জুলাই-আগস্টের অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানে অসংখ্য তাজা প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বিজয় বৈষম্যহীনতার বোধ জাগিয়েছে জনজীবনে। জাতিবিনাশী বৈষম্যের রকমফের, কার্যকারণ ও সুরাহার আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। এরই অনিবার্য অংশ হিসেবে দেশের মোট ভূভাগের এক দশমাংশজুড়ে থাকা পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের নামে ১৯৯৭ সালে শেখ হাসিনা সরকার বিচ্ছিন্নতাবাদী আঞ্চলিক উপজাতীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে স্বাক্ষরিত চরম বৈষম্যমূলক, আত্মঘাতী চুক্তি নিয়েও জোরেশোরে আলোচনা হচ্ছে ইদানীং। ইতোমধ্যে বৈষম্যবিরোধী পার্বত্য চট্টগ্রাম ঐক্য পরিষদ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আইনজীবী ফোরামের আয়োজনে রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, সাংবাদিক ও অন্যান্য পেশাজীবীর অংশগ্রহণে জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় ওই চুক্তি বাতিলসহ পার্বত্য তিন জেলার নাগরিক জীবনে বিরাজমান প্রকট বৈষম্যগুলো নিরসনে জোরালো দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। পুরো জাতিকে অন্ধকারে রেখে, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতাকে বিপন্ন করে, জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার তড়িঘড়ি ওই চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তির পর তিন দশকের কাছাকাছি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। সঙ্গে ওই চুক্তিজাত বৈষম্যের জাঁতাকলে তিন জেলার বিপুলসংখ্যক বাঙালির জীবন ঢেকে গেছে বঞ্চনার কালো মেঘে। দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা এটাই যে, ওই কালো চুক্তি স্বাক্ষরের প্রাক্কালে বৈষম্য ও বঞ্চনার যে আশঙ্কা করা হয়েছিল, তা সর্বাংশে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। বৈষম্যের এই ফিরিস্তি দীর্ঘ। এই নিবন্ধে উদাহরণস্বরূপ শুধু একটি আংশিক পর্যালোচনা করা যেতে পারে। তিন পার্বত্য জেলায় বাঙালি ও উপজাতি বাসিন্দার সংখ্যা প্রায় সমান-সমান হলেও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীনভাবে এই তিন জেলাকে ‘উপজাতি অধ্যুষিত’ অঞ্চল বলা হয়েছে চুক্তিতে। এটি এখানকার বাঙালিদের অস্তিত্বই অস্বীকার করার নামান্তর। শুধু তা-ই নয়, এই চুক্তিতে এখানকার বাঙালিদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ই অস্বীকার করা হয়েছে; বাঙালিদের ‘অ-উপজাতি’ বলেই উল্লেখ করা হয়েছে এতে। সবচেয়ে বড় আঘাতটা হানা হয়েছে এখানকার বাঙালিদের ভোটাধিকারের ওপর। চুক্তি মতে, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ নির্বাচনের জন্য আলাদা ভোটার তালিকা প্রণীত হবে আর তাতে ভূমিহীন, দরিদ্র বাঙালিরা ভোটারই হতে পারবেন না। চুক্তির এই শর্তটি সরাসরি সংবিধান-পরিপন্থী। ফলে আলাদা ভোটার তালিকা প্রণয়ন সম্ভব না হওয়ায় ১৯৮৯ সালে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে প্রথমবারের মতো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও আজ পর্যন্ত এই নির্বাচন আর হয়নি। চুক্তির আওতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত জনসংহতি সমিতির নেতা সন্তু লারমাই বিনা নির্বাচনে, মনোনীত চেয়ারম্যান হিসেবে বহাল তবিয়তে আছেন। এভাবে অনির্বাচিত, মনোনীত চেয়ারম্যান ও সদস্যদের দিয়েই পরিষদগুলোর কাজ অগণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিবিহীনভাবে সামাল দেওয়া হচ্ছে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, পরিষদগুলোর চেয়ারম্যান পদ উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত। এই পদে কোনো বাঙালির নির্বাচন বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করাই বারণ। তা ছাড়া, জনসংখ্যায় প্রায় সমান-সমান হলেও পরিষদগুলোর সদস্যপদের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ বাঙালিদের জন্য নির্ধারিত। একই চিত্র পরিষদগুলোর অধীনে ন্যস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগেও। এই চুক্তি স্বাক্ষরের বিরুদ্ধে তখনকার বিরোধী দল বিএনপি ঢাকা টু খাগড়াছড়ি লংমার্চসহ নানাভাবে প্রতিবাদ জানালেও তাতে কর্ণপাত করেনি আওয়ামী লীগ সরকার। ফলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বর্তমান চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মো. তাজুল ইসলাম ও মো. বদিউজ্জামান ওই কালো চুক্তি এবং চুক্তিজাত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদকে অসাংবিধানিক ঘোষণার জন্য হাইকোর্ট বিভাগে পৃথক দুটি রিট আবেদন দাখিল করেন। ওই রিট আবেদন দুটির শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী সমন্বয়ে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চ ২০১০ সালের এপ্রিলে রায় ঘোষণা করে। রায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়। তা ছাড়া, ভোটার হওয়ার যোগ্যতা হিসেবে জমির মালিকানা থাকার শর্ত, সার্কেল চিফের সনদ, চাকরিতে উপজাতিদের অন্যায্য প্রাধান্যসহ বৈষম্যমূলক বেশ কিছু বিধানকে অবৈধ ও সংবিধান-পরিপন্থী মর্মে ঘোষণা করা হয়। অবশ্য, চুক্তির বিষয়টি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয় মর্মে উল্লেখ করে এটির ব্যাপারে রায়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়নি। এর মানে হলো, চুক্তিটির বিষয়ে রাজনৈতিক সরকার কর্তৃক যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে আইনগত কোনো বাধা নেই। বলাবাহুল্য, ওই রায়ের অথার জজ (রায়ের লেখক) বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ এখন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি। কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করায় আজ পর্যন্ত বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টেও আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় ঝুলে আছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র তথা গণআন্দোলনে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে সর্বত্র সাম্যের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে দেশে। তথাকথিত শান্তি চুক্তি নামে পরিচিত শান্তিবিনাশী চুক্তিটির বিষয়ে করণীয় নির্ধারণের সময় এখন। আপিল বিভাগে ঝুলে থাকা উপরোক্ত আপিলের শুনানি হওয়া দরকার দ্রুত। পাশাপাশি, বৈষম্য নিরসনে এবং নাগরিকদের সাংবিধানিক ও আইনি অধিকার সমুন্নত রেখে কথিত চুক্তিটির নিদেনপক্ষে প্রয়োজনীয় সংশোধনে করণীয় নির্ধারণ করা দরকার জরুরি ভিত্তিতে। এতে করে আসন্ন রাজনৈতিক সরকারের জন্য চুক্তিটির বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ সহজ হবে। ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দৃঢ় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সমীচীন হবে এ নিয়ে। তবেই এ অঞ্চলে সত্যিকার সাম্যভিত্তিক, বৈষম্যহীন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে পারবেন পার্বত্য বাঙালি ও উপজাতি জনগোষ্ঠী। লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টসূত্র : আমার দেশ