parbattanews

সরকারী ব্যবস্থাপনায় ঈদগাঁহে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু

কক্সবাজার সদরের ঈদগাঁহতে ব্যতিক্রমধর্মী একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছে।সমাজে পিছিয়ে থাকা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরদের জীবনমান উন্নয়নে আধুনিক সুবিধা সম্বলিত এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রতিষ্ঠানটির নাম হচ্ছে ‘সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম’, কক্সবাজার। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করছে সমাজসেবা বিভাগ।

সরেজমিন পরিদর্শনে জানা গেছে, শুধুমাত্র দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন ও বিনোদনের কার্যক্রম শুরু করা এ প্রতিষ্ঠান সমাজসেবা অধিদপ্তরের অর্থায়নে ঈদগাঁহতে প্রতিষ্ঠা করেছে সরকার।ঈদগাহ’র কেন্দ্রস্থল বাজারে ঈদগাঁহ উচ্চ বিদ্যালয়ের পূর্ব সীমানা সংলগ্ন নিজস্ব জায়গার উপর সরকার কোটি টাকা খরচ করে ৬ তলা ভিত্তি সম্পন্ন একটি অত্যাধুনিক ভবনের দ্বিতীয় তলা পর্যন্ত নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে ইতিমধ্যে। ভবন নির্মাণ শেষ হলেও এতদিন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়নি।তবে বিগত জানুয়ারি থেকে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ভর্তি ফরম বিতরণ শুরু করে অনানুষ্ঠানিকভাবে।

প্রতিষ্ঠানটির অফিস সহায়ক শ্যামল কান্তি পাল জানান, ৬ থেকে ১৩ বছর বয়সি ৮ জন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। মোট আসন সংখ্যা ১০টি।ভর্তিকৃত সকলেই সমাজ সেবা বিভাগ কর্তৃক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কার্ডপ্রাপ্ত এবং নিবন্ধিত। সমাজসেবা বিভাগের পরিভাষায় ভর্তিকৃতদের নিবাসী বলা হয়।ইতিমধ্যে এ প্রতিষ্ঠান ভর্তিকৃত ভাগ্যবান নিবাসীরা হচ্ছে মোঃ বোরহান উদ্দিন, মোঃ আরহান উদ্দিন, মোঃ রবিউল হুসাইন জিসাত, শয়ন মল্লিক, মোস্তফা কায়সার জিহাদ, রাশেদুল ইসলাম, আবসার মিয়া ও রাকিবুল ইসলাম। ভবনের প্রথম তলায় রয়েছে রিসোর্স শিক্ষক ও হাউস প্যান্টের আলাদা কক্ষ, স্টোররুম, রান্নাঘর, দুইটি গোসলখানা, একটি করে বাংলা ও ইংলিশ কমেট বাথরুম।দ্বিতীয় তলায় রয়েছে দুইটি নিবাসী কক্ষ।যার একটিতে ৬টি ও অন্যটিতে চারটি স্টিলের খাট রয়েছে।

আরো রয়েছে ডাইনিং রুম, দুইটি গোসলখানা এবং একটি করে বাংলা ও ইংলিশ কমেট বাথরুম।নিবাসী কক্ষে ১০ জন নিবাসীর জন্য সমপরিমাণ স্টিলের পড়ার টেবিল ও চেয়ার।নিবাসী শিক্ষার্থীদের জন্য আরও রয়েছে বালিশ, লেপতোষক, চাদর, বিছানাপত্র ও স্টিলের আলনা।অফিস সহায়ক আরো জানান, চলতি মাসের মধ্যেই একটি ডিপফ্রিজ ও ৩২ ইঞ্চি একটি রঙ্গিন টিভি আনা হচ্ছে। নিজস্ব অর্থায়নে এ সব ব্যবস্থা করেছে জেলা সমাজসেবা অফিস।

নিবাসীরা জানায়, প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রতিদিন তাদেরকে তিনবেলা ভাত ও দুইবেলা নাস্তা দেয়া হয়। ভাতের সাথে কখনো মুরগি, কখনো চিংড়ি মাছ, কখনো ডিম, আবার কখনো সবজি বাশাক দেয়া হয়। প্রতিবেলায় থাকে ডাল। এ সব দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের শিক্ষাদানের মাধ্যম হচ্ছে ব্রেইল শিক্ষা পদ্ধতি।তবে এ পদ্ধতির বইপত্র সংগ্রহ এবং রিসোর্স শিক্ষক এখনো নিয়োগ দেয়া হয়নি।তবে কক্সবাজার সদর উপজেলা সমাজসেবা অফিসে কর্মরত কারিগরী প্রশিক্ষক শিমুল শর্মাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে সপ্তাহে তিনদিন তথারবি, সোম ও বৃহস্পতিবার এ প্রতিষ্ঠানের নিবাসীদের শিক্ষাদান ও দেখাশোনার জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

আরো জানা যায়, জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের পক্ষ থেকে অত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য একজন হাউজ প্যারেন্ট কাম শিক্ষক, একজন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর এবং একজন বাবুর্চি নিয়োগের জন্য চাহিদা পত্র পাঠানো হয়েছে মন্ত্রণালয়ে। এ দিকে ভর্তিকৃত নিবাসীদের অভিভাবকরা প্রায় সময় এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কয়েকদিন পরপর এসে তাদের সন্তানদের খোঁজ খবর নেন বলে জানা গেছে।প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও কার্যক্রমে সন্তুষ্ট বলে জানালেন ঈদগাঁও দক্ষিণ মাইজপাড়া থেকে ভর্তি হওয়া নিবাসীর পিতা মোস্তাক আহমদ। তিনি বলেন, দেখে শুনেই তারা শিশুদের এ প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়েছেন।

কর্মরত অফিস সহায়ক শ্যামল কান্তি পাল জানান, তিনি ২০১৫ সালে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগদানের পর থেকে এর সার্বিক দেখভাল করে আসছেন। ছাদের উপর তার উদ্যোগে বোতাম, গেজা, মধু, জবাসহ বিভিন্ন ফুলের গাছ লাগানো হয়েছে। যা থেকে বর্তমানে হরেক রকম ফুল ফুটছে।প্রতিষ্ঠান আঙ্গিনায় তথা সামনের উঠানে শসা, লেবু, পেঁপে, ঝিঙ্গাসহ শাকসবজি ও ফলের গাছরোপন করেছেন।নিবাসীদের দেখাশুনা, খাওয়া দাওয়া করানো, গোসল- আসল, খেলাধুলা, বিনোদন ব্যবস্থাসহ সবকিছুর দেখভালো তাকেই করতে হচ্ছে।এ সমস্ত কাজে তাকে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন নিজের স্ত্রী এবং তার স্কুল পড়ুয়া মেয়ে মনি।

জেলা সমাজ সেবা কার্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোঃ তৈয়ব আলী জানান, নতুন এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি প্রতিবন্ধীদের জীবনমান উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।বিশেষ করে সমাজের অবহেলিত ও দরিদ্র পরিবারের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের ব্রেইল পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের মাধ্যমে তাদের ভবিষ্যৎ জীবন গঠন সম্ভব হবে।তার মতে, প্রতিবন্ধীদের বিভিন্ন শ্রেণী রয়েছে। এর মধ্যে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হচ্ছে অন্যতম শ্রেণী।তাদেরকে সাধারণ ব্যবস্থাপনায় শিক্ষিত করা সম্ভব নয়।

কক্সবাজার জেলায় প্রথমবারের মতো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের শিক্ষিত করে তুলতে এই প্রতিষ্ঠান বিরাট ভূমিকা রাখবে। যার মাধ্যমে তারা স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারবে।জেলা সমাজসেবা বিভাগের সহকারি পরিচালক শফি উদ্দিন জানান, প্রতিষ্ঠানটি কক্সবাজার বাসীর জন্য একটি বড় অর্জন।কক্সবাজারে এ ধরনের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হওয়ায় তিনি বেশ সন্তোষ প্রকাশ করেন।

তিনি জানান,, গত ১৪ জুলাই সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কক্সবাজার সফরে আসলে তাকে অত্র প্রতিবন্ধী প্রতিষ্ঠানের জন্য রিসোর্স শিক্ষকের পদ সৃষ্টি, জনবল বাড়ানো এবং নিবাসীদের আসন বৃদ্ধির জন্য প্রস্তাবনা ও সুপারিশ সহকারে চিঠি দেয়া হয়েছে।তিনি ভবিষ্যতে এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্থানীয় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের সেবাকার্য ক্রম আরো বৃদ্ধি করা যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক প্রীতম কুমার চৌধুরী জানান, মহাপরিচালকের সাথে কথা বলে এ কার্যক্রমের জন্য সদর উপজেলা সমাজসেবা অফিস থেকে একজন কর্মকর্তাকে প্রেষণে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ভর্তিকৃত নিবাসীরা পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারবে।তবে তাদের সকলের খাওয়া দাওয়া, নাস্তা ও চিকিৎসা খরচ সরকার বহন করবে।তিনি এ ভবনটি ২ বছর পূর্বে নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে জানিয়ে বলেন, পর্যায়ক্রমে এর উন্নয়ন করা হবে।

উল্লেখ্য, বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তৎকালীন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের একান্ত ইচ্ছায় ঈদগাঁহতে এ ধরণের একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।মন্ত্রী থাকাকালীন তিনি ঈদগাঁহতে এসে সম্ভাব্য স্থান পরিদর্শন করে তাতে প্রতিষ্ঠানটি বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় অনুমোদন কার্যক্রম সম্পন্ন করেছিলেন।পরিদর্শনকালে তার সাথে ঈদগাঁহতে এসেছিলেন কক্সবাজার জেলা সমাজসেবা অফিসের তৎকালীন উপ-পরিচালক প্রয়াত সুধীরচন্দ্র শুক্লা দাস।

মহাজোট সরকারের আমলে এসে প্রতিষ্ঠানটি তার স্বপ্নযাত্রা শুরু করেছে।তবে এলাকার সচেতন মহল মনে করেন,সমাজসেবা কতৃপক্ষ যদি ব্যতিক্রমধর্মী এ প্রতিষ্ঠানের সুফল ও সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনা জনগণের মাঝে তুলে ধরেন, আগামীতে প্রতিবন্ধীদের অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের নিরাপদ ও স্বনির্ভর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে এগিয়ে আসবেন বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন।

Exit mobile version