parbattanews

সাধারন পাহাড়িদের শোষণ করার হাতিয়ার পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধিমালা- ১৯০০

১৯০০ সালের ৬ই জানুয়ারী ‘হিল ট্র্যাক্টস ম্যানুয়েল’ বা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধিমালা প্রণয়ন করেছিলো ইংরেজরা। যার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে দেশের একটি অনিয়মিত জেলা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই বিধিমালা সাধারণ মানুষকে কোন সুবিধা না দিলেও, উপজাতীয় সামন্ত প্রভুদের ব্যাপক সুবিধা দিয়েছিল।

১৯০০ সালের হিল ট্র্যাক্টস ম্যানুয়েল বা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধিমালাকে একটা অন্যতম দলিল হিসেবে পাহাড়িরা গণ্য করে থাকে, যদিও ওই বিধিমালার বেশিরভাগ ধারা ছিল উপজাতীয়দের জন্য অবমাননাকর। বাহ্যত এটিকে দেখে মনে হবে এর মাধ্যমে পাহাড়িদের ভূমিপুত্র হিসেবে সেখানে ‘স্বীকৃতি’ দিয়েছে বৃটিশরা। কিন্তু আদতে তা ছিল না।

কারন সেখানে জেলা প্রশাসকের অনুমতি ব্যতীত বাইরের কারো পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু কেন নিষিদ্ধ ছিল, তা উপজাতি ‘অ্যাক্টিভিস্ট’ কিংবা সুশীল ‘দরদীরা’ উল্ল্যেখ করেন না!

বিধি অনুসারে গোটা পার্বত্য জেলার বিধাতা বনে যান জেলা প্রশাসক বা ডেপুটি কমিশনার, যিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে থেকে ইংরেজ কর্তৃক নিযুক্ত হবেন! এই বাক্যটি উপজাতি নেতারা খুব সচেতনভাবে এড়িয়ে যান। এই বিধিমালার উল্ল্যেখযোগ্য কয়েকটি বিধান হচ্ছেঃ
পার্বত্য এলাকা ‘নন-রেগুলেটেড এরিয়া’ বা ‘অনিয়ন্ত্রিত’ এলাকা হিসেবে ঘোষিত হয়, যেখানে জেলা প্রশাসকের অনুমতি ব্যাতিত কেউ প্রবেশ করতে কিংবা বসতি স্থাপন করতে পারবে না।

উপজাতীয়রা পঁচিশ বিঘা জমি ব্যবহার করতে পারবে, কিন্তু মালিক হতে পারবে না।
বিচারালয়ে কোন উকিল থাকবে না। সার্কেল চীফ, হেডম্যান ও কারবারিরা থাকবে।
দরকার হলে উপজাতীয়রা বিনা পারিশ্রমিকে সরকারি কর্মকর্তাদের চাহিদা মোতাবেক কাজ করে দিতে বাধ্য থাকবে।

সার্কেল চীফ, হেডম্যান এমনকি কারবারিরাও তাঁর অধীনস্থ উপজাতীয়দের খাটাতে পারবে কোন পারিশ্রমিক না দিয়েই!

যদিও এই বিধিতে বৃহত্তর পার্বত্য উপজাতীয় জনগোষ্ঠী পরিনত হয় দাস আর ইংরেজ-সামন্ত চক্র বনে যায় প্রভু, তথাপি এই বিধিকে বলা হয় স্বায়ত্বশাসনের অধিকার! অথচ, সেখানে অধিকার বলতে কিছুই ছিল না পার্বত্যঞ্চলের অধিবাসীদের। অর্থনীতি ও শাসন প্রায় পুরোটাই থাকে ইংরেজ ডেপুটি কমিশনার তথা জেলা প্রশাসকের হাতে, বাকী কিছুটা থাকে তাদের আজ্ঞাবহ সামন্ত-রাজন্যবর্গের হাতে!

পার্বত্যঞ্চলের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগানোর জন্য ইংরেজরা হাতির জন্য উপযুক্ত সরু পথ ও নয় মাইল পরপর নির্মান করে বিশ্রামাগার। কারন, হাতি একদিনে নয় মাইলই হাটতে পারে। এই বিধিতে উচ্চবিত্ত চাকমা পরিবার ইংরেজদের কাছে নানা সুবিধা লাভ করে।

কিন্তু একটি মাত্র ধারা যার জন্য এটাকে উপজাতি নেতারা আঁকড়ে ধরতে চায় তা হলো, পার্বত্য অঞ্চলে জেলা প্রশাসকের অনুমতি ছাড়া বাইরের কেউ সেখানে যেতে বা বসতি স্থাপন করতে পারবে না। কিন্তু এই বিধি যুক্ত করার মূল কারন হচ্ছে, উনিশ শতকের শেষের দিকে ব্রিটিশের সাথে যুদ্ধরত কুকিদের ঠেকানো।

পার্বত্য চট্টগ্রামে কুকিদের জঙ্গি হামলার উপদ্রব ঠেকাতে তৎকালীন ব্রিটিশরাজ ১৯০০ সালের হিল ট্র্যাক্টস ম্যানুয়েল জারি করতে বাধ্য হয়। এটার সাথে পাহাড়িদের ভূমিপুত্র হিসেবে ‘স্বীকৃতি’ দেয়া বা ‘সম্মানিত’ করার কিছু ছিল না। একই সাথে ছিল না বাঙালিদের নিয়ে সমস্যাও। ওই সময়কার ব্রিটিশ হিসেবেই দেখা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যার শতকরা তিন ভাগ বাঙালি মুসলমান।

এছাড়া তৎকালীন সময়ে সেখানে বাঙালি কিংবা অন্যান্য জাতিগোষ্ঠির মানুষ হরহামেশাই জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করতে পারতো। সুতরাং বর্তমানে বাঙালিদের আগমন বন্ধ করতে এই বিধিমালার দোহাই যে দেওয়া হচ্ছে, তার নৈতিক ভিত্তি কতটুকু? এসব বরং সন্দেহ জাগানিয়া!

এছাড়া আরও অনেক কিছু দেখেই আমার বক্তব্য পরিস্কার হবে। এই বিধিমালায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করে ওই এলাকার বাসিন্দাদের নাগরিক অধিকার বঞ্চিত আশ্রিত জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এছাড়া তাদের ভূমিধিকার ছিল না। উপজাতীয় কারবারিদের শুধু যাযাবর জুম চাষের পাঁচসালা বিলিব্যবস্থা ও বন্য প্রাণী রক্ষণাবেক্ষণের ভার দেয়া হয়।

বাঙালিদের দেখাদেখি খুবই সামান্যসংখ্যক উপজাতীয় হালচাষ রপ্ত করে। বিধিমালায় স্পষ্ট করে লেখা ছিল উপজাতীয়রা পঁচিশ বিঘা জমি ব্যাবহার করতে পারবে, কিন্তু মালিক হতে পারবে না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ দেশে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হওয়া সত্ত্বেও তিন উপজাতীয় প্রধানকে জমিদারি স্বত্ব দেয়া হয়নি।

শুধু সার্কেল চীফ খেতাব দিয়ে খুশি রাখা হয়েছিল। তাদের ক্ষমতা ছিল কেবল খাজনা আদায় করার! তখনকার সময় এর আর্থিক মূল্য থাকলেও এখন সেই মূল্য নামেমাত্র! অথচ নামেমাত্র মূল্যের সেই খাজনা এখনও তারা আদায় করে।

এমনকি কেবল অ-উপজাতি বাঙালিদেরই দেয়া হয় হাট-বাজারের দায়িত্ব (সূত্রঃ শরদিন্দুর চাকমা, মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম)। এজন্যই পার্বত্য চট্টগ্রামে যে উন্নয়ন হয়েছে, দেশের অন্যান্য অংশের সাথে তারা তাল মিলিয়ে চলতে ফিরতে পারছে এই অঞ্চল, তার প্রায় সিংহভাগ কৃতিত্ব বাঙালিদের।

আর আইনী দিক যদি বিবেচনা করি, তাহলে বলতে হয় ১৯২০ সালে স্বয়ং ইংরেজরাই পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘এক্সক্লুসিভ এরিয়া’ ঘোষণা দিয়ে সেখানে বহিরাগতদের আগমন প্রক্রিয়া সহজ করেছিল। এমনকি পাকিস্তান সরকার এই গোটা বিধিমালাই একবার বাতিল করেছিল, সাধারন পাহাড়িদের স্বার্থে। পরে সেটি আবার চালু করে।

যেহেতু এই বিধিমালা সৃষ্টি যারা করেছিল, সেই বৃটিশরাও এই বিধিমালার মধ্যে যেই বিশেষ বিধিটির প্রতি বর্তমানে পাহাড়ি নেতাদের প্রচন্ড আগ্রহ তা বাতিল করেছিল এবং বৃটিশদের পরের শাসকও একবার গোটা বিধিমালাটিই বাতিল করেছিল, সেহেতু এর কার্যকারীতাকে আদর্শ বলে বিবেচনা করা যায় না। তবুও যারা অবুঝ, তাদের জন্য বিধিমালার কিছু বিষয় আবার তুলে ধরছিঃ

  • ১) উপজাতীয়রা পঁচিশ বিঘা জমি ব্যাবহার করতে পারবে, কিন্তু মালিক হতে পারবে না।
  • ২) বিচারালয়ে কোন উকিল থাকবে না।
  • ৩) দরকার হলে উপজাতীয়রা বিনা পারিশ্রমিকে সরকারি কর্মকর্তাদের চাহিদা মোতাবেক কাজ করে দিতে বাধ্য থাকবে।
  • ৪) সার্কেল চীফ, হ্যাডম্যান এমনকি কারবারিরাও তাঁর অধীনস্থ উপজাতীয়দের খাটাতে পারবে কোন পারিশ্রমিক না দিয়েই!

এখন বলুন প্রিয় পাঠক- যদি হিল ট্র্যাক্টস ম্যানুয়েল আইন পরিপূর্ণভাবে প্রযোজিত করা হয়, তাহলে সেটাতে কি সাধারন পাহাড়িদের অধিকার সংরক্ষিত হবে? এই বিধিগুলো সাধারন পাহাড়িদের উপকার করবে, নাকি উপজাতীয় কতিপয় এলিট নেতাদেরকে?

Exit mobile version