parbattanews

সন্ত্রাস চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি রাঙামাটিতে

পাহাড় তথা তিন পার্বত্য চট্টগ্রামে রক্তের হোলিখেলা বন্ধ করতে তৎকালীন আ’লীগ সরকার পাবর্ত চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) সাথে চুক্তি করে। যা পরে শান্তিচুক্তি নামে পরিচিতি পায়। স্বাক্ষরের পর থেকে চুক্তিটির পক্ষ-বিপক্ষ শক্তির আবির্ভব ঘটে। আবার সরকার যে সংগঠনের সাথে চুক্তিটি করেছে তারাও নাখোশ। তাদের দাবি, পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা হোক। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে বারংবার বলা হচ্ছে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। ধীরে ধীরে চুক্তির সব ধারা বাস্তবায়ন করা হবে।

২ ডিসেম্বর ২০২১ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির’ দুইযুগ পূর্তি। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগ সরকারের জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার (সন্তু লারমা) মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি, যা পরে শান্তিচুক্তি নামে অভিহিত হয়।

চুক্তি স্বাক্ষরের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, তৎকালীন ও আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চুক্তি অনুসারে সেময় খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটিতে ত্রাস চালানো শান্তিবাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র সমর্পণ করে। কিন্তু পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের দু’যুগ পরেও এর বাস্তবায়ন নিয়ে চলছে নানা মতপার্থক্য। চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে জনসংহতি সমিতি হতাশা দেখালেও সরকারের দাবি চুক্তির বেশিরভাগই ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে।

শান্তিচুক্তি নিয়ে পাহাড়ের নীতি নির্ধারকরা যা বলছেন:

এমপি দীপংকর তালুকদার:

খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং রাঙামাটি সংসদীয় আসনের এমপি দীপংকর তালুকদার বলেন, বারবার একটি গোষ্ঠি প্রপাগান্ডা ছড়াচ্ছে; পাহাড়ে শান্তিচুক্তির কোনো সুফলতা নেই। এটা তাদের চরম মিথ্যাচার এবং গভীর নীল নকশা। চুক্তির কারণে পাহাড়ে আজ উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে। সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা স্থাপিত হয়েছে। অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসার পরিধি বাড়িয়েছে। এটাই চুক্তি সফল ফসল। ষড়যন্ত্রকারীদের কাজ হলো ষড়যন্ত্র করা। আর আমাদের সরকারের কাজ হলো ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচন করে তাদের নীল নকশা ভন্ডুল করে দিয়ে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা।

এমপি আরো বলেন, পাহাড়ে সীমান্ত সড়কের কাজ চলমান। ঠেগামুখ স্থল বন্দর নির্মাণ কাজের গতি বেড়েছে। সামনে পাহাড়ের অর্থনীতি উন্নতির শিখরে পৌঁছাবে। সমালোচনাকারীরা সমালোচনা করুক, তাতে আমাদের কিছুই যায় আসে না। আমরা আমাদের লক্ষ্যে কাজ করে যাবো।

এমপি আরও বলেন, চুক্তির বেশিরভাগ ধারা বাস্তবায়ন হয়ে গেছে। আরও কিছু ধারা বাস্তবায়নে প্রক্রিয়াধীন। তবে এর আগে আমাদের লক্ষ্যে প্রধান বাধা হলো- অবৈধ অস্ত্র। এটির কারণে আমাদের উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। তাই অচিরেই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে পারলে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যাবে এবং তাদের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। এইজন্য আমি সরকারকে এ ব্যাপারে সরকারকে তাগিদ দিয়েছি। সরকারও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। আশা করি, একদিন পার্বত্য চট্টগ্রাম সন্ত্রাসমুক্ত শান্তির শহরে পরিণত হবে।

অংসুইপ্রু চৌধুরী:

রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অংসুইপ্রু চৌধুরী বলেন, চুক্তি নিয়ম অনুযায়ী পার্বত্য জেলা পরিষদের অধীনে প্রশাসনিক কাঠামোগুলো হস্তান্তর করা প্রয়োজন। কারণ, প্রশাসনিক কাঠামোগুলো হস্তান্তর না করার আগে স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়নের ক্ষেত্রে কোনো সমন্বয় হচ্ছে না। যে কারণে পাহাড়ের উন্নয়ন অনেকাংশে থমকে আছে।

চেয়ারম্যান আরও বলেন, পাহাড়ে উন্নয়নের আরও একটি পূর্বশর্ত হলো, পাহাড় থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা। এসব অবৈধ অস্ত্রের কারণে উন্নয়ন থেমে আছে।

চেয়ারম্যান বলেন, এটা সত্যি যে, শান্তিচুক্তির পর থেকে পাহাড়ে শিক্ষা, সরকারি অবকাঠামোগত উন্নয়ন যে পরিমাণে হয়েছে তা অতীতে কখনো হয়নি। তাই চুক্তির দুই যুগ পূর্তিতে একটাই দাবি, পাহাড়ে শান্তির সুবাতাস ফিরে আসুক, মা তার সন্তান নিয়ে আনন্দে দিন কাটাক, পার্বত্যবাসীর শান্তিতে দিন কাটুকু এটাই প্রত্যাশা।

আনোয়ার আল হক:

রাঙামাটি প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার আল হক বলেন, সরকার শান্তি চুক্তি করেছে শান্তির জন্য। পার্বত্যবাসীকে শান্তিতে রাখার জন্য। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো পাহাড়ে আমরা এখনো শান্তির দেখা পাইনি।
সাংবাদিকদের এ নেতা বলেন সরকারের কাছে অনুরোধ, এইভাবে পাহাড়ে শান্তি আসবে না। শান্তি আসার জন্য আগে পাহাড়ের পরিস্থিতির গভীরতা অনুসন্ধান করতে হবে। কারণ এখানে বহু জাতি স্বত্তার বসবাস। তাদের অধিকার সম্পর্কে সরকারকে অবহিত হতে হবে। কারণ, একটি গোষ্ঠি সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে আর বাকী জনগোষ্ঠিগুলো চরম বৈষম্যর শিকার হবে, এটা অন্য জনগোষ্ঠিগুলো মেনে নেবে না। তাই সরকারের উচিত সমস্যা সমাধানে এখনই যথোপযুক্ত সিন্ধান্ত নিতে হবে। পাশাপাশি পাহাড়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। তাহলে চুক্তির প্রত্যাশা পূরণ হবে।

জাহাঙ্গীর আলম মুন্না:

রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ বাস্তবায়ন কমিটির আহবায়ক ও সাবেক মেধাবী ছাত্র নেতা সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, শান্তিচুক্তির অর্থ হলো শান্তির জন্য একত্রে হওয়া। তৎকালীন আ’লীগ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নামের সন্ত্রাসী গোষ্ঠির সাথে শান্তিচুক্তি করেছে পাহাড়ে শান্তির জন্য। আজ চুক্তির দুই যুগ অতিবাহিত হলো, কিন্তু যে শান্তির জন্য চুক্তি হয়েছিলো আদৌ সেই শান্তি পার্বত্যবাসী দেখতে পায়নি। প্রতিনিয়ত পাহাড়ে এখনো রক্ত ঝড়ছে। শত শত মায়ের বুক খালি হচ্ছে। সন্ত্রাসী যে সংঠনটি পাহাড়ে শান্তি আনয়নের লক্ষ্যে সরকারের সাথে চুক্তি করেছে তারা তো শান্তির পক্ষে তাদের অবস্থান দেখাতে পারিনি। উল্টো তারা বীরদর্পে পাহাড়ে আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের রয়েছে কয়েক হাজার অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী। এটা সরকার, প্রশাসন থেকে সকলে জানে। সন্ত্রাসী সংঠনটির চাঁদাবাজি, হত্যা, গুমের মতো নৃশংস কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, পাহাড়ে শান্তি আনতে হলে আগে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। দীর্ঘ বছর ধরে আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছি। এসব অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারলে শান্তির দেখা পার্বত্যবাসী কোনদিন পাবে না। চুক্তির বর্ষপূর্তি আসবে যাবে, কিন্তু তাতে শান্তি ফিরবে না। পাশাপাশি চুক্তির সাথে পাহাড়ে বসবাসকারী বাঙালিদের স্বার্থের সাংঘর্ষিক ধারাগুলো বাতিল করতে হবে।

এ নেতা বলেন, সরকারের যখন মেডিকেল কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশবিদ্যালয় স্থাপন করছে তখন আঞ্চলিক সংগঠনগুলো জনগণের মৌলিক অধিকারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নের আগে পাহাড়ে আগে মানুষের নিরাপত্তা, অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি বন্ধ, চাঁদাবাজি, খুন এবং গুমের মতো ঘটনা বন্ধ করতে হবে। এরপর শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে।

জাহাঙ্গীর আলম:

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংঠনিক সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পার্বত্য চুক্তির অন্যতম কর্ণধার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি শান্তির জন্য চুক্তি করেছিলো। সংঠগঠনটি তাদের সন্ত্রাসী সংগঠন শান্তিবাহিনীর কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, সেইদিন তারা যেসব অস্ত্র জমা দিয়েছিলো সেইসব অস্ত্র ছিলো ভাঙ্গা এবং অকার্যকর। আসল অস্ত্রগুলো তারা জমা দেননি। তারা সরকারের সাথে শুরুতেই বেইমানী করেছে। সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা এখনো স্বীকার করে পাহাড়ে তাদের কয়েক হাজার স্বশস্ত্র বাহিনী রয়েছে। এইসব সন্ত্রাসীরা পাহাড়ে চাঁদাবজি, খুন, গুমের মতো ঘটনা ঘটায়। শান্তিবাহিনী তাহলে বিলুপ্তি হলো কখন?

তিনি বলেন, যে সংগঠনটি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন চায় তাদের উচিৎ চুক্তি অনুযায়ী আগে তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করা। তা না হলে সংগঠনটি পাহাড়ে জুম্মল্যান্ড নামক দেশের যে স্বপ্ন বুনেছে চুক্তি বাস্তবায়ন হওয়ার সাথে সাথে তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে। এইজন্য সরকারের কাছে একটাই দাবি, চুক্তি বাস্তবায়নের আগে পাহাড় থেকে সকল সশস্ত্র সংগ্রাম বন্ধ করা।

Exit mobile version