সংগীতা চাকমা
এক.
বিয়ের পর প্রথমেই ওরা এসেছে সিলেট- তূর্যের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাসায়। তূর্য-সংগীতাকে ওরা বেশ সাদরে গ্রহণ করেছে তূর্যের এই দূর সম্পর্কের মামারা। ‘ওমা! কত্তো সুইট!’ বলে তূর্যের মামাতো বোনেরা সংগীতার দু’ হাত ধরে ঘরে নিয়ে যায়। ‘হানিমুন কাটাতে সিলেট এসে গেছে! বাহ! কত প্ল্যান!’- বলে পাশ থেকে টিপ্পনি কাটে তূর্যের আরেক বোন। লজ্জায় লাল হয়ে উঠে নব বিবাহিতা সংগীতার মুখ।
জাফলং-সিলেট। দিগন্ত জুড়ে অনাবিল সৌন্দর্য খেলা করছে। চারপাশে ছোট-বড় নানা রঙের পাথর। দেখে মনে হবে যেন স্রষ্টা নিজের হাতে পাথরগুলোকে এভাবে নিখুঁত ভাবে সাজিয়ে রেখেছেন। একটু নাড়ালেই বুঝি উলট-পালট হয়ে যাবে সেসব। নীচের পাহাড়ের ঢালে কুলকুল ধ্বনিতে প্রবাহিত হচ্ছে স্বচ্ছ জলধারা।
আরও উপরের পাহাড় থেকে এই স্বর্গীয় সৌন্দর্য যেন কাশ্মীরের সৌন্দর্যকেও হার মানায়। উপরের ছোট্ট টং ঘর থেকে এ সব কিছু মুগ্ধ দৃষ্টিতে অবলোকন করছে তূর্য আর সংগীতা। সদ্য বিবাহিত দম্পত্তি ওরা।
শাহ জালাল আর শাহ পরানের মাজার, চা বাগান, সাস্ট- অনেক কিছু ওরা ঘুরলো এই ক’ দিনে। আজ ওরা এসেছে জাফলঙে। ওদেরকে এই পাহাড়ের চূড়ার টং ঘরে একা থাকতে দিয়ে তূর্যের মামাতো ভাই বোনেরা অন্য দিকে গেল। আবহাওয়াটাও আজ কেমন যেন রোমান্টিক। সংগীতাকে তূর্য বলেই ফেললো,
‘এই তোমার হাত দুটো মেল দেখি!’
অবাক হয়ে গেল সংগীতা! বলে উঠলো, ‘কেন?!’
‘আহা! করোই না একটু!’ – তূর্যের কন্ঠে অধৈর্যের সুর। একই সাথে তূর্যের চোখেও যেন কেমন এক কোমল চাহনি দেখতে পেল সংগীতা। একেই সম্ভবত ভালোবাসা বলে। অগত্যা দুরু দুরু বুকে চোখ বন্ধ করে দু’ হাত মেলে দিল ও। পেছন থেকে সংগীতাকে জড়িয়ে ধরলো তূর্য আর কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠল,
‘টাইটানিকের সিনটা নকল করলাম’!
‘তাই, না?’- বলে তূর্যের বুকে দমাদম কিল-ঘুষি মারতে লাগল সংগীতা। কোমল হাতের ঘুষি খেয়ে তূর্যের মুখে হাসি আর ধরে না। সেই হাসি দেখে আরেকবার মুগ্ধ হয় সংগীতা, মনে পড়ে ওর, এই হাসি আর এই কোমল চোখ দেখেই অচেনা-অজানা এক বাঙালি যুবক তূর্যের প্রেমে পড়েছিল ও। কেমন যেন অমোঘ আকর্ষণে এ দুটো চোখ ওকে তূর্যের সাথে বেঁধে ফেলেছিল আষ্টেপৃষ্ঠে।
দুই.
মুহূর্তেই তূর্যের চোখের চাহনির ভেতর দিয়েই একসাথে অনেক কথা মনে পড়ে যায় সংগীতার। ও রাঙ্গামাটির মেয়ে, চাকমা, সংগীতা চাকমা। বান্ধবীদের সাথে হেসেখেলেই দিন চলে যাচ্ছিল। অসম্ভব সুন্দরী আর মায়াবতী সংগীতার দিকে চোখ পড়েছিল তাদের পাড়ার অনেকেরই, কাউকেই পাত্তা দেয়নি ও। একদিন বলা নেই কওয়া নেই, পাড়ার হেডম্যানের একমাত্র ছেলের বিয়ের প্রস্তাব আসে সংগীতার বাবার কাছে। তখন সবে মাত্র ক্লাস নাইনে পড়ে সংগীতা। এই বয়সে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজী হননি ওর বাবা কমলকিরণ। মেয়েকে তিনি আরও পড়াতে চান। আর তা ছাড়া হেডম্যানের ছেলেটা পাড়ার বহু গরিব ঘরের মেয়ের সম্ভ্রমে থাবা দিয়েছে। হেডম্যানের ছেলে বলে কেউ কিছু বলতেও পারে না! কিন্তু কমলকিরণ হেডম্যানকে সরাসরি না করে দিলেন। তবুও হেডম্যান অনড়। কমলকিরণও কম প্রভাবশালী নয়। সন্তু লারমার সাথে খাতির আছে। ক’দিন আগে সন্তুকে ধরে অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনে সুপারিশ করিয়ে বড় ছেলেকে অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়েছেন। সুপারিশের জন্য গেলে সন্তু একগাল হেসেছে!
হাসতে হাসতে বললো, ‘কমলকিরণ, তুমি তো দেখি কোন খবরই রাখো না! ছেলেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় পাঠাবে, এর জন্য আমার সুপারিশের কি দরকার! গিয়ে দেখো, অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশন তোমার ছেলের নামের শেষের উপাধী আর চেহারা দেখেই ভিসা অ্যাপ্রুভ করে দেবে। না হয়, আমার কথা বললেই হবে!’ সত্যিই ছেলেকে ওরা খুব সহজেই ভিসা দিয়েছিল, ছেলে এখন অস্ট্রেলিয়ায় দিব্যি পড়াশুনা করছে। তবুও কমলকিরণের ধারণা, নিশ্চয়ই সন্তু অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনে ওর ছেলের জন্য সুপারিশ করেছে, নয়তো এত সহজে এই ছেলের ভিসা এপ্লাই অ্যাপ্রুভ হত না। হাইকমিশনের বিশেষ ব্যবস্থায় অস্ট্রেলিয়ান একটা ইউনিভার্সিটিতে বৃত্তিও পেয়ে গেছে! এবং সেই জন্য সে সন্তুর কাছে চিরকৃতজ্ঞ। সন্তুকে সে কথা দিয়ে এসেছে, এবার থেকে সন্তুর টোকেন আদায়কারী যাতে আশেপাশের গাঁয়ের সকলের কাছ থেকে ভালো উপরি পায়, সেই দিকটা সে দেখবে।
তাই সংগীতাকে হেডম্যানের ছেলের হাত থেকে বাঁচাতে এতটুকুও বেগ পেতে হয়নি কমলকিরণকে। এদিকে ক্লাস নাইনের চঞ্চল আর মিষ্টি সংগীতা স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হলো। কলেজে বান্ধবীরা সকলে এসে ঝাঁক বেঁধে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে নতুন ঝামেলা তৈরী হলো। রাঙ্গামাটি কলেজে হঠাৎ একদিন পাহাড়ি-বাঙালি উত্তেজনা সৃষ্টি হলো! কলেজে আসার পথে এক বাঙালি ছেলেকে মারধোর করেছে কারা যেন। কলেজের বাঙালি ছেলেরা সে জন্য উত্তেজিত। এদিকে পাহাড়ি ছেলেরাও থেমে নেই। পাশের কলেজ হোস্টেলটা কয়েক বছর ধরেই ওদের দখলে।
কলেজের ওপাশের দোতলা থেকে সংগীতা স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে হোস্টেলের পাশের জঙ্গলে মোটা মোটা লাঠি নিয়ে প্রস্তুত তার জাতি ভাইয়েরা। তাদেরকে কী কী যেন বলছিল সুগত দা। চাকমা ভাষায় বাঙাল খতমের শপথ নিচ্ছিল সবাই যেন। সংগীতা রাজনীতি বুঝে না, হানাহানি পছন্দ করে না। খুব ভয় পায় রক্ত আর অস্ত্রকে। একবার সন্তু কাকার সাথে সুগত দা এসেছিল তাদের বাসায়। সন্তু কাকার পাশের বডিগার্ডের ভয়ালদর্শন অস্ত্র দেখে তার মূর্ছা যাবার দশা। সন্তু কাকা হেসে হেসে অনেকবার গায়ে হাত বুলিয়ে অভয় দেবার চেষ্টা করলেন, তবুও উল্টো সংগীতা যেন আরও কুঁকড়ে যাচ্ছিল। এরপরেও বহুবার বিভিন্ন কারণে তাদের বাসায় এসেছিল সুগত দা।
হঠাৎ স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে উঠল কলেজ ক্যাম্পাস। সংগীতা আর ওদের বান্ধবীরা কেউই বের হতে পারছে না কলেজ থেকে। হঠাৎ করে কলেজ হোস্টেলের জঙ্গলের ওদিক থেকে মুহুর্মুহু কান্তাগুলি ছোড়া হল উল্টোদিকের শহীদ মিনারে কাছে অবস্থানরত বাঙালি ছেলেদের দিকে। একটা বাঙালি ছেলের মাথা ধরে হঠাৎ সঙ্গীরা হৈ হৈ করে চিৎকার শুরু করল, মাথা ফেটে গেছে ছেলেটার। বেশ কিছুক্ষণ ওখানেই রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা শুরু হল। ছেলেটার কপালে পট্টি বেঁধে একটা গাছের নীচে বসিয়ে রাখা হল। সংগীতাদের দোতলা থেকে এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ছেলেটাকে। কেমন যেন মায়াবী ছেলেটার চোখ, কী ভেবে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল সে ছেলেটার দিকে। হঠাৎ শুরু হয়ে গেল ইট-পাটকেল নিক্ষেপ! এ এক গগণবিদারী অবস্থা।
এরপরের অবস্থা যেন নরকের বিভীষিকাকেও হার মানায়। মুহুর্তের ভেতর মারামারি শুরু হয়ে গেল পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে। দা আর কিরিচ নিয়ে হল থেকে বের হলেন সুগত দা আর তার কিছু সঙ্গী। এরপর রীতিমত রক্তারক্তি কাণ্ড। ঐ ছেলেটার কপালের রক্ত কিছুতেই বন্ধ করা গেল না, ভয়ঙ্করভাবে রক্তে ভেসে গেল তার গোটা মুখ! ছেলেটা কি মারা যাবে? সেদিন আবারও মূর্ছা গেল সংগীতা। রক্ত সে একদমই সহ্য করতে পারে না। এরপর আর কিছু মনে নেই তার।
তিন.
তূর্যের বুকের ভেতর হঠাৎ করেই শিউরে উঠল সংগীতা। আর চিন্তা করতে ইচ্ছে করছে না তার। তূর্যও বুঝতে পারছে। তাই বুকের ভেতর লুকিয়ে রেখেছে তার প্রেয়সীর ভয়ার্ত মুখ। যেন শপথ করেছে, জগতের সব অপশক্তির কাছ থেকে দূরে রাখবে সে সংগীতাকে। বাসায় ফেরার সময় হয়ে গেছে। তূর্যের মামাত বোন সোনিয়া আর সামিয়াদের সামনে একটু অপ্রস্তুত অবস্থায়ই পড়তে হলো ওদের। তা দেখে দৌড়ে ভাগলো সামিয়ারা। তবুও দ্রুত সামলে নিল ওরা। সন্ধ্যা নামছে জাফলং-এর বুকে। অপরূপ সুন্দর দূরের জাফলং এর পাহাড় রাশির মাঝে অস্তমিত সূর্যকে দেখে বারবার নিজ গ্রামের কথাই মনে পড়তে লাগল সংগীতার। নিজ গ্রামের কথা ভাবতে গিয়ে হঠাৎ করে নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস নেমে এল ওর।
সন্ধ্যার সাথে সাথে আস্তে আস্তে শীত নামছে। বছরের এই সময়টায় সিলেটে বেশ শীত পড়ে। জাফলং-এ রীতিমত হিমশীতল শীত। ইতোমধ্যেই ব্যাগ থেকে শীতের পোষাক পরে নিয়েছে ওরা দু’ জন। তবুও তূর্যের বুকের উষ্ণতা মিস করতে লাগল সংগীতা। সেটা আঁচ করতে পেরেই কিনা কি জানি, তূর্য শাল-চাঁদরটা সংগীতাসহ নিজের সাথে জড়িয়ে সংগীতার মাথা নিজের বাহুতে এলিয়ে নিয়ে একসাথে পথ চলতে শুরু করল। সংগীতা আরও একবার অনুভব করল, কিছুদিন আগেও অচেনা-অজানা থাকা এক বাঙালি যুবকের অসীম ভালোবাসা। নিজেকে আজ খুব ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে ওর।
আজ ওরা এল মাধবকুন্ড ঝর্ণায়। অনেকবার ঝর্ণা দেখেছে সংগীতা, পাহাড়ি ছলছলে কলকলে ঝর্ণা। তবুও এসেছে সবার অনুরোধ না ফেলতে পেরে। বছরের এ সময়ে ঝর্ণায় তেমন একটা পানি থাকে না, এখানেও খুব নেই। ঝর্ণার উদ্দামতা দেখা যায় বর্ষায়। ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল সংগীতার। আবারও ফিরে গেল ভয়ঙ্কর আর মধুর স্মৃতিগুলো রোমন্থনে।
চার.
জ্ঞ্যান ফেরার পর সংগীতার আর কিছুই মনে নেই। শুধু মনে পড়ল মাথা ফেটে যাওয়া সেই বাঙালি ছেলেটার কথা। ঘন লাল রক্তও তার মায়াবী চোখ দুটোকে আলাদা করতে পারছিল না। এই চোখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল ও। এখন পর্যন্ত জ্ঞান ফেরার পর সেই চোখের কথাই ভালো করে মনে আছে ওর। হঠাৎ করে লজ্জা পেল সংগীতা, এসব কি ভাবছে সে! অচেনা-অজানা কোথাকার কোন বাঙালি ছেলে। মন থেকে দূর করে দিতে চাইল ভাবনাটা। কিন্তু এই ভাবনাতে কেমন যেন একটা পুলক আছে, এই পুলকের অস্তিত্ব আগে কখনও টের পায়নি ও! তাই ইচ্ছে সত্ত্বেও ভাবনাটাকে দূর করাতে পারল না সংগীতা।
এদিকে কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ, জানাল ওর বান্ধবী কলি। কথাটা শুনে কিছুটা মনক্ষুন্নই হয়েছে যেন ও। কলেজে যেতে কেন যেন আনচান করছে ওর মন। কেমন আছে ঐ ছেলেটা কি জানি। ও কি সুস্থ হয়ে উঠেছে? আচ্ছা অচেনা এক ছেলের জন্য ওর এত দরদ উথলে উঠছে কেন? তাও আবার বাঙালি! ভাবা যায়! নিজেকে সতর্ক করল সে। কিন্তু নিজেই যেন সেই সতর্কবানীকে থোড়াই কেয়ার করল। কলেজে ওর যেতে হবেই হবে। কবে খুলবে কলেজটা?
ঠিক তিন দিন পরই সুখবরটা পেল সংগীতার কাছে, কলেজ খোলা হয়েছে। এই তিনটা দিন যেন তিনটা বছর ছিল সংগীতার কাছে। নিজে নিজেই খুশিতে কয়েকবার লাফ দিয়ে উঠেছে ও, বিষাদময় মুখে আনন্দের ফোয়ারা ফুটছে যেন। পরেরদিন বেশ দ্রুতই রেডি হয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা হতে চাইল সংগীতা। বাঁধ সাধলেন বাবা, বললেন কলেজের পরিস্থিতি আরও শান্ত হোক। কলেজের পরিস্থিতি গোল্লায় যাক– মনে মনে ভাবল ও। কিন্তু বাবার কথার পেছনে একটি কথাও উচ্চারণ করতে পারল না সে। নিজের রুমে এসে ছোট্ট বালিকাদের মত ফুঁপিয়ে কাঁদল কিছুক্ষণ ও। আরও দুইদিন পর অনুমতি মিলল, এবার কলেজে যাওয়া যেতে পারে। নিজের কাছে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, ঐ অচেনা বাঙালি যুবকের প্রেমে পড়েছে সে।
এতদিনের সৃষ্ট বিরহ যে কখন প্রেমে রূপ নিয়েছে সেটা নিজেই সম্ভবত টের পায়নি এতদিন। লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট- কথাটা আগেও অনেকবার শুনেছে ও। কিন্তু নিজের বেলায়ই সেটা রূপ নেবে এভাবে, সেটা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি ও। আজ যেন অনেকগুলো খুশির ছটা ওর মুখে যেন আছড়ে পড়ছে।
পাঁচ.
অনেক উৎসাহ নিয়ে পরদিন কলেজে গেল ও। অকস্মাৎ মনের ভেতর একটা ভয় উঁকি দিয়ে উঠল। ঐ ছেলেটা আজ আসবে তো? সে আসলেই বা কি! সে তো জানে না সে ওকে ভালোবেসে ফেলেছে। আর জানলেই বা কি। সেও কি তাকে ভালোবাসবে? এরকম বহু প্রশ্ন জমা হতে লাগল তার মনে। বেশিদূর এগুতে হল না, ছেলেটিকে পাওয়া গেল বন্ধুদের সাথে আড্ডারত অবস্থায়। হাতে গিটারের টুং টাং, মসৃণ ঘন কালো চুলগুলো বাতাসের সাহায্যে বারবার ঢেকে দিচ্ছিল মায়াবী চোখ দুটোকে। তবে চোখের পাশের ব্যান্ডেজটা কিম্ভূতকিমাকার মনে হচ্ছে। আর তার হাসিটা এত সুন্দর কেন? তার সবকিছুই যেন ভালো লাগছে! প্রেমে পড়লে কি মানুষ এমন হয়ে যায়? মুগ্ধ চোখে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল সে ছেলেটার দিকে।
আরে! এখনও ছেলে ছেলে মনে হচ্ছে কেন? ওর নামটাই তো জানা হল না। কী করা এখন? এই কিউট ছেলেটাকে তার চাইই চাই! কলির কথায় যেন সম্বিৎ ফিরে পেল ও।
‘কিরে তোকে এত অস্থির দেখাচ্ছে কেন? ভয় লাগছে?’ – কলির আন্তরিকতাপূর্ণ ডাক। আচ্ছা কলিকে কি ব্যাপারটা খুলে বলা যায়? ও আবার কাউকে বলে দেবে না তো? তাহলেই সর্বনাশ! মনের সাথে অনেকক্ষণ যুদ্ধ শেষে ও সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলল, কলিকে সব খুলে বলবে সে।
‘কী!’ –সংগীতার কথা শুনে রীতিমত চিৎকার দিয়ে উঠল কলি!
‘তুই আর ছেলে পাসনি প্রেমে পড়ার?’ – কলির অবাক প্রশ্ন। কলির প্রতিক্রিয়া দেখে খুব ভয় পেয়ে গেছে সংগীতা। ও যদি আবার রেগে গিয়ে কাউকে বলে দেয়? কী ঘটবে চিন্তা করতেই মাথাটা ভনভন করতে লাগল ওর।
‘আমি তো ওকে ভালোবাসি, ভালোবাসা কি অপরাধ?’ – কলিকে সুধায় ও।
‘কিন্তু স্যাটেলার বাঙালিকে বাসা অপরাধ। তুই জানিস না এই কথা তোর বাবা অথবা পিসিপি’র ওরা শুনলে কী করবে? ঐ ছেলেকে আস্ত রাখবে ভেবেছিস?’ – কলি ওকে বুঝায়।
‘আমি জানি। আর জেনে শুনেই বিষপান করছি। আমি ওকে কতটুকু ভালোবাসলে এত বিপদকে তুচ্ছজ্ঞান করতে পারি, একবার ভেবে দেখ’ – সংগীতার মুখের কথা শুনে এবার দ্বিধায় পড়ে যায় কলি।
‘আমি তোকে ছাড়া আর কাউকে ভাবতেও পারছি না যে আমাকে হেল্প করবে। প্লিজ দোস্ত, একমাত্র তুইই পারবি আমার ভালোবাসা সত্যি করতে। বুদ্ধ তোর অনেক মঙ্গল করবে…প্লিজ’ – সংগীতার কন্ঠে আকুতি। সংগীতার চোখে এরকম আকুতি কখনও দেখেনি আগে। বড্ড মায়াবী আর সুইট মেয়েটা এরকম করে বললে পাষাণের হৃদয়ও গলে যাবে। কলিও গলে গেল, আর তা ছাড়া সংগীতাকে সে প্রচণ্ড ভালোবাসে! বান্ধবীর এ সময়ে আসলেই আর কেউ সাহায্য করতে পারবে না সে ছাড়া। সেও মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল, যত যা-ই হোক, সংগীতাকে সে সাহায্য করবেই। ভয়ঙ্কর এক বিপদে নিজেকে জড়িয়ে নিল নিজেকে – উপলব্ধি করল কলি। তবে এ বিপদে নিজেকে জড়িয়েও এক তৃপ্তি আছে।
‘আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে’– পেছন থেকে কলির কণ্ঠ শুনে ফিরে তাকাল ছেলেটি, চোখে সন্দেহ। ‘দেখুন তূর্য দা, আমাকে ভুল বুঝবেন না, একটা কথা বলার আছে আপনাকে আমার। যদি পারেন একটু কলেজের পেছন দিয়ে যে লেক পেরিয়ে একটা মাজার আছে, সেখানে আগামী কাল বিকেল ৪ টায় দেখা করতে পারবেন?’ সন্দেহে ভ্রু কুঁচকে উঠে তূর্যের। একে তো কয়েকদিন আগের পাহাড়ি-বাঙালি দাঙ্গা হল, এখনও সেই ক্ষতের দাগ এখনো শুকায়নি তার শরীর থেকে। স্বাভাবিকভাবেই যেখানে একটা পাহাড়ি মেয়ের সাথে এক বাঙালি ছেলে আসলে সমস্যা আর হুমকিতে পড়ার সম্ভাবনা ব্যাপক, সেখানে এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে তো আরও বিপজ্জনক ব্যাপারটা। তার উপর পাহাড়ি মেয়েদের এই মুহূর্তে বিশ্বাস করাটাও কঠিন, কখন কোন ফাঁদে পড়ে যাই, ঠিক নেই – একসাথে অনেক দুশ্চিন্তাই মাথায় ভর করল তূর্যের!
‘আমি জানি আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে ভয় পাচ্ছেন, তবুও বলছি প্লিজ…আসুন, আপনার কোন ক্ষতি হবে না…’ – তূর্যের মনের অবস্থা বুঝতে পেরেই হয়ত কলি অভয় দেয়ার চেষ্টা করল। তূর্য খেয়াল করল, মেয়েটাকে অমন মনে হচ্ছে না, ভদ্রই মনে হচ্ছে। তবুও চুড়ান্ত কথা দিতে কেমন যেন করছে ভেতরে।
‘কেন?’ – জিজ্ঞেস করল সে।
‘প্লিজ…বিলিভ মি…আমি সব বলব আপনাকে…কিন্তু এখানে বেশিক্ষণ কথা বলাটা ঠিক হচ্ছে না…ইতোমধ্যেই সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছে অনেকে…’- আকুতি ঝরে পড়ল কলির কন্ঠে।
‘আচ্ছা দেখি…চেষ্টা করব আসতে…’- জানাল তূর্য।
‘কি!’ – শুনেই চমকে উঠল সাগর, তূর্যের জিগরি দোস্ত! চোখ দুটো গোল আলুর মত বড় করে আরও বলল,
‘তোর মাথা কি খারাপ হয়েছে নাকি রে?! তুই মামা নিজেও মরবি, আমারেও মারবি! কোথাকার কোন চাকমা মেয়ে তোরে ডাকছে, আর তুইও একেবারে…’ – সাগরের চোখে ভয় আর তিরস্কার!
‘আরেহ মামা! মেয়েটারে খারাপ মনে হয় নাই, ভালোই মনে হইলো। আর মনে হয় গুরুত্বপূর্ণ কোন কথাই বলতে চাচ্ছে।
‘ঐ যে কি জানি নাম…কলি…কলিরে চিনস না? ওই মেয়েটা’। -কলির পক্ষ নেয় তূর্য।
কলির কথা শুনে এবার দ্বিধায় পড়ে যায় সাগর। কলি মেয়েটা ভালো, বেশ ভদ্র। সবার সাথে অনেক হাসিখুশি থাকে, বাঙালি-পাহাড়ি নিয়ে সংকোচ নেই – কয়েকদিন লুকিয়ে লক্ষ্য করার ফল এসব অনুসিদ্ধান্ত! মেয়েটাকে কেমন যেন ভালো লাগে সাগরের। অবশ্য ভয়ে কাউকে বলেনি, এমনকি নিজের বন্ধুদেরও না। কিন্তু কলি তূর্যের সাথে দেখা করতে চায় কেন? তবে কি কলি তূর্যকে পছন্দ করে?! হায় আল্লাহ! ধুর! কি সব বাজে চিন্তাভাবনা মাথায় আসছে – ভেবে নিজের উপর বিরক্ত হল সাগর। মেয়েটা কী বলতে চায় শুনা উচিৎ।
‘ওকে…বাট সতর্ক থাকতে হবে…পোলাপাইনরে দিয়া আগে থেকে রেকি করিয়ে রাখতে হবে…তারপর পাহারার ব্যাবস্থা করতে হবে’ – সাগর এখনও বিশ্বাস করতে রাজী না।
‘নাহ! দোস্ত! চাক্কুগো আনাগোনা দেখলাম না’ – ফোনে জানাল সায়েম, তূর্য আর সাগরের বন্ধু। সায়েম, তালহা আর রনি গিয়েছিল মাজারটা রেকি করতে! এটা একসময় মাজার থাকলেও এখন একটা প্রাসাদ! কে যেন চারদিকে কাপ্তাই লেকের বিশাল জলরাশির মাঝের ছোট্ট দ্বীপটাতে বিকট এক প্রাসাদ নির্মাণ করেছে, একেবারে সাদা ফকফকা! জায়গাটা ভয়াবহ সুন্দর। লেকের নীল জলরাশির ওপাশে ক্যান্টনম্যান্টের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য। কলি সেখানেই দেখা করতে বলেছিল তূর্যকে। মেয়েটার চেহারার আকুতি দেখে যেতে রাজী হয়েছে তূর্য। আর ঝুঁকি জেনেও, কৌতুহল তাদেরকে তাড়িয়ে ফিরল। যাবেই তারা, দেখতে চায় কী আছে এই আকস্মিক ও রহস্যময় আমন্ত্রণে। বিপদ এলেও সই।
সেই দ্বীপটাতে যাওয়ার সমস্ত পথে নজর রাখছে তূর্যের বিচ্ছু বন্ধুগুলো। নাহ! সন্দেহজনক কিছুই পেলনা তারা। যাওয়ার অনুমতি দিল তূর্যকে, সাথে যাবে সাগর। কিছুক্ষণের মধ্যেই রওনা দেবে তারা আর বাকীদের কেউ পাহারা দেবে, কেউ বা আশেপাশে অবস্থান নেবে। বিপদে পড়ার সম্ভাবনা কম, কারণ এই দ্বীপের একপাশে লেকের জলরাশির পরই রাঙ্গামাটি আর্মি ক্যান্টনমেন্টের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য। আধাঘন্টা পরপরই সেনাবাহিনীর দ্রুতগামী স্পিডবোট টহল দিচ্ছে। স্যাবোটাজের প্ল্যান থাকলে এই জায়গাটা বেছে নিত না সুগতের চ্যালাফ্যালাগুলো।
বিকেল ৩ টায় পূর্ব-পরিকল্পনামত কলি এসে ডেকে নিয়ে গেল সংগীতাকে। আজকে প্রাণভরে সেজেছে ও। অনেক সুন্দর লাগছে, সেটা নিজেও জানে সংগীতা। একটু লুকিয়ে যেতে হবে, কারও চোখে পড়লে সমস্যা। বাসা থেকে এক বান্ধবীর বাসায় যাবে বলে বেরিয়েছে। কলেজটা বিকেল চারটার রোদে খাঁ খাঁ করছে। পাহাড়ি-বাঙালি সমস্যাটার পর ছাত্রাবাসটা বন্ধ হয়ে আছে আপাতত। তাই আপাতত কারও চোখে পড়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কলেজে ঢুকবে, এমন সময় হঠাৎ করে সামনে পড়ে গেল সুগত দা! ঘটনার আকস্মিকতায় ভয় পেয়ে গেছে সংগীতা আর কলি।
সুগতও কিছুটা অবাক, তবুও তাকিয়ে একটা ভেতো হাসি দিয়ে কই যাচ্ছে তারা জানতে চাইল। থতমত করে কলিই জবাব দিল, সামনে একটা ফ্রেন্ড তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সুগত দা কিছু সন্দেহ করেছে বলে মনে হল না। তবে লোকটার চোখ আর হাসিটার দিকে তাকাতে পারে না সংগীতা। কেমন যেন নিষ্ঠুরতা খেলা করে সেখানে। গতকালও একবার তাদের বাসায় এসেছে সে। যাই হোক, এই সুন্দর সময়ে এসব মন থেকে জোর করে দূর করে দিতে চাইল সংগীতা, এমনিতেই তূর্যের সামনে দাঁড়াতে হবে বলে কাঁপছে বুকটা, তার উপর নতুন ভীতি। তবুও আপাতত একটা প্যারা থেকে বাঁচা গেল বলে রক্ষে।
ছয়.
এই মেয়েটিকে দেখলেই ভেতরের এক পশু যেন জেগে উঠে সুগত চাকমার মনে। হিংস্র, বন্য এক পশু। কিন্তু কী করবে বুঝতে পারছে না সে। কমলবাবুর বাসায় এখন নিত্য আসা যাওয়া করে, কারণে-অকারণে। কেন আসা যাওয়া করে, সেটা কেবল সে নিজেই বুঝে, এমনটা ভাবা ভুল হবে। অথচ, মূল কাজে এগুতে পারল না একটুও। সুগতের এখন যে প্রভাব, ভবিষ্যৎ নিশ্চিত উজ্জ্বল, একথা চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়। এই বয়সে রাঙামাটি কলেজের পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ বা পিসিপি’র সভাপতি। ভবিষ্যতে যে জনসংহতি সমিতি’র ভালো পোস্টে যাবে, এটা সুগতও ভালো বোঝে। সন্তু বাবুও ভালো চোখেই দেখে।
নতুন এলাকায় রশিদ আদায়ের দায়িত্ব পেয়েছে। এই বয়সে এমন দায়িত্ব সাধারণতঃ দেয়া হয় না। কলেজেও দাপট দেখানো যাচ্ছে, বাঙ্গাল-বিরোধী সেন্টিমেন্ট দারুণ ভাবে কাজে লাগছে। কলেজ কর্তৃপক্ষও এখন তার কথা মেনে চলতে বাধ্য হয়। কলেজে সকলে ইউনিফর্ম পরে যাবে – কর্তৃপক্ষের এমন নায্য সিদ্ধান্তও গায়ের জোরে ঠেকিয়ে নিজের প্রভাবের প্রমাণ দিয়েছে আরেকবার। তার নিজ এলাকা রাজস্থলিতেও বেশ প্রভাব-বলয় তৈরী করেছে। চাইলেই টাকা, নারী, অস্ত্র – সব পাচ্ছে।
সাংবাদিকদের সাথেও ভালো খাতির। ডিসি অফিসের নিরাপত্তা সংক্রান্ত মিটিং-এ অংশ নিয়েছে বেশ কয়েকবার। বোঝায় যাচ্ছে প্রশাসনও তাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এখনই পাক্কা পলিটিসিয়ান হয়ে উঠছে সে। কমলকিরণের মত পাবলিককে তোয়াজ না করলে কিচ্ছু আসে যাবে না সুগতর। কিন্তু মেয়েটা তো কমল বাবুরই। সমস্যাটা সেটাই। নাহ! কমলবাবুর উপর নির্ভর করার কী দরকার? নিজেই তো কাজে নেমে পড়ে যেতে পারে। আর কারও বেলায় এত দেরী করেনি সুগত। এর বেলায় একটু রয়ে সয়ে শুরু করতে চেয়েছিল। কিন্তু মেয়েটা শালার পাত্তাই দিচ্ছে না। আঙ্গুল বাঁকা করতে হবে – আঞ্চলিক পরিষদের গেস্ট হাউজের দিকে যেতে যেতে ভাবছে সে।
সাত.
নির্জন ছোট্ট দ্বীপে দাঁড়িয়ে আছে তূর্য আর সাগর। প্রায় ১৫ মিনিট হতে চলল ৪ টার পর, এখনও কোন খবর নেই। সময় যাচ্ছে না যেন! হঠাৎ করে মনে হল একটা ডিঙ্গি নৌকা এদিকেই আসছে। হ্যাঁ, সেখানে পাহাড়ি ড্রেস পরা দুইজন মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আসবে তো কেবল কলি, সাথে আরেকজন কে? আস্তে আস্তে চেহারাটা স্পষ্ট হল তূর্যের কাছে। এই মেয়েটাকে আগেও দেখেছে সে! এই তো সেই মেয়েটা! সেদিন সংঘর্ষের সময় রক্তাক্ত অবস্থায় যখন, গাছের নীচে বসে ছিল তূর্য, তখন এই মেয়েটাই তো নিস্পলক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ করে অজ্ঞানও হয়ে গিয়েছিল! এই মিষ্টি চেহারা কি ভুলা যায়?
ডিঙ্গি থেকে নামল ওরা দু’ জন। এসেই কলি ক্ষমা প্রার্থনার সুরে বলল,
‘দেরি হওয়ার জন্য সরি’।
‘না ঠিক আছে। সমস্যা নেই’ – বলে ওকে আশ্বস্ত করল সাগর। তূর্যের সেদিকে খেয়াল নেই। সে তাকিয়ে আছে পাশের মেয়েটার দিকে, মেয়েটা মাথা নিচু করে আছে। গালে যেন লজ্জায় রক্ত জবার মত লাল আভা ফুটে উঠেছে। তূর্যের এমন অবস্থা বুঝতে পেরে বিব্রত সাগর, গলা পরিস্কার করার শব্দ করে বাস্তব জগতে ফিরিয়ে আনল সে তূর্যকে।
‘চলুন প্রাসাদের ওদিকটায় যাই?’ – বলে পরিবেশটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল কলি।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। চলুন – বলে পথ দেখাল যেন সদ্য দুনিয়াতে ফিরে আসা তূর্য! সেটা দেখে নিঃশব্দে মুচকি হেসে উঠল সংগীতা।
‘তো আসল কথা শুরু করি?’- বলল বিপদের আশংকায় উদ্বিগ্ন সাগর।
‘হ্যা…ইয়ে…আসলে কীভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না…’ – বলল কলি।
‘শুরু করুন শুরু থেকে। সিজারকে এই কথাই তো বলেছিলেন কিং অভ হার্টজ’ – কলির মুখের কথা কেঁড়ে নিয়ে বলল তূর্য। আড়চোখে দেখছে সংগীতাকে বারবার। আর সংগীতা এখনও মুখ তুলে চাইতে পারেনি একবারও।
‘আসলে ব্যপারটা শুরু হয়েছে সেদিনের গোন্ডগোলের দিন থেকে…’ – কলি বলতে শুরু করল।
‘কোন ব্যাপারটা?’ – জানতে চাইল সাগর।
‘আসলে সেদিনের গোন্ডগোলের পর থেকে আমার বান্ধবী সংগীতা তূর্য দাদাকে পছন্দ করে ফেলেছে, সেটা এখন রূপ নিয়েছে অব্যক্ত ভালোবাসায়…’ – এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলল কলি। সাথে সাথে আশেপাশটা যেন আরও নীরব হয়ে গেছে, কারও মুখে কোন কথা নেই, শুধু মেহেদি পরা শুভ্র দু’ হাত দিয়ে মায়াবী মুখখানা ঢেকে ফেলেছে সংগীতা। একটা নীরব বোমা পড়েছে যেন স্থানটিতে। কথা বন্ধ হয়ে গেছে সাগর আর তূর্যের।
‘তূর্য দা, আমার বান্ধবী আপনাকে পাগলের মত ভালোবাসে। ওকে ভুলভাবে নেবেন না। শত বাঁধার মুখে পড়বে জেনেও আপনার ভালোবাসার হেমলক সে গ্রহণ করেছে। প্লিজ, তাঁকে ফিরিয়ে দেবেন না…’ – কলির কন্ঠ ভারী হচ্ছে কেন যেন। থ হয়ে গেল তূর্য কিছুক্ষণের জন্য! এসব কী হল! এমনভাবে সবকিছু হাতের কাছে ধরা দেবে ভাবতে পারেনি সে। স্বপ্ন দেখছে না তো? তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে,
‘হ্যাঁ, আমি রাজী সংগীতা, আমি থাকতে চাই তোমার শুভ্র হাতখানি ধরে সারাজীবন’।
কিন্তু এত্ত সহজে বলতে ইচ্ছে করছে না! একটু ভারী হতে হবে, কিন্তু ভাষার যেন তখন ব্যাপক সংকট দেখা দিয়েছে। আর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে সংগীতার, সাড়া দেবে তো তূর্য? আচমকা সংগীতার মনে হলো, ওর কোমল হাতখানি রুক্ষ আর কঠোর কিছুর স্পর্শ পাচ্ছে। হ্যাঁ, ওর হাত ধরে ওরই সামনে হাটু গেড়ে বসে তূর্য বলেই ফেলল,
‘আমি ভালোবাসি তোমায়’। সামান্য কয়েকটা শব্দ, কিন্তু রীতিমত রোমাঞ্চের কম্পন বইয়ে দিল সংগীতার শরীরজুড়ে, চোখ দিয়ে কিছুটা অশ্রুও কি নয়? সেই অশ্রু ফোটা তূর্যের আঙুল মুছে দিল, এখন কি আর কাঁদার সময়?
আট.
‘কী ভাবছ?’ – বলে ঘোরের জগত থেকে সংগীতাকে চমকে দিয়ে বের করে আনল তূর্য। ‘না কিছু না’– বলে স্মিত হাসল ও। বাবা-মা’কে ছেড়ে পালিয়ে এই বিদেশ-বিভূঁইয়ে হয়তো মন টিকছে না সংগীতার, বারবার তাদের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে – এমনটা ভেবে সংগীতাকে অনেক সাপোর্ট দিচ্ছে তূর্য। সবসময় পাশেপাশে থাকছে। ‘চলো লক্ষীটি, যাওয়ার সময় হয়েছে’– বলে সংগীতাকে নিজের বাহুতে জড়িয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল তূর্য।
আজ পহেলা ফাল্গুন। শীত শেষ, কিন্তু শীতের আমেজ রয়ে গেছে। সিলেট এমসি কলেজে জোড়ায় জোড়ায় ললনারা বাসন্তি শাড়ি পড়ে ফাল্গুন উদযাপনে এসেছে। এর মধ্যে সংগীতাকে যেন তাদের মাঝে বিশেষভাবেই আলাদা করা গেল। বাঙালি ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ, বাঙালি নারীদের যেই পোষাকে সবচেয়ে সুন্দর লাগে, সেই শাড়ি পড়ে আজ এদিকে ঘুরতে এসেছে সংগীতা, সাথে তূর্য। মেয়েটাকে শাড়িতে অদ্ভুদ সুন্দর লাগছে– সংগীতাকে নতুন করে আবিস্কার করে তূর্য ভেতরে ভেতরে শিহরিত হলো। বলেও দিল তাকে কথাটি, লজ্জায় লাল হয়ে গেছে সংগীতার ফর্সা গাল।
চিবুক ধরে মুখটা তুলতেই যেন ক’টা অশ্রুফোটা দেখল তূর্য তার চোখে, জানে এই জল দুঃখের নয় বরং অপরিমেয় সুখের। মুছে দিল সে যত্ন করে প্রিয়তমার অশ্রুফোঁটা। বিশেষ করে অন্য জাতির হওযা সত্ত্বেও তুর্যের আত্মীয় স্বজনরা যে এতটা সহজে, এতটা আন্তরিকতার সাথে সংগীতাকে গ্রহণ করে নিয়েছে এটাই তাকে সবচেয়ে বেশী আপ্লুত করছে। শুধু আত্মীয় স্বজন কেন, মোবাইলে সে তুর্যের বাবা মায়ের সাথে কথা বলেছে। তুর্যই বলিয়ে দিয়েছে। খুব সহজে তারা সংগীতকে তাদের পরিবারের একজন হিসাবে মেনে নিয়েছে। এত সুখ কেন এই ধরায়? এত বেশি সুখ সহ্য হচ্ছে না যেন, আবার ভয়ও হয় সংগীতার এই সুখ কখনও হারিয়ে ফেলতে হয় যদি।
নয়.
নিজের রুমে সংগীতা। তূর্য কী কাজে যেন বাইরে গেছে। আবার মনে পড়ে গেল সেই দিনগুলোর কথা। অনেক চাইলেও এই সুখ-দুঃখে ভরা স্মৃতি রোমন্থন করতে ইচ্ছে করছে তার।…
সুগতের মনে হল, এইবার সময় এসেছে। একটু বাজিয়ে দেখতে হবে মেয়েটাকে। নয়তো আঙুল বাঁকা না করে উপায় নেই। মেয়েটা আগুনের মত, পাগল করে দিচ্ছে। চ্যালাপ্যালাদের কথাটা বলল সে। সবাই খুব মজা পেল। হেসে হেসে সমর্থন দিল। আজ সে সংগীতাকে শুভলং যাবার প্রস্তাব দেবে। শুভলং-এ কটেজের মালিকগুলো সব তার পরিচিত। একবার মেয়েটাকে বাগাতে পারলে হয়….।
এদিকে সায়েম কিছুতেই ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে বা মানতে রাজী নয়। তার ধারনা তূর্যসহ সকলকে ফাঁসাতে এটা চাকমাদের একটা চাল। ঐ মেয়েটা কমলকিরণ বাবুর মেয়ে সেটাও স্মরণ করিয়ে দিল, যার সাথে সন্তুর বেশ খাতির আছে বলে শোনা যায়।
‘তুই কি বলতে চাচ্ছিস, কমলকিরন বাবু আমাদের ধরার জন্য নিজের মেয়েকে লেলিয়ে দেবে?’ –প্রশ্ন ছুড়ল তালহা।
‘আর কমলকিরণ বাবু তো রাঙামাটি সদরের লোক না, কয়েকদিন আগের ঝামেলায় তার কোন সম্পৃক্ততাও নেই। সে তো জেএসএস– এর কোন পদে টদেও নেই। সে এসবে নাক গলাতে যাবে কেন?’ – তালহাকে যুক্তিপূর্ণ সমর্থন দিল রনি। সবাই মিলে আলোচনা করছে। সায়েম, তূর্য, সাগর, তালহা, রনি, আবরার আর ফারুক।
‘আমি এত কিছু বুঝি না মামা, আমি ওরে ভালোবাসি ব্যস! ও ভালবাসলেই হইলো, ও কার মেয়ে সেটা নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে চাই না। আমার মনে হয় ও আমারে ভালোবাসে, ওর মুখের দিকে তাকিয়েই আমি বিশ্বাস করছি। আই লাভ হার, শি লাভস মি, দ্যাটস অল। তোরা পারলে হেল্প মি আউট, নয়তো বাদ দে, প্রয়োজনে আমি একাই নরকে যাব’– তূর্যের সোজাসাপ্টা জবাব।
‘আমি কি তোরে সেটা বলছি? তুই নরকে গেলে আমরা যাব না, এইটা তুই ভাবলি ক্যামনে? – সায়েমের সুরে অভিমান। মুচকি হাসল তূর্য লুকিয়ে, ফাঁদে ফেলা গেছে ওদেরকে। ও জানত বন্ধুরা ওর ভালোর জন্যই বলছে, কিন্তু একটা পার্ট নিল আর কি!
‘তাহলে পরশু সংগীতার সাথে সুখিনীলগঞ্জ দেখা করব, তোরা গার্ড দিবি’ – চোখেমুখে ষড়যন্ত্রের ভাব এনে বলল তূর্য!
‘তাই রে! এই জন্যই এত পার্ট নিচ্ছিস নারে ব্যাটা?’– সবাই তেড়ে এল ওকে ধরতে। তূর্য পালিয়ে বাঁচে!
দশ.
‘সংগীতা ইদু এজ’– ডাক শুনে তাকাল সংগীতা। দেখল সুগত দা’র সাথের একটা ছেলে ডাকছে ওকে। হঠাৎ করে ভয় পেল ওর। দেখেছে নাকি ওকে তূর্যের সাথে আবার! ভয়ে ভয়ে গেল সামনে। ‘হেইল্লা শুভলং যাবা নাহি?’– জিজ্ঞেস করল আরেকজন। ‘নো জেইম’- বলেই হন হন করে চলে গেল ও। একই সাথে অবাক ও অপমানিত বোধ করল সুগত। চ্যালাপ্যালাদের সামনে একটা মেয়ে ওকে এভাবে দাম না দিয়ে চলে যাবে ভাবতে পারেনি! লাল হয়ে উঠল ওর মুখ! মুখ দিয়ে ছুটল অশ্রাব্য ক’টা গালি! মেয়েটার উপর নজর রাখতে বলে দিল দুইজনকে।
সংগীতার একটু ভয় লাগছে, সুখীনীলগঞ্জ চিড়িয়াখানাও ঝুকিপূর্ণ। দু’য়েকটা পাহাড়ি ঘরও আছে। তবু আশা, তূর্যরা একটা ব্যবস্থা করবেই। ভয়ে ভয়েই গেল সুখীনীলগঞ্জ। পরনে বাঙালি ড্রেস দু’জনের। আসার সময় ব্যাপক সতর্ক ছিল ওরা, কেউ ওদেরকে লক্ষ্য করেছে বলে মনে হল না। দেখাও হল তূর্যের সাথে। কিন্তু সময়টা ভয়েই উপভোগ করতে পারছিল না তারা, যদিও তূর্যের সকল বন্ধু পাহারা দিচ্ছে বাইরে। চিড়িয়াখানাটা পাহাড়ের ঢালে, পাহাড়ের একেবারে নীচের দিকের একটি সিটে বসে রইল ওরা। দুজনের আড়ষ্ঠতা এখনও কাটেনি। তবুও সময়টা স্মৃতিময়ই ছিল। মধুর অনুভুতি। এত সহজে দুই জাতির দুই ধর্মের দুটি প্রাণ এত দ্রুত এত কাছে এসে গেল ভাবতেই অবাক লাগে তার। এর নামই বোধ হয় ভালবাসা- যা অসাধ্যকে সাধ্য করেছে যুগে যুগে।
এরপর ঝামেলা বাঁধার আগে চলেই গেল দু’জন। কিন্তু ওরা জানে না, ঝামেলার মাত্র শুরু।
চিড়িয়াখানার প্রহরী নিরন বাবু সংগীতার বাবাকে ভালোভাবেই চিনতেন, ইনফ্যাক্ট তারা একই সাথে পড়েছেনও, সংগীতাকেও চেনে সে। একটা বাঙালি ছেলের সাথে ওকে দেখে ঠিক মেনে নিতে পারলেন না উনি। সুগত ছেলেটাও যে কি করে না! এসব ব্যাপারে ওদেরই তো মাথা ঘামানো উচিৎ বেশি। নিরন বাবু সিদ্ধান্ত নিল কমলকিরণকে না বলে তার চাচাত ভাইয়ের ছেলে সুগতকে বলবে। মগদা বাঙ্গাল বেশি বাড় বেড়েছে!
‘ও আচ্ছা!’– নিরনবাবুর কথা শুনে কী যেন বুঝল সুগত। মনে মনে ভেবে নিল, এই জন্যই ওকে এভাবে অপমান করে চলে গেল মেয়েটা, বাঙ্গালের প্রেমে মজেছে! সেদিন বিকেল চারটায় কলেজে মেয়ে দুটোকে সেজেগুজে এভাবে দেখেই সন্দেহ করা উচিৎ ছিল তার। আফসোস করতে লাগল সুগত। ছেলেটার মুখের একটা বর্ণনা চাইল সুগত। বলল বটে নিরনবাবু, কিন্তু একইসাথে সুগতকে একগাদা ভৎসর্না করল নিরন বাবু! নেতা হয়ে কেন এসব নজরে রাখে না, সেজন্য তিরস্কারও করল বেশ! সব নিরবে হজম করল সে! এবং তার যদি ভুল হয়ে না থাকে, ছেলেগুলো সাগর, সায়েম, তূর্যদের দল। আর ছেলেটা তূর্যই হবে! এই শালাগুলো একেকটা বদমাস! অনেকবার চেষ্টা করেছে সুগত, কিন্তু ঘাড় নোয়াতে পারেনি। অন্য বাঙালি ছেলেগুলোর মত চুপচাপ সব সহ্য করতে রাজী নয় তারা। আগে থেকেই রাগ ছিল, বিশেষ করে সেদিনের দাঙ্গায় এই ছেলেগুলোর কারণেই তাদের প্ল্যানে ক্যাচাল লেগে যায়! কলেজ হোস্টেলের দখল তারা হারায় এই ছেলেগুলোর কারণে! রাগে মাথা ঝিমঝিম করছে তার।
তূর্যের অনার্স ফাইনাল শেষ! রেজাল্ট দেবে যে কোন মূহুর্তে। তবে তার আগেই কোনেএকটা চাকুরি খুঁজতে বের হতে হবে। ঢাকায় বড় ভাইয়ের কাছে উঠবে বলে ভাবছে সে। কিন্তু সংগীতাকে ছেড়ে যেতেও ইচ্ছে করছে না! কিন্তু নতুন স্বপ্নের কাঠগড়ায় এখন ও, তাই স্বপ্ন ভঙ্গের বদলে পূরণ করতে চাইলে, এটাই করতে হবে, একটু কঠোর হতেই হবে। কিন্তু ওকে কীভাবে জানাবে বুঝতে পারছে না। সাথে বন্ধুদেরও জানাতে খারাপ লাগছে। কিন্তু জানাতেই হবে।
সংগীতার পা দুরু দুরু করে কাঁপছে, যেন পায়ের নীচে ভূমিকম্প হচ্ছে, যে কোন সময় পড়ে যেতে পারে ও। সুগত আর তার পাণ্ডারা এসেছে ওদের ক্লাসে। এসেই সংগীতাকে সতর্ক করে দিয়েছে সুগত, সব জানে সে! তূর্যের লাশও খুঁজে পাওয়া যাবে না বলে সিনেমার ভিলেনের মত সোজা ভাষায় জানিয়ে দিল সে। একথা বলেই সুগত চলে গেল সামনে থেকে। সুগতের হুমকিকে কথার কথা ভাবলে ভুল করবে– এই কথা ভালো করেই জানে সংগীতা। প্রয়োজনে সিনেমার ভিলেনের মতই নৃশংস হতে বাঁধবে না তার হাত। ফুপিয়ে কাঁদছে সংগীতা। নিজের জন্য নয়, তূর্যকে মেরে ফেলবে বলেছে ওরা-সেজন্যে।
বাবা-মা জানার আগেই ব্যাপারটার একটু ফয়সালা হওয়া উচিৎ। তূর্যের সাথে আরেক জায়গায় দেখা করবে বলে সিদ্ধান্ত নিল সে। ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে দেখল, ডিসি’র বাংলোর ওদিকের পলওয়েল পার্কে দেখা করবে ওরা। কলির মাধ্যমে সায়েমকে সিদ্ধান্তটা জানিয়েও দিল। এমন আকস্মিক ডাকার কারণ শুনে হন্তদন্ত হয়ে পার্কে চলে এল তূর্য। মুখ বাঁধা এক মেয়ে এসে তার হাত ধরল, স্পর্শে সহজেই বুঝতে সময় লাগল সে-ই সংগীতা। সোজা বলল,
:আমাকে বিয়ে করতে পারবে? এমন হঠাৎ প্রশ্ন শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পড়ল তূর্য। মুখে বলল,
:অবশ্যই!
:এখন, দুই দিনের মধ্যে? – সংগীতার তাগাদা।
তূর্য ভালোবাসে সংগীতাকে, নিজের পৌরুষত্ব বাধ্য করল ওকে হ্যাঁ বলতে। কিন্তু এখনও জানে না কী হতে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সংগীতা। অবশেষে আমতা আমতা করে বলল,
:এরপর আমাকে খাওয়াবা কী, রাখবা কই? কী ভেবে যেন হুট করে তূর্য বলল,
:‘আমি ঢাকায় যাবো কিছুদিনের জন্য। ভাইয়ার ফার্মে জব করব। তোমার সাথে নিয়মিত ফোনে যোগাযোগ করব। তবে বিয়েটা সেরে রাখব। সেটা কেউ জানবে না তুমি, আমি, কলি আর আমার বন্ধুরা ছাড়া। এরপর তুমি প্রিপারেশন নিতে থাকবে। সময় হলে আমাকে জানাবে। আমি তোমাকে নিতে আসব, একসাথে চলে যাব সিলেট। সেখানে আমার এক মামা থাকেন, আমি নিশ্চিত উনি মেনে নেবেনই আমাদের। এরপর ওখানে সপ্তাহ দু’য়েক থেকে চলে আসব ঢাকায়। সংসার করব দুইজন’।
শুনে উৎফুল্ল হলেও ভেতরে চাপা ভয়টা এখনও আছে সংগীতার। ওরা কেউই জানে না কি সব আবোলতাবোল বকছে দু’জনেই। মুখে বলা সম্ভব সহজেই, কিন্তু বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব হবে না সহজে।
বিছানায় বসে বসে কথাগুলো ভাবছে সংগীতা। এরপর পুরোই পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ হয়ে গেল। ও ভেবে ভেবে পুরোই অবাক হয়! প্রেম হবার মাত্র এক মাসের মাথায় এই কমিটমেন্ট! এরপর ঠিক পাঁচ মাস পর সেটা পূরণও করেছে তূর্য। তূর্যের মা কেবল ব্যাপারটা জানত, সংগীতাকে একপলক দেখেই ওনার খুব পছন্দ হয়েছে।
তূর্য চলে যাবার পর খুশী হয়েছিল সুগত, এবার বাগে পাওয়া গেছে মেয়েটাকে। সুগতর ধারণা তার ভয়েই পালিয়ে ভেগেছে ব্যাটা বাঙ্গাল! তবুও কিছুটা সন্দেহও ছিল, বলা তো যায় না মেয়েটিকে পালিয়ে নিয়ে যেতে পারে ছেলেগুলো। কিন্তু দুয়েক মাসেও কিছু না ঘটায়, পাহারায় ঢিল দিল সুগতরা। আর এদিকে সুগতদের উপর নজর ছিল সাগরদের, সংগীতাকে খুব আগলে রাখত ওরা। ওদের কারণে সুগতও কেন যেন আগে বাড়েনি আর!
কিন্তু এখন মায়ের জন্য মন কাঁদছে সংগীতার। সিলেটে আসার পর মা’র সাথে কথা হয়েছে ক’বার, মা কেঁদেছে। কিন্তু এখন নতুন উদ্বেগের কথা শোনা যাচ্ছে। সুগত ছেলেটা খুবই উগ্র হয়ে উঠেছে। তূর্যের বন্ধু সাগর, সায়েম আর রনিকে হেনস্থা করেছে সে, মারামারি বাঁধিয়েছে বেশ কয়েকবার। কলির উপরও চড়াও হয়েছে বেশ কয়েকবার! কিন্তু বাঙালি ছেলেরা সেটা রুখে দেয়। ইদানিং বাবা-মা’কেও খুব হূমকি দিচ্ছে। ওদের কারণেই নাকি সংগীতা লাই পেয়েছে। অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজও করেছে। বাবাকে আল্টিমেটাম দিয়েছে সুগত। কোন কাজেই লাগল না বাবার ‘সন্তু কানেকশন’। ঘটনার পর সন্তু লারমা ওর বাবার সাথে দেখাই করতে চায়নি।
এগারো.
ঠিক তিন দিন পর, একটা টেলিফোন আসল সংগীতার। তূর্য লক্ষ্য করল, সংগীতার চেহারা যেন বরফের মত সাদা হয়ে গেছে। হঠাৎ করে মোবাইলটা পড়ে গেল সংগীতার হাত থেকে, থপ করে দাঁড়ানো অবস্থা থেকে পড়ে গেল নীচে। পাথর হয়ে গেছে যেন সংগীতা। বারবার ওর গাল ধরে নাড়া দিচ্ছে তূর্য। কিন্তু কোন সাড়াই নেই। চিৎকার করে ওর কাজিনদের ডাকল তূর্য। মোবাইলে কার সাথে কথা বলছিল সংগীতা? চেক করে দেখা গেল, ওটা কলির নাম্বার। আবার কল ব্যাক করে কলির কথা শুনে তূর্যও স্তম্ভ হয়ে গেল! একি বলছে কলি! মানুষ এত নির্মম আর পাষণ্ড হয় কী করে?
অস্ত্রের মুখে আর কমলকিরণের পূর্বশত্রু হেডম্যানের সাথে হাত করে বিচার সাজিয়ে সুগত সংগীতার বাবা-মা’কে ন্যাড়া করে পুরো এলাকা ঘুরিয়েছে! তাদের গলায় জুতোর মালা পরাতেও ভুলেনি ঐ পিশাচের দল! এলাকায় একঘরে ঘোষণা করা হয়েছে তাদের। কলি এত কথা বলেনি, কিন্তু অতীত ঘটনাগুলো থেকেই এসব উপলব্ধি করে নিল তূর্য। তাই বলে কমলকিরণকেও? তার তো সন্তু লারমার সাথে পর্যন্ত যোগাযোগ ছিল। উফফফ! আর ভাবতে পারছে না তূর্য! সংগীতাকে নিয়ে দ্রুত ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সংগীতার দিকে সামিয়াদের নজর রাখতে বলে, তড়িঘড়ি করে ডাক্তার আনতে চলে গেল সে।
♦ গল্পটিতে উল্লিখিত সকল চরিত্র ও সংগঠনের নাম কাল্পনিক।
tor mayer golpota bolbina shaalar kuttar jaat?????