়েছে দিনে দিনে। কিন্তু অতি প্রয়োজনীয় এই বাঁশের চাষ ও উৎপাদন বাড়েনি কোনোভাবেই।

পার্বত্যাঞ্চল এখন পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বাঁশবহুল এলাকা, গবেষণা ও পরিকল্পনার সমন্বয় না থাকায় পাহাড়ের বাঁশ ক্ষেত্রও ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। বাঁশ নিয়ে সরকারি একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে বটে তবে তাদের অফিস চট্টগ্রামে। স্থানীয় কৃষকরা তাদের কাছ থেকে কখনই প্রয়োজনীয় উপদেশ ও সহায়তা পায়না এতে অদূর ভবিষ্যতে পাহাড়ের বাঁশ ক্ষেত্র আরো সংকুচিত হয়ে যাবার আশঙ্কা করছেন। বাঁশ ব্যবসা ও বাণিজ্যিকভাবে বাঁশ ব্যবহারের উপর নির্ভরশীল সূত্রগুলো।

১৯৬০ সালে কাপ্তাই জল বিদুৎ প্রকল্পের জন্য কৃত্রিম বাঁধ সৃষ্টির পর থেকেই রাঙামাটিবাসীর জীবনে নেমে আসে চরম অর্থ সঙ্কট। মূলত এরপর থেকেই এ জেলার মানুষ বাঁশ, গাছ ও কাপ্তাই হৃদের মাছের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কিন্তু একের পর এক প্রাকৃতিক জঙ্গলভূমি ধবংস করে জুম চাষ ও সরকারি সঠিক পরিকল্পনা ও সহায়তার অভাবে ত্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে রাঙামাটি জেলার বাঁশ ক্ষেত্র। পার্বত্য চট্টগ্রামে মাত্র ১৫-২০ বছর আগেও প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠা বাশঁ বাগানের সমাহার দেখা গেলেও কালের বিবর্তনে বনাঞ্চল উজাড় করার ফলে বর্তমানে তেমন একটা চোখে পড়ে না।

রাঙামাটির কাউখালী, বেতবুনিয়া, বাঘাইছড়ি, নানিয়ারচর, কাপ্তাই ও সাজেকের বেশ কয়েকজন বাঁশ চাষী ও বাশঁ ব্যবসায়ির সাথে আলাপকালে তারা জানালেন, পাহাড়ের বাশঁ থেকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় করলেও সরকার এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে কোনো প্রকার সহায়তা করছে না। অথচ এখন পর্যন্ত পাহাড়ের অর্থনীতির একটি বিরাট অংশ নিয়ন্ত্রণ করে এই বাঁশের ব্যবসা। এক পাহাড়ের বিভিন্ন প্রজাতির প্রাকৃতিক ও সৃজিত বাঁশই ছিল অর্থনীতির মুল চালিকা শক্তি। পার্বত্যাঞ্চলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বাশঁ চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও শুধৃমাত্র পৃষ্টপোষকতার অভাবে তারা এগুতে পারছেন বলে জানালেন এখানকার বাশঁ চাষীরা। তারা জানালেন, সরকারী সংশ্লিষ্ট বিভাগ যদি পার্বত্যাঞ্চলে বাশঁ ক্ষেত্রকে টিকিয়ে রেখে এখানকার বাশঁ চাষে ও প্রাকৃতিকভাবে বাশ বাগান সৃজনে এগিয়ে আসে তথা চাষিদের মাঝে সুদ মুক্ত অথবা স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে তাহলে অত্রাঞ্চল থেকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় যেমনি সম্ভব তেমনি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিশাল একটি অংশ আর্থিকভাবে সফল হবে। ঘুরে যাবে জীবনের চাকা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে ৩শ প্রজাতির বাঁশ রয়েছে। এরমধ্যে পার্বত্যাঞ্চলে মুলি, বাজালি, রফাই, মৃতিঙ্গাসহ প্রায় ২০ প্রজাতির বাঁশ পাওয়া যায়। প্রয়োজন ভেদে একেক প্রজাতির বাঁশ একেক কাজে লাগে। বিভিন্ন জাতের বাশ দিয়ে নকম রকম আসবাবপত্রও তৈরি করা হয়। প্রতি একশত বছর পর পর বাঁশে এক ধরণের বিচি হয়। যখন এ বিচি হয় তখন বাশঁ মরতে শুরু করে। এই মড়কের কবলে পড়ে কয়েক বছর আগে এই এলাকায় ব্যাপক হারে বাঁশ মরে যায়। এতে বেশীরভাগ বাঁশ বাগানের বিলুপ্তি ঘটে।

বর্তমানে একেবারে দুর্গম অঞ্চলে যে বাঁশ ক্ষেত্রগুলো অবশিষ্ট আছে সেখান থেকে বাঁশ সংগ্রহ করতে কষ্ট আর খরচ দুই বেশী পড়ে যায়।
এদিকে, পার্বত্যাঞ্চলে বাশঁ ক্ষেত্র বিলুপ্তির কথা স্বীকার করে রাঙামাটি দক্ষিণ বনবিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হোসাইন মোহাম্মদ নীশাত জানালেন, বিগত ২০০৫ সালে পাহাড়ে ব্যাপক মড়কের কারনে বিপুল পরিমাণ বাশঁ ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় কর্ণফুলি পেপার মিলসহ বাশঁ নির্ভর শিল্পে কাচাঁমাল সঙ্কট দেখা দেয়। এ থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে পার্বত্যাঞ্চলে ব্যাপকহারে বনায়ন করে বাশঁ বাগান সৃজনের জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। যার ফলশ্রুতিতে ২০১১/১২ সনে এই অঞ্চলের ৬০ হেক্টর জমিতে বাশঁ বাগান সৃজন করেছে দক্ষিণ বনবিভাগ।

এছাড়াও চলতি অর্থ বছরেও ৩০ হেক্টর জমিতে বাশঁ বাগান সৃজন করা হয়েছে। বাশঁ একটি বহুবিধ ব্যবহারের উপযোগী উদ্ভিদ প্রজাতি উল্লেখ করে তিনি জানালেন, বাশঁ চাষকে বাড়ানোর লক্ষ্যে এই শিল্পের সাথে যারা জড়িত তাদের কে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ বনবিভাগের পাশাপাশি বাংলাদেশ বন শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন কাজ করছে। এছাড়া চট্টগ্রামস্থ বাংলাদেশ গবেষণা ইনষ্টিটিউট ও পার্বত্যাঞ্চলের বাশঁ চাষ নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে বলেও জানালেন এই বন কর্মকর্তা।

তিনি জানান, বর্তমানে বনবিভাগের অধীনে বাশঁ ও বেত উন্মুক্ত বনায়ন নামে যে প্রকল্প রয়েছে সে প্রকল্পের অধীনে বাশঁ চাষিদের ও নার্সারি মালিকদের গত তিন বছর যাবৎ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে আসছে বনবিভাগ। তিনি আশা প্রকাশ করে জানান, বন বিভাগ ও স্থানীয়দের যৌথ প্রচেষ্টায় ভবিষ্যতে পার্বত্যাঞ্চলে বাশঁ ক্ষেত্র বিলুপ্তি’র হাত থেকে রক্ষা পাবে।

বাংলাদেশের মাটি পানি আর আবহাওয়া বাঁশ চাষের জন্য যেমন উপযোগী, তেমনি এদেশে বাঁশের প্রচুর চাহিদা থাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বাঁশ চাষের ব্যাপক সম্ভাবনাও রয়েছে। এতে পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা হবে। বাশঁ যেমন অতি প্রয়োজনীয় গাছ তেমনি এর ব্যবহারও বহুবিধ। এখন পর্যন্ত দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ বাঁশ সংগ্রহ থেকে শুরু করে কারিগরি এবং বাঁশ শিল্পের উপর নির্ভরশীল। কাজেই এই উদ্ভিদ যেমন বাচিঁয়ে রাো প্রয়োজন, তেমনি এর সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে প্রয়োজন প্রচুর গবেষণা ও পরিকল্পিত বাঁশ চাষ। পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচতে এবং পরিবেশবান্ধব বাঁশ চাষের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে যেমন ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে, তেমনি বাঁশ শিল্পের মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

Exit mobile version