parbattanews

সব হেডম্যানের সাথে শান্তিবাহিনীর যোগাযোগ আছে

(ছয়)

আমি ব্যাটালিয়ান টেকওভার করলাম। প্রথমে আমার এলাকার হেডম্যানদের সাথে বৈঠক হলো। তঞ্চঙ্গা হেডম্যানেদের নাম তজেন্দ্রলাল তঞ্চঙ্গাকে এবং ফুলেস্বর, ত্রিপুরাদের হেমানন্দ ত্রিপুরা এবং বোম হেডম্যানের নাম তিনবান। ফারুয়া জোনে কোনো চাকমা বসতি তখন নাই তাই ফারুয়াতে কোনো চাকমা হেডম্যান ছিলো না।

জেনারেল আব্দুস সামাদ যখন চিটাগাং ডিভিশনের জিওসি। তখন তিনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফারুয়া জোনের সব পাহাড়ী গ্রামসমুহকে একটি কন্ট্রোল ভিলেজ সিসটেমের আওতায় নিয়ে এসে ফারুয়ার আশে পাশে রিলোকেট করেন। তিনি এই আইডিয়া পেয়েছিলেন মালয়েশিয়া থেকে।

আপনারা জানেন, মালয়েশিয়া দীর্ঘ একুশ বছর উত্তরের রাজ্যে ইনসার্জেন্সি যুদ্ধ করে উনিশ শত আটষট্টি সাল হতে উনিশ শত উননব্বই সাল পর্যন্ত মালয়েশিয়ার কম্যুনিস্ট পার্টির ( এমসিপি)সাথে যারা এথনিক চায়নীজ, পরে সারাওয়াক রাজ্যে দ্বিতীয় বার ইনসার্জেন্সি যুদ্ধ করে এমসিপি- আরএফ। পরে তা নির্মুল হয় অল্প সময়ে । মালয়েশিয়া উনিশ শত চুয়াত্তর সালে চীনের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্হাপন করার পরে চীন কম্যুনিস্টদের সহায়তা দান বন্ধ করে দেয়। ফলে কম্যুনিস্টরা ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো উনিশ শত উননব্বই সালে এমসিপি মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে শান্তি চুক্তিতে আবদ্ধ হয় এবং ইনসার্জেন্সি যুদ্ধের অবসান ঘটে।


এই ধারাবাহিকের আগের লেখাগুলো পড়ুন

  1. ♦ পার্বত্য চট্টগ্রামে আমার অভিজ্ঞতা

  2. ♦ জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় বসেই মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অঞ্চলে পোস্টিং করেন

  3. ♦ বঙ্গবন্ধু আর্মি অফিসার মেস থেকে মদের বার তুলে দেন

  4.  ফারুয়া ব্যাটালিয়ান সদরে প্রথম দিন 

  5.  পাহাড় পথে হাঁটার প্রথম অভিজ্ঞতা হলো


মালয়েশিয়া তাদের ইনসার্জেন্সি যুদ্ধ এলাকায় এই কন্ট্রোল ভিলেজ সিসটেমের আওতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্রাম সমুহকে একটি নির্দিষ্ট জোনে রিলোকেট করে ভালো ফল পায়। সেখান থেকে এই আইডিয়া নিয়ে ফারুয়াতে জিওসি জেনারেল সামাদ ( মৃত ) কন্ট্রোল ভিলেজ সিসটেম চালু করেন, ফলে এই এলাকায় শান্তি বাহিনীর তৎপরতা সব সময় সীমিত ছিলো।

আমি হেডম্যানদের সাথে গভীর আলোচনা করলাম এবং অনেক বিষয়ে অবহিত হলাম। তবে একটা বিষয় নিশ্চিত হলাম, সব হেডম্যানের সাথে শান্তিবাহিনীর যোগাযোগ আছে। আমি জেনে কিংবা না জেনে প্রথম দিনই হেডম্যানদের বললাম, আপনারা শান্তিবাহিনীকে বলেন ফারুয়া জোনে তৎপরতা না করতে এবং আমাকে ডিস্টার্ব যেন না করে। আমার ধারণা ছিলো, যেহেতু হেডম্যানদের সাথে শান্তি বাহিনীর যোগাযোগ আছে তাই আমার এই মেসেজ শান্তিবাহিনীর কাছে পৌছালে তাদের প্রতিক্রিয়া কি হয় সেটা অবজার্ভ করার একটা সুযোগ আমি পাবো ।

ইতিমধ্যে আমি নিজেরও পরিস্থিতি সামলিয়ে নেওয়ার একটা সময় হাতে আসবে। একটা কথা সবাইকে বলতে চাই, পার্বত্য চট্টগ্রামে আমাদের অপারেশন ছিলো একটি জীবন্ত যুদ্ধ। এর দুটো অপশন হয় মরা, না হয় বাঁচা। ধরা পড়লেও বাঁচার কোনো সম্ভাবনা নাই। অতএব, আমাকে খুব হিসেব করে একটা আজানা অচেনা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে কার্যকরভাবে তার নিয়ন্ত্রণ নেওয়াই ছিলো বড় কাজ।

হেডম্যানদের মধ্যে তজেন্দ্রলাল তঞ্চঙ্গাকে দেখলাম সে একজন অসম্ভব চালাক, বুদ্ধিমান এবং করিতকর্মা লোক। আমি ঠিক করলাম তজেন্দ্রলাল তঞ্চঙ্গাকে কনফিডেন্সে নিয়ে তাকে দিয়ে সব পাহাড়ী এবং শান্তি বাহিনীর কর্মকাণ্ডের নিকেষ করবো। কাজ শুরু হলো ।

এখন একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। আমাদের ব্যাটালিয়ানের সামনের রেংখিয়াং খালের প্রশস্ততা অনেক বড়। এখানে জেলেরা নিত্য দিন জাল ফেলে মাছ ধরে। জেলেরা সব চট্টগ্রামের মানুষ। রেংখিয়াং খালে ঐসময় যেসব মাছ পাওয়া যেত সেসব হলো:

রুই- আট থেকে দশ কেজি পর্যন্ত, প্রতি কেজি দাম দশটাকা। চিতল- পনের থেকে কুড়ি কেজি পর্যন্ত, প্রতি কেজি দাম দশটাকা। বোয়াল- পনের থেকে পাঁচিশ কেজি পর্যন্ত, প্রতি কেজি দাম দশ টাকা। কাতলা- আট থেকে দশ কেজি পর্যন্ত, দাম প্রতি কেজি- দশটাকা। মৃগেল- সাত থেকে দশ কেজি পর্যন্ত, দাম প্রতি কেজি দশটাকা। মাল- মাছ ( সম্ভবত মহাসোল ), পাঁচ থেকে সাত কেজি পর্যন্ত, দাম প্রতি কেজি- দশ টাকা। কালিঘৈন্যা ( কালি বাউশ)- তিন থেকে চার কেজি, প্রতি কেজি দাম – সাত টাকা। চাপিলা মাছ- প্রায় হাফ কেজি সাইজ, দাম কেজি প্রতি সাত টাকা। অন্য মাছ যেমন কুরশাসহ অনেক প্রজাতির ছোট মাছ ধরা পড়তো । এইসব মাছ আমরা কিনতাম না।

কাপ্তাই থেকে ফারুয়া বাজার লঞ্চ সার্ভিস চালু ছিলো। জেলেরা তাদের মাছ ভোরে আমাদের কাছে বিক্রি করার পরে তা লঞ্চে করে কাপ্তাই পাঠিয়ে দিতো। পরে সেই মাছ চট্রগ্রাম শহরের বাজারে আসতো। ফারুয়াতে প্রথম আমি গয়াল দেখলাম। গয়াল দেখতে অনেকটা বাইসনের মতো গরু মহিষের সংমিশ্রণ। পা হাটু পর্যন্ত সাদা। সিং অনেকটা মহিষের সিং এর মতো।

রেংখিয়াং খালের পুর্ব পাড়ে ফারুয়া বাজার। সপ্তাহে বাজার বসে । তবে স্হায়ী স্হপনা সম্বলিত এই বাজারে আবাসিক হোটেল আছে। বাজার সবদিন খোলা থাকে। সাপ্তাহিক বাজারের দিনে দুর দুরান্তের গ্রামের পাহাড়ী জনগন তাদের জুমে উৎপাদিত ধান, বিভিন্ন প্রকারের চাল, সব্জি যেমন মারফা ( বাঙ্গি ), কুমড়া, কদু, মাটি কুমড়া প্রভৃতি থ্রুং এ করে বহন করে বাজারে নিয়ে আসে। পাহাড়ীরা সবাই তরকারিতে নাপ্পি দিয়ে রান্না করে। নাপ্পি হলো হাঁড়িতে পচানো মাছের এক ধরনের পেষ্ট। এর দুর্গন্ধ সবার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। পাহাড়ের মানুষের ধারনা নাপ্পি খেলে ম্যালেরিয়া হয় না। হতে পারে। তবে আমি পাহাড়ের ছোট ছোট বাচ্চাদের ফোলা পেট দেখে মনে হয়েছে এই বাচ্চাদের বার বার ম্যালেরিয়া হবার ফলে এই পেট ফোলা। তদুপরি কৃমির সমস্যাতো ছিলই।

আমি ব্যটালিয়ান কমান্ড গ্রহনের পরে কেবল সামলিয়ে উঠছি। এমন সময় ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার থেকে মেসেজ আসলো আমাকে দুমদুমিয়া থুমে অপারেশনাল ক্যাম্প স্হাপন করতে হবে বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে। দুমদুমিয়া থুম পার্বত্য চট্টগ্রামের পুর্ব শেষ পাহাড়। এই পাহাড় থেকে মিজোরামের রাজধানী আইজল দেখা যায়। রিজলাইনটি বাংলাদেশের ভিতরে ভারতের মিজোরাম সীমান্তে। দুমদুমিয়া থুম পাহাড়ীদের ভাষায় রিজ বা পাহাড়ের চুড়া। ফারুয়া থেকে হাটা পথে দুমদুমিয়া থুম যেতে পাহাড়ীর লাগে দেড়দিন আমাদের আড়াই থেকে তিনদিনের কম নয়।

হিসেব করে দেখলাম ব্যাটালিয়ানের কমান্ড গ্রহনের মাত্র সতেরো দিনের মাথায় আমাকে এমন এক মহা ঝুকিপুর্ণ দায়িত্ব দেয়া হলো যা প্রসিডেন্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের তরফ থেকে এসেছে। ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের মেসেজ পড়ে প্রথমে হতচকিত হলাম ঠিকই কিন্তু প্রেসিডেন্টের দেওয়া এই মহা ঝুকি মোকাবেলা করার জন্য করণীয় ঠিক করে ফেললাম।

…. চলবে

♦ মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান: প্রাক্তন মহাপরিচালক বিডিআর 

Exit mobile version