“শান্তিচুক্তির সুফল ভোগ করে সন্তু লারমা এককভাবে সকল রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে চলেছেন। আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি প্রতিমন্ত্রীর পদ মর্যাদার সুবিধা ভোগ করছেন। সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিনি নিজের খেয়াল খুশিমত চালাতে চান। সন্তু লারমার এই একক সুবিধাভোগ, স্বৈরাচারী মনোভাব পাহাড়ের অন্যান্য নেতাদের বিশেষ করে শান্তিবাহিনীর হয়ে কাজ করা নেতাদের পছন্দ নয়।”

সন্তু লারমার একনায়কতান্ত্রিক মনোভাবই পার্বত্য আঞ্চলিক দলগুলোর বিভক্তির কারণ

fec-image

শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন, ভূমি কমিশন ইত্যাদি নিয়ে কথা বললেও সন্তু লারমা কখনোই আঞ্চলিক পরিষদ নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন না। প্রতি পাঁচ বছর পরপর আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন হবার কথা থাকলেও বাংলাদেশ সংবিধান পরিপন্থি নানান শর্ত চাপিয়ে দিয়ে তিনি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে চলেছেন। এতে করে পাহাড়ের অন্যান্য উপজাতি নেতাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশার সৃষ্টি হচ্ছে। পাহাড়ে আঞ্চলিক দলের মধ্যে বিভক্তির এটাও একটা প্রধান কারণ।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি তথা পিসিজেএসএস এর সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ঐ সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি মাত্র আঞ্চলিক দল ছিলো। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে সন্তু লারমার পিসিজেএসএস ভেংগে এখন পাহাড়ে চারটি আঞ্চলিক দলের সৃষ্টি হয়েছে। শান্তিচুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তির সুবাতাস বইবার কথা। কিন্তু এই চারটি আঞ্চলিক সংগঠনের ক্ষমতা ও আধিপত্যের দ্বন্দ্বে আবারও অশান্ত হয়ে উঠেছে পাহাড়। কেন তাদের মধ্যে এত বিভক্তি, দ্বন্দ্ব, সংঘাত? আসুন সেই কারণ অনুসন্ধান করার চেষ্টা করি।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের প্রতিনিধি হিসেবে সন্তু লারমা শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু সন্তু লারমা পাহাড়িদের পক্ষ থেকে কোন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলেন না। পিসিজেএসএস’র প্রধান নেতা হিসেবেই তিনি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ফলে সন্তু লারমার মতামত ও আদর্শের সাথে অনেকেরই মতের অমিল ছিলো। যার বাস্তব উদাহরণ হলো শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের মাত্র তিন মাসের মাথায় চুক্তির বিরোধিতা করে সন্তু লারমার অত্যন্ত স্নেহভাজন প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ নামে আলাদা দলের আত্নপ্রকাশ। সন্তু লারমা হয়তো একজন গেরিলা নেতা হিসেবে সফল ছিলেন। কিন্তু গেরিলা নেতা হিসেবে সশস্ত্র দল চালানো আর গণতান্ত্রিকভাবে দল চালানো এক নয়।

শান্তিচুক্তির সুফল ভোগ করে সন্তু লারমা এককভাবে সকল রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে চলেছেন। আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি প্রতিমন্ত্রীর পদ মর্যাদার সুবিধা ভোগ করছেন। সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিনি নিজের খেয়াল খুশিমত চালাতে চান। সন্তু লারমার এই একক সুবিধাভোগ, স্বৈরাচারী মনোভাব পাহাড়ের অন্যান্য নেতাদের বিশেষ করে শান্তিবাহিনীর হয়ে কাজ করা নেতাদের পছন্দ নয়। আর সে কারণেই সন্তু লারমার দল ভেংগে আজ চার ভাগে বিভক্ত। আমৃত্যু নিজের পদ ধরে রাখার জন্য সন্তু লারমা নানান ধরনের তালবাহানা ও ফন্দিফিকির করে চলেছেন।

শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন, ভূমি কমিশন ইত্যাদি নিয়ে কথা বললেও সন্তু লারমা কখনোই আঞ্চলিক পরিষদ নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন না। প্রতি পাঁচ বছর পরপর আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন হবার কথা থাকলেও বাংলাদেশ সংবিধান পরিপন্থি নানান শর্ত চাপিয়ে দিয়ে তিনি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে চলেছেন। এতে করে পাহাড়ের অন্যান্য উপজাতি নেতাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশার সৃষ্টি হচ্ছে। পাহাড়ে আঞ্চলিক দলের মধ্যে বিভক্তির এটাও একটা প্রধান কারণ।

এছাড়াও, পাহাড়ের সাধারণ শান্তিপ্রিয় জনগণ শান্তিচুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে বসবাস করতে চেয়েছিলো। শান্তিচুক্তির ‘ঘ’ খন্ডের ১২ অনুচ্ছেদ মোতাবেক শান্তিবাহিনীর সকল অস্ত্র জমা করার কথা থাকলেও সন্তু লারমা সেটা করেননি। বরং তিনি দিন দিন অস্ত্রের মজুদ বাড়িয়ে পাহাড়কে অশান্ত করে রেখে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামকে কুক্ষিগত করে রাখছেন। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে দেয়া স্বাক্ষাৎকারে তিনি সেটা স্বীকারও করেছেন। শান্তিচুক্তির পরও সন্তু লারমা পাহাড়ে খুন, গুম, ধর্ষণ, চাঁদাবাজিসহ নানান সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলে, সন্তু লারমার প্রতি সাধারণ শান্তিপ্রিয় পাহাড়ি জনগণের ঘৃণার সৃষ্টি হচ্ছে এবং এতে করে তিনি দিন দিন পাহাড়িদের আস্থা হারাচ্ছেন। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সন্তু লারমার প্রতি বিদ্বেষী অন্যান্য পাহাড়ি নেতারা জনসমর্থন আদায় করে নিয়ে নতুন নতুন দল সৃষ্টির সুযোগ পাচ্ছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের এক সময়কার তুখোড় ও একচ্ছত্র গেরিলা নেতা সন্তু লারমার পিসিজেএসএস ভেংগে আরো নতুন তিনটি দলের আবির্ভাবে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, সন্তু লারমা এখন আর পাহাড়িদের একক ও একচ্ছত্র নেতা নন। একনায়কতন্ত্র, স্বৈরাচারী আর স্বার্থপর মনোভাবের কারণেই সন্তু লারমা দিন দিন জন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। এই অবস্থা চলতে থাকলে পাহাড়ে আরো নতুন নতুন দলের সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি হবে। এভাবে বিভক্তি বাড়তে থাকলে এক সময় সন্তু লারমার জনপ্রিয়তা তলানীতে গিয়ে ঠেকবে। এমনকি সন্তু লারমা তার বড় ভাই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার মতো করুণ পরিস্থিতির শিকারও হতে পারেন।

তাই শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরকারী হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তির সুবাতাস ফিরিয়ে আনার জন্য এবং নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্য সন্তু লারমার উচিৎ হবে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সরকারকে সহায়তা করা। অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের পথ পরিহার করে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিপূর্ণ ও স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখা। আঞ্চলিক পরিষদ নির্বাচনের পথ সুগম করে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির সুযোগ তৈরি করে দেয়া। এটা না করলে সন্তু লারমা সত্যিই একদিন এক ব্যক্তির এক দলের নেতায় পরিণত হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।


 * মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার বক্তব্য, তথ্য, সূত্র একান্তই  লেখকের। পার্বত্যনিউজের সম্পাদকীয় নীতি এক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: সন্তু লারমা, সন্তোষ বড়ুয়া
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন