খাগড়াছড়ির রণাঙ্গনে জিয়াউর রহমান

স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়ার ভূমিকা আড়াল করতে ছিল বহুমুখী ষড়যন্ত্র

fec-image

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে মেজর জিয়াউর রহমান ছিলেন নেতৃস্থানীয় ভূমিকায়। তিনি শুধু স্বাধীতার ঘোষণা দেননি, রণাঙ্গনে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। খাগড়াছড়িসহ চট্টগ্রামের অন্তত ৮টি স্থান ছাড়াও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে জিয়াউর রহমান পাকবাহিনীর সাথে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব ও নেতৃত্বের কারণে তিনি পেয়েছিলেন বীর উত্তম খেতাব। কিন্তু জিয়াউর রহমান নিজের কৃতিত্বে কথা কখনো বলেননি বা তার এমন কৃতিত্বে কথা প্রকাশ হয়নি।বরং মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়াউর রহমানের কৃতিত্ব আড়াল করে রাখতে বছরের পর বছর চলেছে বহুমুখী ষড়যন্ত্র। মিডিয়ার উপরও মহান স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস প্রচারে ছিল নিষেধাজ্ঞা।
মেজর জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব ও নেতৃত্বের কারণে তিনি পেয়েছেন বীর উত্তম খেতাব। জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করার পর কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।তার এ ঘোষণা শোনার পর সেনাবাহিনী সদস্য ও সাধারণ মানুষের মাঝে উত্তেজনা আরো বাড়িয়ে দেয়। চট্টগ্রাম শহরের দখল না রাখতে পারলেও ১১ এপ্রিল পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে কালুরঘাটে থেকে ইস্ট বেঙ্গলের সেনা, ইপিআর ও পুলিশ সদস্যদের নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন। এই যুদ্ধে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনীর ২০ বেলুচ রেজিমেন্ট।২৭ মার্চ পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ইস্ট বেঙ্গলের সেনারা চট্টগ্রামে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।
কিন্তু ঐদিন সকালে পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটেলিয়ন বিমান বোঝাই করে চট্টগ্রামে পৌঁছলে শেষ পর্যন্ত আর চট্টগ্রাম শহরের দখল রাখতে পারেননি জিয়াউর রহমান।অবশেষে জিয়াউর রহমান রাঙামাটির বন্দুকভাঙা হয়ে খাগড়াছড়ির মহালছড়ি ডাক বাংলোতে এসে অবস্থান করে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। আসার পথে তিনি পাকবাহিনীর চলার পথ রুদ্ধ করতে ব্রিজ-কালভার্ট নষ্ট করে দেন। মহালছড়িতে কয়েক দিন অবস্থানের পর তিন সীমান্ত শহর রামগড়ে চলে আসেন এবং রামগড়ে ঘাঁটি স্থাপন করে ট্রেনিং সেন্টার খুলে।
১০ এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনায় মেজর জিয়াউর রহমানকে কমান্ডার করে গঠন করা হয় ১ নম্বর সেক্টর। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেওয়ার পাশাপাশি পাক সেনাদের ওপর আক্রমণ। ২৫ জুন পর্যন্ত ১ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন জিয়াউর রহমান।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে রামগড়ে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের ভূমিকা নিয়ে নানা তথ্য দিয়েছেন, রামগড় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে মহান স্বাধীনতার ঘোষণা শোনে মুক্তিকামী জনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। জিয়াউর রহমান রামগড় পৌঁছে রামগড় সরকারী হাই স্কুল মাঠে ট্রেনিং সেন্টার খোলেন। রামগড় পোষ্ট অফিসের দোতলায় তিনি অবস্থান করে খাগড়াছড়ি ছাড়াও চট্টগ্রামের শুভপুরসহ বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন।
জিয়াউর রহমানের সহযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা সমর কৃষ্ণ চক্রবর্তী জানান, তৎকালীন মেজর জিয়ার কণ্ঠে স্বাধীনতা ঘোষণা শুনে সামরিক বাহিনী ও সাধারণ মানুষ উজ্জীবিত হয়। অবসর প্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর সদস্যরসহ মানুষ রাস্তায় নেমে আছে।জিয়াউর রহমান রামগড় আসার সময় বেশ কিছু পাকবাহিনীর সদস্য গ্রেফতার করে নিয়ে আসেন। আসার পথে অনেকগুলো ব্রিজ উড়িয়ে দেন।পোষ্ট অফিসে সারা দিন অবস্থান করে যুদ্ধ পরিচালনা করতেন ও রামগড় থানায় রাত্রী যাপন করতেন। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান রামগড়ের অবস্থান করে খাগড়াছড়ির মহালছড়ি,মানিকছড়ির চেপ্রুপাড়া,গাড়ীটানা ছাড়াও চট্টগ্রামের শুভপুর ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়া, কুমিরা, মিরসছড়া, জোরালগঞ্জ ও তুলাতলী এলাকায় পাক হানাদার ও মিজোবাহিনী সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, সরাসরি যুদ্ধ করেছেন, অথচ তার কৃতিত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। যা দুঃখজনক।
মহালছড়ির প্রবীণ চিকিৎসক ডাক্তার শ্রী স্বপন চক্রবর্তী বলেন, জিয়াউর রহমান যুদ্ধের একপর্যায়ে মহালছড়ির ডাকবাংলোতে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। একপর্যায়ে তিনি তরুণ সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরকে মহালছড়ির দায়িত্ব দিয়ে রামগড় চলে যান।
ডাক্তার শ্রী স্বপন চক্রবর্তী বলেন, ২৭ এপ্রিল খাগড়াছড়ির সবচেয়ে বড় সম্মূখ যুদ্ধটি মহালছড়িতে। সেখানে পাক বাহিনীর কমান্ডো ব্যাটালিয়নের এক কোম্পানী সৈন্য ও একটি মিজো ব্যাটালিয়নের প্রায় ১ হাজার সেনা সাথে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর প্রচন্ড আক্রমণ শুরু করে। এ সময় সেনাবাহিনীর তরুণ সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের অসীম সাহস আর সুদক্ষ যুদ্ধ কৌশল নিয়ে শত্রুদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। একপর্যায়ে এক সহযোগী যোদ্ধাকে বাঁচাতে গিয়ে শত্রুদের কয়েকটি গুলি আফতাবের শরীরে এসে বিদ্ধ হলে তিনি শহীদ হন। জেলার রামগড়ে রয়েছে তার কবরস্থান। তিনি হচ্ছে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে একমাত্র শহীদ সেনা কর্মকর্তা।
মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ ও গৌরবোজ্জ্বল অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৩ সালে সরকার ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরকে মরণোত্তর “বীর উত্তম” উপাধীতে ভূষিত করা হয়। ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরের মৃত্যুর পর প্রথমে মহালছড়ি এবং ২ মে রামগড়ের পতন হয়।
মহালছড়ির প্রবীণ সাংবাদিক দীপক সেন বলেন, রামগড়ে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ৮টি স্থানে যুদ্ধ হয়েছে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়াউর রহমানের ভূমিকাকে আড়াল করা ও লুকানোর জন্য স্বাধীন বাংলার বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের তথ্য নষ্ট করা হয়েছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের ২৬ জুন মেজর জিয়াউর রহমানকে সেক্টর কমান্ডার করে গঠিত হয় ১১ নম্বর সেক্টর। এই সেক্টরের আওতাধীন এলাকা ছিল কিশোরগঞ্জ মহকুমা বাদে সমগ্র ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল জেলা এবং নগরবাড়ি-আরিচা থেকে ফুলছড়ি-বাহাদুরাবাদ পর্যন্ত যমুনা নদী ও তীর অঞ্চল। ৭ জুলাই ১ম, ৩য় ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ২য় ফিল্ড আর্টিলারি ব্যাটারি নিয়ে গঠিত হয় জেড ফোর্স ব্রিগেড। এই ব্রিডের কমান্ডার ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্যাঞ্চলের পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলের স্বাধীন অঞ্চলগুলো নিরাপদ রাখা ছিল জিয়াউর রহমান ও তার অধীনে গঠিত জেড ফোর্সের অন্যতম প্রধান কাজ। এর অংশ হিসেবে জিয়াউর রহমানের নির্দেশে ও পরিকল্পনায় জেড ফোর্স বেশ কয়েকটি অঞ্চল স্বাধীন করে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলে। মুক্তিযুদ্ধের সময় জিয়াউর রহমান বিখ্যাত সব যুদ্ধের নির্দেশনা ও পরিকল্পনা করেছিলেন। কামালপুরের প্রথম যুদ্ধ, বিলোনিয়ার যুদ্ধ, নকশী বিওপির যুদ্ধ, বাহাদুরাবাদ যুদ্ধ, দেওয়ানগঞ্জ থানা আক্রমণ, চিলমারী উভচর অভিযান, হাজীপাড়া, ছোটখাল, গোয়াইনঘাট, টেংরাটিলা, গোবিন্দগঞ্জ, সালুটিকর বিমানবন্দর, ধলাই চা-বাগান, ধামাইচা-বাগান, জকিগঞ্জ, আলি-ময়দান, এমসি কলেজ, ভানুগাছ, কানাইঘাট, বয়মপুর, ফুলতলা চা-বাগান যুদ্ধসহ অসংখ্য যুদ্ধ মেজর জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ নির্দেশ ও পরিকল্পনায় হয়েছিল। সে সব ঐতিহাসিক সত্য এতো দিন প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি।
নতুন প্রজম্মে জন্য খাগড়াছড়িতে ঘটনা বহুল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠ্য-পুস্তকে লিপি বদ্ধ করলে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ জিয়াউর রহমানের ভূমিকা দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার হবে- এমন দাবি মুক্তিযোদ্ধাদের।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন