সাম্প্রতিক বন্যায় শিক্ষা ও যোগাযোগ খাতে ১০৯ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে- মো. মশিউর রহমান এনডিসি

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মশিউর রহমান এনডিসি বলেছেন, সাম্প্রতিক বন্যায় শিক্ষা ও যোগাযোগ খাতে প্রায় ১০৯ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়াও অন্যান্য খাতেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এসব ক্ষয়ক্ষতি মেরামত করতে সরকারের কাছে অর্থ বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। আশা করছি খুব দ্রুতই সকল ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। তিনি আরো বলেন, বান্দরবানে এবারের ভয়াবহ বন্যার মূল কারণ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন। বান্দরবানে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে তিনি সম্প্রতি বান্দরবান সফর করে এসে তার সফরের অভিজ্ঞতা নিয়ে সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে পার্বত্যনিউজের মুখোমুখি হন। পার্বত্যনিউজের পক্ষে কথা বলেন, সম্পাদক মেহেদী হাসান পলাশ
পার্বত্যনিউজ: বন্যা পরবর্তীকালে সম্প্রতি আপনি পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করে এসেছেন। আপনার অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাই।
মশিউর রহমান: আপনাকে ধন্যবাদ। আমি পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেয়ার পর রাঙামাটি ও বান্দরবান এ দুটি পার্বত্য জেলা সফর করেছি। সাম্প্রতিক যে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে তাতে বান্দরবান জেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সেগুলো আমি সরেজমিনে ঘুরে দেখে এসেছি। অনেক রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালতের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষয়ক্ষতিগুলো আসলে পুননির্মাণ পুষিয়ে দেয়ার জন্য ইতোমধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সফর করেছেন এবং তা নিরূপণ করার জন্য তাদের মত করে সংস্কারে জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। আপনারা জানেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনেও কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেমন, জেলা পরিষদগুলো, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড- তারা যোগাযোগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন খাতে উন্নয়নমূলক কাজ করে থাকে। সেসব উন্নয়নমূলক কাজে কেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেটা নিয়ে আমাদের এসকল প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিবেদন দিতে বলেছিলাম, তারা সে প্রতিবেদন দিয়েছে। তাতে দেখা যায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ যে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা গিয়েছে তা প্রাথমিকভাবে ১০৯ কোটি টাকার মতো। যা বরাদ্দ পেতে অর্থ মন্ত্রণালয় বরাবর চিঠি দিয়েছি এবং আমাদের মন্ত্রীও একটি ডিও লেটার দিয়েছেন অর্থমন্ত্রীকে, উনারা যেনো এ টাকাটা বরাদ্দ দেয়। আমরা যদি সেই অর্থ বরাদ্দ পাই তারপর আমরা সংস্কারমূলক কাজ শুরু করতে পারব। এই হলো বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির বিষয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আরেকটি বিষয় হলো সেখানকার অশান্ত পরিবেশ যা দীর্ঘদিন ছিল। যা দূর করার জন্য বর্তমান সরকার ১৯৯৭ সালে একটি শান্তিচুক্তি করেছে। সে শান্তিচুক্তিতে ৭২টি দফা ছিল, যার মধ্যে ৬৫টি দফা আমরা বাস্তবায়ন করেছি। বাকিগুলো কোনটা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে, কোনটা বাস্তবায়নাধীন আছে। আমরা যে ৬৫টি দাবি করি সেখানে জেএসএস বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে। এটা হবার কারণ হলো হিসাবের ভুল বুঝাবুঝি ও গড়মিল থাকার কারণে হয়েছে। সেগুলো আসলে কীভাবে সমাধান করা যাবে তা আমার সফরের পর তা উপলব্ধিতে এসেছে, তাদের কিছু অসন্তুষ্টি রয়েছে। পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের কমিটি রয়েছে, যার চেয়ারম্যান আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ সাহেব, সে কমিটির সাথে আমাদের সিদ্ধান্ত হয়েছে, আমরা জেএসএসের সাথে বসব। সেখানে প্রতিটি দফা ধরা হবে, তখন কোনটা বাস্তবায়ন হয়েছে বা তারা বলেছে হয় নি তা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবো।
তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে আমরা কিছু উন্নয়মূলক কর্মকাণ্ড হাতে নিয়েছি। আপনারা শুনে খুশি হবেন যে, আজকেই প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একনেকে একটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। যা পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক একটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। টাকার অংকে ১৩০০ কোটির টাকার বেশি। যা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ঋণ সহায়তায় আমরা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি। প্রকল্পে ৫টি কম্পোনেন্ট রয়েছে- যার গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো রাস্তা-ঘাট, ব্রিজসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো, যা বাস্তবায়ন করবে এলজিআরডি, আর বাকি ৪টি বাস্তবায়ন করবে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ। সেখানেও ছোট ছোট অবকাঠামোগত কাজ রয়েছে। ওয়াটার শেড নির্মাণ, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, শিক্ষা, নাগরিকদের আয়বর্ধক কারিগরি প্রশিক্ষণ এমন ধরনের নানাবিধ উদ্যোগ রয়েছে এই প্রকল্প।
এছাড়াও আরও কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করার জন্য আমরা ইতোমধ্যে প্রস্তুতি নিচ্ছি, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছি। আমরা ইতোমধ্যে ইউএডিপি, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও আমাদের অন্যান্য উন্নয়সহযোগীদের সঙ্গে আমরা আলাপ-আলোচনা করেছি, যারা আসতে চান। আমি আসলে বিশ্বাস করি তাদের অসন্তুষ্টির আসল কারণ হলো পশ্চাৎপদতা ও আর্থিক অবস্থা। আমরা যদি শিক্ষার মধ্যে পশ্চাৎপদতা থেকে বের করে নিয়ে আসতে পারি, আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে পারি, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে পারি, শিক্ষার উন্নয়ন ঘটাতে পারি তাহলে এই সমস্যা অনেকাংশেই আমরা সমাধান করতে পারব, সেভাবেই এগিয়ে যাচ্ছি।
পার্বত্যনিউজ: উন্নয়নগুলো প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে না বলে অভিযোগ করেছে প্রান্তিক পর্যায়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও বাঙালিদের দিক থেকে। এই বৈষম দূরীকরণে আপনারা কিভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন?
মশিউর রহমান: বিষয়টি আমিও শুনেছি এবং সরেজমিনে গিয়ে উপলব্ধিও করেছি। কোন কোন ক্ষেত্রে যে বৈষম্যটি নেই তা আমি বলব না, অবশ্যই বৈষম্য রয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, সেখানে বৃহৎ যে সকল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী রয়েছেন তারা আসলে শিক্ষা ও আর্থিক অবস্থায় অনেকে এগিয়ে আছেন অন্যান্যদের তুলনায়। যারা শিক্ষা, আর্থিক অবস্থা ও সংস্কৃতিতে পশ্চাৎপদ রয়েছেন, তারাই আসলে পিছিয়ে থেকে যান। সেই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য পিছিয়ে পড়া জাতি গোষ্ঠিকে বিশেষ গুরুত্ব ও সুযোগ দিয়ে এগিয়ে নিয়ে আসতে হবে। তাহলেই বৈষম্য দূর করা যাবে। যেমন উদাহরণ হিসেবে যদি বলি, দু একটা রিমোট এরিয়া আছে যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক দূরে বাস করে। তাদের পক্ষে এসে শিক্ষা নেয়া কষ্টসাধ্য। তাই আমরা একটা প্রকল্পের মাধ্যমে ৪টা বোর্ডিং স্কুল চালু করেছি। আরো বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। যেখানে ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুল শেষে বাড়ি না গিয়ে স্কুলের বোর্ডিং এ থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যাতে পারবে। এখন যত রিমোট এরিয়ায় থাকুক না কেন,এখানে থেকে পড়াশোনা করতে পারবে। এর ফলে বৈষম্য দূরিভূত হবে।
পার্বত্যনিউজ: আপনি কর্মসংস্থানের কথা বলছিলেন। সম্প্রতি আপনি থানচি ও রুমা সফর করেছেন। সেখানে কুকি-চিন নামক একটি নতুন অস্ত্রধারী জনগোষ্ঠীসহ ৬টি প্রান্তিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী লড়াই করছে। দাবি করছে তারা শান্তি চুক্তির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অথচ শান্তি চুক্তির পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যপক উন্নয়ন সাধন, কর্মসংস্থান ও স্কলারশিপ ব্যবস্থা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, এই বৃহৎ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও প্রান্তিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে উন্নয়ন বৈষম্য নিরসনে কী করণীয়?
মশিউর রহমান: এ ব্যপারে আমাদের পদক্ষেপ রয়েছে এবং কার্যক্রম চলছে। আপনি জানেন যে, পার্বত্য অঞ্চলে জনগণের দ্বারা তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর চাকরি নিশ্চিতকরণ এখান সম্ভব হচ্ছে। এই যে নিয়োগ হচ্ছে, তা যেন সমানভাবে হয় সে জন্য যতগুলো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রয়েছে তাদের ভাগ করে কোটার মাধ্যমে চাকরিসহ অন্যান্য সুবিধা দেয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, আমরা যেসব প্রকল্প হাতে নিচ্ছি তাতে এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের প্রাধান্য সবচেয়ে বেশি থাকে। আর আপনি কুকি-চিন নামে যে জনগোষ্ঠীর কথা বলেছেন, তাদের বক্তব্য শোনা বা সাক্ষাতের সুযোগ আমার হয় নি। তবে আমার বিশ্বাস তারা বর্তমান সরকারর এই ব্যপক উন্নয়ন ধারায় শরিক হবে। এবং তাদের অংশগ্রহণে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি বিরাজমান হবে।
পার্বত্যনিউজ: আপনার মতে পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন কার্যক্রমে প্রধান অন্তরায় বা বাধা কী ?
মশিউর রহমান: আমি মনে করি প্রধান অন্তরায় বা চ্যালেঞ্জ হতে পারে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন, শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন। কেননা কিছু কিছু জনগোষ্ঠীর শিক্ষার মান ভালো কিন্তু বেশ সংখ্যক জাতিগোষ্ঠী এই সুযোগ পায় না। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা আর আমরা জানি যে পার্বত্য এলাকায় ব্যপক সম্পদ রয়েছে তা উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যবহার করতে পারলেই অত্র এলাকার মানুষেরা মূল ধারার উন্নয়নে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারবে।
পার্বত্যনিউজ : এবারের বন্যার এত ভয়াবহতার কারণ কী?
মশিউর রহমান: এর কারণ বলা বেশ মুশকিল, কেননা আমি কোন বিশেষজ্ঞ নই। তবে এবারের বন্যা শুধু পার্বত্য অঞ্চলে না বিশ্বের দিকে তাকালে বন্যার কারণ আরো পরিস্কার হওয়া যাবে। আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের হিমাচল থেকে শুরু করে বেশ কিছু প্রদেশে ব্যাপক আকারে বন্যা দেখা যায়। তা থেকে এটা বলা যায়, জলবায়ু পরিবর্তন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর বড় কারণ। তাছাড়া পার্বত্য অঞ্চলে বন ধ্বংস ও গাছপালা নিধন করে জুম চাষ, পাহাড় কাটা অন্যতম কারণ। অন্যদিকে পাহাড় ছুঁয়ে যখন বৃষ্টির পানি, ঝর্ণার পানি এবং ঝিরির পানি প্রবাহের সময় যে বেলেমাটি ক্ষয় হয়, তা প্রবাহিত স্থানে জমে জমে বাঁধ তৈরি হয়ে পানি পাহাড়ে থেকে যাচ্ছে। যার ফলে পাহাড়ের বেলে মাটি নরম হয়ে ব্যপকভাবে পাহাড় ধস দেখা দেয়। আর পাহাড়ি অঞ্চলে সারাবছর যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয় তা এবার কয়েক সপ্তাহে তার প্রায় সম পরিমাণ হয়েছে। যার কারণে এই বন্যা।
পার্বত্যনিউজ: পার্বত্যনিউজকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মশিউর রহমান: আপনাকে ও পার্বত্যনিউজকে ধন্যবাদ।
সাক্ষাতকারটি ভিডিওতে দেখুন: