সশস্ত্র শোডাউন ও ব্যাংক ডাকাতি করে কেএনএফ-এর কী লাভ হলো?

fec-image

কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এখন “টক অব দ্য কান্ট্রি”। কেএনএফ গত কয়েকদিন ধরে দখল করে আছে মিডিয়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোযোগ এবং দেশের সচেতন নাগরিক সমাজের আগ্রহ। বিশেষ করে গত ২ এবং ৩ এপ্রিল বান্দরবান জেলার দু’টি প্রধান উপজেলা রুমা এবং থানচিতে পরপর দুইদিন প্রায় একঘণ্টা উপজেলা সদরকে নিয়ন্ত্রণ করে ৭০ জনের মতো সশস্ত্র ব্যক্তি দু’টি ব্যাংকের তিনটি শাখায় ডাকাতি করে, নিরাপত্তা রক্ষী ও আনসারের ১৪টি অস্ত্র লুট করে এবং একজন ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণ করে সারাদেশে একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনার জন্ম দিয়েছে। কেএনএফ যে সবার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে, এ মনোযোগ আতংকের; এ মনোযোগ দুশ্চিন্তার; এ মনোযোগ নিরাপত্তার হুমকির!

২০১৭ সালে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ গঠিত হওয়ার পর থেকে বান্দরবান জেলাসহ গোটা পা‍র্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্নভাবে আতংক ছড়িয়েছে; বিশেষ করে অপহরণ, চাঁদাবাজি, হত্যা, জঙ্গিদের ট্রেনিং দেওয়া এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করার কারণে কেএনএফ গোটা বাংলাদেশে একটি পরিচিত নাম হয়ে উঠেছে। সত্যি বলতে কী, ১৯৯৭ সালের পর থেকে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) বনাম ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এর মধ্যে করা দ্বন্দ্ব-সংঘাত যেভাবে মিডিয়া কাভারেজ পেয়েছে এবং মিডিয়ার শিরোনাম হয়েছে, ২০১৭ সালের পরে কেএনএফ সেটা রীতিমতো নিজেদের দখলে নিয়ে নিয়েছে।

কেএনএফ-এর প্রতিষ্ঠাতা নাথান বম নিজে একটি রহস্যজনক চরিত্র হিসেবে হাজির হয়েছে; বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে গ্রাজুয়েট করার পরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নানান অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে এবং বম সম্প্রদায়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সংগঠক হিসেবে হাজির হওয়া একজন তরুণ কেন কেএনএফ এর মতো সংগঠন তৈরি করে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে, তা নিয়েও বহুমূখী বিচার-বিশ্লেষণ চলেছ যার এখনও কোনও কুল কিনারা হয় নাই। ইতোমধ্যে বম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন হিসেবে কেএনএফ “বম পার্টি” হিসেবে পরিচিতি পেলেও বম জাতিসত্তার কয়েকজনকেও কেএনএফ ইতোমধ্যে অপহরণ করে হত্যা করেছে। তাদের অপরাধ, কেএনএফ-এর ভাষ্যমতে, তারা সরকারের দালাল এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্পাই হিসেবে কাজ করেছে। এরই মধ্যে কেনএফের ফেসবুক পেইজে বান্দরবান এবং রাঙ্গামাটির কয়েকটা উপজেলা নিয়ে এটি স্বতন্ত্র “কুকি-চিন স্টেট” করার ঘোষণা দিয়ে কেএনএফ নিজেরাই নিজেদেরকে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন হিসেবে পরিচিত দিয়েছে।

এছাড়াও কেএনএফ-এর শতাধিক সদস্যকে ভারতের মণিপুর রাজ্যে পাঠিয়ে কুকি বিদ্রোহীদের দ্বারা সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশে ফিরিয়ে এনে “কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি” (কেএনএ) গঠন করে নিজেদেরকে একটি শক্তিশালী সংগঠন হিসাবে জানান দিয়েছে। তথাপি সম্প্রতি ব্যাংক ডাকাতি, অস্ত্রলুট, অপহরণ এবং উন্মুক্তভাবে সশস্ত্র মহড়া অতীতের সকল ঘটনাকে ছাপিয়ে গেছে। এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কেএনএফ এর সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি’ গঠন করা হয় যারা ইতিমধ্যে দুই দফা শান্তি সভা করেছে, পরবর্তী শান্তি সভা হওয়ার কথা ছিল ৫ এপ্রিল এবং ২২ এপ্রিল একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে উভয়পক্ষ নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। এরকম একটি সময়ে কেএনএফ কেন হঠাৎ করে এত বড় সশস্ত্র মহড়া দিয়ে শোডাউন করল তা নিয়ে চলছে নানান বিচার বিশ্লেষণ।

আমি নিজে পত্রিকান্ত লিখেছি, “কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টস নাম দেয়ার কারণে ভারতের মিজোরাম, মণিপুর ও নাগাল্যান্ডে বসবাসকারী বিভিন্ন কুকি জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন ‘সশস্ত্র’ ও বিদ্রোহী সংগঠনগুলোর সঙ্গে তাদের একটা যোগাযোগ আছে সেটা তারা এরই মধ্যে স্বীকার করেছে। আবার মিয়ানমারের চিন রাজ্যে চিন ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্সের সঙ্গেও তাদের একটা সংযোগ আছে। যেহেতু ভারতের মণিপুরের কুকিদের সঙ্গে স্থানীয় মেইতেইদের সশস্ত্র বিরোধ চলছে এবং সেখানে কুকিরা একটা শক্ত প্রতিরোধ তৈরি করছে। আবার মিয়ানমারের চিন রাজ্যে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে চিন ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স তুমুল লড়াই করছে এবং এ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে জান্তা বাহিনীকে পরাজিত করে চিন ন্যাশনাল ডিফেন্স ফো‍র্স একের পর এক টাউন দখল করছে। ভারতে কুকিরা এবং মিয়ানমারের চিনরা যখন সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেদের দাবি আদায় করছে, তখন বাংলাদেশে বসে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট কেন টেবিলে বসে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের এত দিনের পরিশ্রমে গড়া ২৫০-৩০০ সদস্যের ব্যাটালিয়ন শান্তির চুক্তি স্বাক্ষরের নামে আত্মসমর্পণ করবে? এ কারণে শান্তি প্রতিষ্ঠার যে চলমান প্রক্রিয়া…বন্ধ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে কেএনএফ শোডাউনটি করেছে,…[এবং] সেটা সফল হয়েছে।” এখন প্রশ্ন হচ্ছে ব্যাংক ডাকাতি করে এবং উন্মক্ত সশস্ত্র মহড়া দিয়ে শক্তিমত্তার শোডাউন করে কেএনএফের আখেরে কি লাভ হলো?

সরকার পুরো বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে কেএনএফ-এর সাথে সব ধরনের শান্তি আলোচনা বাতিল করা হয়েছে। কম্বাইন অপারেশনের মধ্য দিয়ে কেএনএফকে নির্মূল করার অভিযান ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এই ঘটনার পর থেকে কেএনএফ এর সদস্যরা রীতিমতো পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে, জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে, এবং মিডিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী নাথান বম ইতোমধ্যে ভারতের মিজোরামে পালিয়ে অবস্থান নিয়েছে।

এই ঘটনার পরে স্থানীয় জনগণের কাছে কেএনএফ নতুন করে একটা আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে। কেএনএফ-এর কর্মকাণ্ডের কারণে খোদ বম সম্প্রদায়ের মধ্যেও কেএনএফ-এর বিরুদ্ধে একটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হচ্ছে এবং পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের কাছে কেএনএফ একটা সন্ত্রাস ও আতংকের নাম হয়ে উঠেছে। বান্দরবানের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা সদরে এই ধরনের সশস্ত্র মহড়া এবং প্রায় ঘণ্টাখানেক সেটা নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়টি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য একটা চরম হুমকিস্বরূপ বিবেচিত হয়েছে এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে চিরুনি অভিযানের মধ্য দিয়ে যৌথ অভিযান শুরু করেছে। শান্তি প্রতিষ্ঠার আলোচনার মধ্য দিয়ে কেএনএফ আলোচনার টেবিলের দরকষাকষির মাধ্যমে যা কিছু অর্জন করতে পারার সম্ভাবনা ছিল, সেটাও নষ্ট করেছে এবং কেএনএফ-এ যোগদানকারী সদস্যদের ভবিষ্যতকেও হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে কেএনএফ বরঞ্চ নিজের শক্তিমত্তা দেখাতে গিয়ে নিজের ভবিষ্যতকে চরম ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। শান্তি আলোচনার টেবিল থেকে বেরিয়ে এসে কেএনএফ খুব বেশি লাভবান হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। তবে, তাদের শক্তিমত্তা জানান দিয়ে দর-কষাকষির জায়গায় হয়তো নিজদের অবস্থানটা আরও শক্ত করার একটা পরিকল্পনা থাকতে পারে। কিন্তু ব্যাংক ডাকাতি, অস্ত্রলুট, ব্যাংকের ম্যানেজারকে অপহরণ এবং উন্মুক্ত সশস্ত্র যে শোডাউন করেছে, এতে করে প্রকারান্তরে কেএনএফ নিজেদের আলোচনার টেবিলে বরং দুর্বল করেছে বলে আমি মনে করি। এখন যদি টেবিলে আলোচনার পরিবর্তে অস্ত্রের ভাষায় তাদের মোকাবিলা করা হয়, শেষ পর্যন্ত ক্ষতি কিন্তু কেএনএফ-এরই হবে। ফলে, এ ঘটনায় মোটাদাগে কেএনএফ এর খুব বেশি লাভবান হয়নি।

পরিশেষে বলবো যে প্রক্রিয়ায় এবং যে পদ্ধতিতে কেএনএফ তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে, তা দিয়ে বম জনগোষ্ঠীরসহ কুকি-চিন ক্যাটাগরির অন্যান্য জনগোষ্ঠীর (খুমি, খেয়াং, লুসাই, ম্রো, পাংখোয়া) জন্য আখেরে কোনও সুফল বয়ে আনতে পারবে না। যদি এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে, তবে যে সামাজিক সংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রান্তিকায়নের প্রেক্ষাপটে কেএনএফ-এর জন্ম হয়েছে বলে কিছুটা সহানুভূতি নাথান বম এবং তার সহযোগীদের জন্য প্রান্তিক আদিবাসী মানুষের মনে এবং অন্তরে আছে, সেটাও ক্রমান্বয়ে দূরীভূত হবে। কেএনএফ একটি জনবিচ্ছিন্ন সংগঠনের পরিণত হবে এবং ইতিহাসের পাতায় একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে লিপিবদ্ধ হবে। সুতরাং ব্যাংক ডাকাতি, অস্ত্র লুট, ম্যানেজার অপহরণ ও উন্মুক্ত সশস্ত্র মহড়া কেএনএফের জন্য হিসেবের খাতায় কেবল শূন্যই নয়, বরঞ্চ মাইনাস পয়েন্ট যোগ করেছে।

পা‍র্বত্য চট্টগ্রামের পিছিয়ে পড়া এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর স্বা‍র্থে ভবিষ্যতে নাথান বমের খানিকটা পলিটিক্যাল স্কোর যোগ-বিয়োগের বাল্যশিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।

লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 

সূত্র: বাংলাট্রিবিউন

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কেএনএফ, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সন্ত্রাসী হামলা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন