হঠাৎ জান্তা কেন রোহিঙ্গাদের ফেরাতে চাইছে?

fec-image

কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া তালিকাভুক্ত ৮ লাখ রোহিঙ্গাদের মধ্যে এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার যোগ্য বলে জানিয়েছে দেশটির জান্তা সরকার। চূড়ান্ত যাচাই-বাছাইয়ের পর্যায়ে আছে আরো ৭০ হাজার রোহিঙ্গা। এছাড়াও বাকি ৫ লাখ রোহিঙ্গার যাচাই-বাছাইয়ের কাজ জরুরি ভিত্তিতে করবে বলে জানিয়েছে জান্তা সরকার। বাংলাদেশে প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি খলিলুর রহমানকে এ কথা জানিয়েছেন মায়ানমারের জান্তা সরকারের প্রধানমন্ত্রী ইউ থান সিউ। গত ৪ এপ্রিল থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে এ দুই নেতার মাঝে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে উক্ত ঘোষণা দেয় মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। উল্লেখ্য বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ১২ লক্ষাধিক নিবন্ধিত রোহিঙ্গা বসবাস করছে।

এ ঘোষণার পর বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটিকে যুগান্তকারী হিসেবে চিত্রিত করা হচ্ছে। মূলত বাংলাদেশ ২০১৮ থেকে ২০ সালের মধ্যে ছয় ধাপে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদেরকে তালিকা দেয় সেই তালিকা থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা নিয়ে মায়ানমারের এই ঘোষণা সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে দৃশ্যমান আলোক রশ্মির মত বাংলাদেশের জনগণের একাংশের মাঝে প্রতিভাত হচ্ছে। এর আগে এই তালিকা থেকে মিয়ানমার কখনো দুই-তিন হাজারের বেশি সার্টিফাই করেনি। শেখ হাসিনা মরিয়া হয়ে টোকেন রোহিঙ্গাদেরকে ফিরিয়ে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার ক্রেডিট নেয়ার লক্ষ্যে ওই তালিকা মেনেও রোহিঙ্গাদেরকে ফেরাতে চেষ্টা করেছিল। তারই অংশ হিসেবে ২০২৩ সালের অক্টোবরে চীনের মধ্যস্থতায় ১১০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর একটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল কিন্তু সেটিও সফল হয়নি। এ লক্ষ্যে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজারের টেকনাফে পাঁচটি ট্রানজিট ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছিল। চাইনিজ কূটনীতিকরাও এসেছিলেন কিন্তু রোহিঙ্গারা যেতে চায়নি।

এর কারণ ছিল মিয়ানমার মূলত ওই তালিকা প্রণয়নে একটি প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিল। তারা স্বামীকে বাদ দিয়ে স্ত্রীকে, বাবাকে বাদ দিয়ে সন্তানকে, মেয়েকে বাদ দিয়ে মাকে তালিকাভুক্ত করেছিল। এতে করে পরিবারের একাংশ বাংলাদেশের রেখে আরেক অংশ আরাকানে ফেরত যেতে চায়নি। তাছাড়াও রাখাইনে কোন প্রত্যাবাসন ক্যাম্পে ফেরত যেতে রোহিঙ্গারা বরাবরই অনাগ্রহ প্রকাশ করেছে। তাদের দাবি তাদের ফেলে আসা ভিটেমাটিতেই কেবল তাদের প্রত্যাবাসন করতে হবে। কিন্তু সেখানে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত নয়। এছাড়াও পশ্চিমা এনজিও ও দাতা সংস্থাগুলো চীনের মধ্যস্থতায় এই প্রত্যাবাসন সমর্থন করেনি বলে অভিযোগ ছিলো। ফলে সে সময় ওই সামান্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনও আলোর মুখ দেখেনি।

প্রশ্ন উঠতে পারে, এহেন জান্তা সরকার এখন কেন রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে এত আগ্রহী হয়ে পড়ল? এতে বর্তমান সরকারের সাফল্য কতটুকু? উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট ১১ লক্ষ রোহিঙ্গাকে চরম নির্যাতনের মাধ্যমে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার পর থেকে বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের কূটনৈতিক সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। এরপর ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত এক চুক্তি হয়। এই চুক্তিও মিয়ানমারের পক্ষে ছিল। কেননা এখানে রোহিঙ্গাদেরকে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। এর পরিবর্তে তাদেরকে Forcibly Displaced Myanmar Nationals (FDMNs) বলে আখ্যা দেয়া হয়।

এরপর মিয়ানমার শীর্ষ পর্যায়ের কোন নেতার সাথে বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের কোন নেতার বৈঠক হয়নি। এই দুই দেশের মধ্যে শীর্ষ পর্যায় কোন ভ্রমণ বিনিময় ঘটেনি। এমনকি ২০১৯ সালের ৮ থেকে ১১ ডিসেম্বর বাংলাদেশের তৎকালীন সেনার প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ মিয়ানমার সফর করেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই সফরকে ইতিবাচক লক্ষে উপস্থাপন করা হলেও প্রকৃতপক্ষে সেই সফরে বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের সাথে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান সাক্ষাৎ করেননি। যা ছিল অত্যন্ত অবমাননাকর। উপরন্ত তার এই সফরকে ঘিরে দেশের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এক বিবৃতিতে দাবী করেন, নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে ১০ ডিসেম্বর যখন রোহিঙ্গাদের গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মামলার শুনানি শুরু হবে, তখন মানবতাবিরোধী মিয়ানমারের অভিযানে ক্ষতিগ্রস্ত অন্যতম পক্ষ বাংলাদেশ৷ বিবৃতিতে তারা আরো বলেন, আমরা মনে করি, বাংলাদেশের পক্ষে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান অভিযুক্ত দেশের সেনাপ্রধানের সাথে বৈঠক করলে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তা দেশের জন্য বড় কলঙ্কজক এবং অবমাননাকর ঘটনা হবে৷” তারা এটাকে সরকারের ‘দ্বিমুখী ও আত্মঘাতী নীতি’ বলে অভিহিত করেন৷

প্রকৃতপক্ষে শেখ হাসিনা নোবেল পুরস্কারের লোভে বাংলাদেশের দুইটা বড় ক্ষতি করেছেন একটি জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা বিরোধী শর্ত সম্বলিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এবং ১১ লক্ষ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়ার অনুমতি। এরপর যথেষ্ট লবিং করে নোবেল পুরস্কার না জুটলেও তার স্তাবকগণ তাকে ‘মাদার অফ হিউম্যানিটি’ খেতাবে ভূষিত করে। অন্যদিকে কক্সবাজারে এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার উপস্থিতিতে সৃষ্ট শরণার্থী সমস্যায় পশ্চিমা দেশগুলোর অংশগ্রহণ ও উপস্থিতি বঙ্গোপসাগর তথা ভারত মহাসাগর কেন্দ্রিক পশ্চিমা ভু-রাজনীতির প্রভাব বিস্তারে নতুন মাত্রা যুক্ত করে। হঠাৎ করেই শেখ হাসিনার প্রভাব বেড়ে যায় পশ্চিমা বিশ্বে, যার উপর ভর করে তিনি ২০১৮ সালের নৈশ ভোটের নির্বাচন করে পার পেয়ে যান।

শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানের পরিবর্তে এই ইস্যু ব্যবহার করে তার অবৈধ শাসন ক্ষমতার বৈধতা ও প্রলম্বিত করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এ কারণেই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশ কখনই তার নিজস্ব স্বার্থ সম্বলিত নীতি গ্রহণ ও অগ্রসর হতে পারেনি। বাংলাদেশ তার রোহিঙ্গা নীতিতে সবসময়ই ভারত, চায়না, যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্ব কী চায় তা সমন্বয় করে নীতি ও কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। তাতে বাংলাদেশে কী চায় বা বাংলাদেশের কী প্রয়োজন সেটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ফলে রোহিঙ্গা সমস্যার কোন সমাধানের কোন পথ তার আমলে খোলেনি। সেই প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারের শীর্ষ নেতার পক্ষ থেকে বাংলাদেশের শীর্ষ নেতার সাথে বৈঠকে আগ্রহ প্রকাশ এবং বৈঠক অনেকটা অপ্রত্যাশিত মনে হতেই পারে।

তবে আমরা বাস্তবতার চোখে পুরো বিষয়টা যাচাই করে দেখতে চাই। সে কারণে মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতির উপরে আমরা চক্ষু বোলানো যেতে পারে। বর্তমানে মিয়ানমারের প্রায় ৪৫ শতাংশ ভূখণ্ড সে দেশের বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে মিয়ানমার সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। সবচেয়ে আলোচিত রাখাইন ও চিন স্টেট এর নিয়ন্ত্রণ ইতোমধ্যেই হারিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। রাখাইনের ৯০% বিদ্রোহী আরাকান আর্মির দখলে। রাজধানী‌ সিটুয়ে ও বন্দরনগরী কিয়াকফিউ আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে পুরো রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ হারাবে তারা। রাখাইনের অন্যান্য অঞ্চল দখলে আরাকান আর্মি যেভাবে বিচ্ছিন্নকরণ কৌশল অবলম্বন করেছে, এক্ষেত্রে সমুদ্র তীরবর্তী এই দুইটি শহরে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকার সমুদ্রপথে সাপ্লাই চেইন অব্যাহত রাখতে পারার কারণে আরাকান আর্মিকে শহর দুটি নিয়ন্ত্রণেতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। তবে আর এখানে আর্মি চলতি বছরের মধ্যেই এই দুটো শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার টার্গেট ঘোষণা করেছে। এটা সম্পন্ন হলে পুরো রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ আরাকান আর্মির হাতে আসার পরে রাখাইন এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

এখানেই সামরিক জনতার সবচেয়ে বড় ভয়। কেননা কিয়াকফিউ বন্দরনগরীতে চাইনিজ সরকারের অর্থায়নে ডিপ সি পোর্ট নির্মিত হয়েছে। মিয়ানমার-চায়না ইকোনমিক করিডোর (সিএমইসি) প্রকল্পের আওতায় এই বন্দর থেকে মান্দালয় হয়ে চীনের কুনমিং পর্যন্ত বহুমুখী যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। এছাড়াও পাইপ লাইন নির্মিত হয়েছে গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম সরবরাহের জন্য। অন্যদিকে সিটুয়েতে কালাদান নদীর তীরে ভারত আরেকটি ডিপ সি পোর্ট নির্মাণ করেছেন। এখান থেকে পেলেটাও, কালেটাও, জরিনপুই, লংলাই হয়ে মিজোরামের রাজধানী আইজল পর্যন্ত রোড নেটওয়ার্ক সংযুক্ত হয়েছে। এটি ভারতের বিলিয়ন ডলারের একটি ড্রিম প্রজেক্ট। এর মাধ্যমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া বন্দর থেকে রাখাইনের সিটুয়ে বন্দর মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হবে এবং সেখান থেকে মিজোরামের আয়জল পর্যন্ত পণ্য পরিবহন করা হবে। প্রধান উপদেষ্টা যে বললেন, ভারতের ভূ-বেষ্টিত সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোর জন্য আমরাই একমাত্র সামুদ্রিক অভিভাবক এটি কতটা সঠিক সেটাও বিচার্য। কেননা ভারত উল্লিখিত রুটে ইতোমধ্যেই বিকল্প তৈরি করে ফেলেছে।

চায়নার প্রভাবে আরাকান আর্মি প্রথম দিকে কালাদান প্রজেক্টে বাধা প্রদান করলেও ক্রমান্বয়ে ভারত আরাকান আর্মির সাথে ক্রমান্বয়ে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলে তাদের কালাদান প্রজেক্ট রক্ষার অঙ্গীকার ইতিমধ্যে আদায় করে ফেলেছে। এই প্রজেক্ট বাস্তবায়নের জন্য ভারত আরাকান আর্মিকে নানাভাবে সহযোগিতা করছে। এরমধ্যে রয়েছে রাখাইনের অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ সহায়তা এবং মিজোরাম থেকে রাখাইনে বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। মিজোরাম আরাকান আর্মির সিনিয়র নেতাদের অনেকেই স্বপরিবারে বসবাসের অভিযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যেই আরাকান আর্মির অনেক নেতা বৈদেশিক যোগাযোগের জন্য ভারতীয় পাসপোর্ট জোগাড় করে ফেলেছে এমন কথাও শোনা যায়। এহেন অবস্থায় আরাকান আর্মি সিটুয়ে ও কিয়াকফিউ শহর ও বন্দরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে পারে তাহলে তাদের সামনে বিশাল বঙ্গোপসাগর উন্মুক্ত হয়ে পড়বে। তখন আজকে আরাকান আর্মি তার লজিস্টিক সাপোর্টের জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের স্থল সীমান্তের উপর এখন যেভাবে নির্ভরশীল তা অনেকখানি হ্রাস পাবে।

এই সমুদ্রসীমায় সিটুয়েতে ভারত এবং কিয়াকফিউ ও ইয়াঙ্গুনে চায়না ডিপ সি পোর্টের মাধ্যমে সংযুক্ত হলেও বিশ্বের ওপর দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া অনুপস্থিত। বঙ্গোপসাগর কেন্দ্রিক বৈশ্বিক ও রাজনীতির আগামী দিনের নতুন মল্লক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মতো পরাশক্তি অনুপস্থিত থাকতে পারে না। ফলে তারাও আরাকান আর্মির সাথে আলোচনার মাধ্যমে মিয়ানমারের সমুদ্র তটে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে আগ্রহী বলে আলোচনা রয়েছে। বিশেষ করে চাইনিজ সমুদ্র বন্দর কিয়াকফিউ এর নিকটবর্তী কোন আইল্যান্ডে অদূর ভবিষ্যতে বৈশ্বিক কোন পরাশক্তির উপস্থিতি দেখা গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

বঙ্গোপসাগরে ক্ষুদ্র এলাকার মধ্যে বিশ্বের তাবড় পরাশক্তিগুলোর অবস্থানের ফলে এর সন্নিহিত ভূ-ভাগ তথা মিয়ানমারের রাখাইন ও চিনে স্টেট, বাংলাদেশের কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ভারতের মিজোরাম, মনিপুর, নাগাল্যান্ড, অরুনাচল ঘিরে মানচিত্রের রি-ডিজাইনের যে আলোচনা বিভিন্ন ভূ-রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের আলোচনায় উঠে আসছে তার আলামত ইতোমধ্যেই এই অঞ্চলে দৃশ্যমান। মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লাল দোহমা গত নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে প্রকাশ্যেই তিন রাষ্ট্রের মধ্যে বিচ্ছিন্ন জো জাতিকে খৃষ্টবাদের ভিত্তিতে যে রিইউনিফিকেশনের ঘোষণা প্রকাশ্যে দিয়েছেন তা নিছক কথার কথা ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরার পর তিনি চীন স্টেটের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ঐক্য স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। এর ফলে সিএনএ’র ওপর তার সুস্পষ্ট প্রভাব বিস্তারের পথ খুলে গেছে। এখানেও পরিস্থিতিতে নন স্টেট এক্টরস হিসেবে আরাকান আর্মিকে নিয়ন্ত্রণে নেয়া বা কাছে টেনে নেয়া যুক্তরাষ্ট্রের মত পরা শক্তির জন্য অনেকটাই সহজ। এক কথায় বৈশ্বিক রাজনীতির এই নতুন প্রপঞ্চের মুখে দাঁড়িয়ে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এক কঠিন সংকটের মুখে উপনীত হয়েছে।

উদ্ভুত পরিস্থিতিতে রাখাইনের স্বাধীনতা রক্ষায় তার সামনে এখন একমাত্র অপশন রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়া। ইতিমধ্যেই মিয়ানমার জান্তা বাহিনী সেখানে থাকা রোহিঙ্গা গ্রাম গুলোতে ঢুকে যুবক থেকে কিশোর পর্যন্ত তরুণদেরকে জোর করে ধরে নিয়ে মিয়ানমার আর্মিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠিয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা যুবকদের মিয়ানমার আর্মিতে যোগ দিলে সেদেশের নাগরিকত্বসহ বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। শোনা যায়, বেশ কিছু রোহিঙ্গা এই ঘোষণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নাগরিকত্বের লোভে স্বদেশে ফিরে গিয়ে মিয়ানমার আর্মিতে যোগ দিয়েছে। কাজেই রাখাইনের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সেখানে নাগরিক হিসেবে বা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সহায়ক সহায়ক শক্তি হিসেবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ভিন্ন তাদের হাতে আর কোন অপশন নেই। আবার বহু বছর ধরে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত থাকায় মিয়ানমারে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার জন্য উপযোগি যুবকের সংখ্যায় ঘাটতি রয়েছে। এইজন্য মিয়ানমার আর্মি একদিকে যেমন অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যদেরকে সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে, অন্যদিকে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার জন্য বয়সসীমা কমিয়ে প্রায় শিশুদেরকে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। কাজেই আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে জান্তা সরকারের সামনে রোহিঙ্গা জনশক্তির কোন বিকল্প হাতে নেই। এহেন পরিস্থিতিতে জান্তা সরকারের পরিকল্পনায় ব্যবহৃত হতে রাজি ১ লাখ ৮০ হাজার কেন ১০ লাখ রোহিঙ্গা ফিরে গেলেও সামরিক জান্তা খুব বেশি আপত্তি করবে বলে মনে হয় না।

শুধু এখানেই শেষ নয়। জান্তা সরকারকে এখন আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করতে হলে তাকে এখন অবশ্যই বাংলাদেশের সমর্থন প্রয়োজন। কেননা বাংলাদেশ যদি আরাকান আর্মিকে সমর্থন বা সহায়তা দেয় তাহলে তার পক্ষে আর আরাকান আর্মিকে পরাজিত করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে তারা যদি রাখাইনকে মিয়ানমার ইউনিয়নের সাথে অটুট রাখতে চায় সেক্ষেত্রেও আরাকান আর্মিকে পরাজিত করতে বাংলাদেশের সহায়তা নেয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। এই সুযোগ ব্যবহার করে রোহিঙ্গা স্বাধীনতাকামী গ্রুপগুলোও এখন ক্রমান্বয়ে শক্তি বৃদ্ধি করে চলেছে।

এখানে আরো একটি দিকের কথা বলা প্রয়োজন। বছরের পর বছর গৃহযুদ্ধের ফলে মিয়ানমারের অর্থনীতির অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটাপন্ন। এর মধ্যে ২৮ মার্চের ভূমিকম্পে মিয়ানমারে যে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে তা অপসারণ ও পুনর্বাসনের অর্থনৈতিক কারিগরি ও জনশক্তি সক্ষমতা মিয়ানমার সরকারের নেই। এই ধ্বংসযজ্ঞ সরিয়ে মিয়ানমারকে আবার পুনর্বাসিত করতে তাদের যেমন দীর্ঘ সময় প্রয়োজন এবং একই সাথে যে আর্থিক বরাদ্দ প্রয়োজন তা সংকুলান করতে গেলে মিয়ানমার সরকারের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়বে। এই অবস্থায় বিদ্যমান যুদ্ধ চালিয়ে নেয়া মিয়ানমার সরকারের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আর এসুযোগ বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো নিতে পারে। সে কারণে জান্তা সরকার ভূমিকম্পের পরপরই একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে। এই ভূমিকম্পের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা ও পুনর্বাসনে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের দুটি দল সেখানে কাজ করছে। এজন্য জান্তা সরকার বাংলাদেশের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। প্রধান উপদেষ্টা প্রয়োজনে আরো সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে। উল্লেখিত সামগ্রিক বিষয়গুলো একসাথে বিবেচনা করলে প্রকৃতপক্ষে বোঝা যাবে মিয়ানমার সরকার কেন ৮ বছর পর ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা এবং পরবর্তীতে দ্রুততার সাথে আরও রোহিঙ্গাদের ডেটাবেজ যাচাই ও বাছাইয়ের কথা ঘোষণা করেছে। কেননা এটাই তাদের লাস্ট অপশন।

কিন্তু এতদ্বসত্ত্বেও মিয়ানমার সরকার কি রোহিঙ্গাদের সে দেশে ফিরিয়ে নিতে পারবে? রোহিঙ্গারা যেসব অঞ্চলে বসবাস করে সেসব অঞ্চল বর্তমানে পুরোপুরি আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। কাজেই এই মুহূর্তে রোহিঙ্গাদের যদি কেউ ফিরিয়ে নিতে পারে তা একমাত্র আরাকান আর্মিই পারবে। কিন্তু তারা সেটি করবে এটা মনে না করার যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান। যেমন,

১. আরকান আর্মি মূলত বুড্ডিস্ট ডমিনেটেড যারা চরমভাবে মুসলিম বিদ্বেষী।

২. আরাকান আর্মির প্রধান সমর্থক স্থানীয় রাখাইন বুড্ডিস্ট জনগোষ্ঠীও চরম রোহিঙ্গা বিরোধী। জান্তা সরকারের রোহিঙ্গা নিধনের সময় তাদের সহযোগী হিসেবে এরাই সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন করেছে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে স্থানীয় জনগণের সমর্থন হারানোর ভয়ে এ কাজটি তারা করবে না।

৩. রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা ঘরবাড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্ষেত-খামার, সহায়-সম্পদ রাখাইনরা দখল করেছে। কাজেই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে গেলে তাদেরকে সেগুলো ছেড়ে দেয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। সেকারণে তারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে।

৪. আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের মোটেই বিশ্বাস করে না।

৫. রোহিঙ্গাদের মধ্যে অন্তত ছয়টি গ্রুপ এবং তাদের উপর বিদেশি প্রভাবের কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন রাখাইনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পারে বলে আরাকান আর্মির ধারণা।

৬. ইতোমধ্যেই বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গা মিয়ানমার আর্মিতে যোগ দিয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে।

৭. রোহিঙ্গাদের নিয়ে সক্রিয় এনজিও ও দাতা সংস্থাগুলো তাদের ডোনেশন কালেকশন ও চাকরি হারানোর ভয়ে রোহিঙ্গা ইস্যু সেটেলমেন্টের বিপক্ষে।

৮. পশ্চিমাদের এই অঞ্চল নিয়ে তাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এখানে অস্থিতিশীলতা জিইয়ে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৯. ক্যাম্পে বসে ফ্রি খাওয়া, মাদক পাচার, মানব পাচার ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে ক্যাম্পের কুঁড়েঘরে থাকলেও রোহিঙ্গা মাঝি ও নেতাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে। এছাড়াও এনজিওগুলোতে ভালো বেতনে চাকরি, ক্যাম্পের বাইরে টেকনাফ থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সহজে যাতায়াত, চাকুরি ও ব্যবসা করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করেছে তারা। এমন সহজলভ্য অর্থ আয়ের উপায় ছেড়ে নিজ দেশের কষ্টকর জীবনে যেতে চায় না অনেকেই।

১০. আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, টার্কি সহ উন্নত দেশে নাগরিকত্বের টোপে রোহিঙ্গা তরুণরা দেশে ফিরতে চায় না।

সামগ্রিক বিষয় বিবেচনায় রোহিঙ্গা পুনর্বাসনে উল্লিখিত কারণগুলো ছাড়াও আরো বেশ কিছু কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অনেকটাই অসম্ভব। একমাত্র রাস্তা রোহিঙ্গারা যদি নিজেরা ফিরে যাওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে চেষ্টা করে এবং বাংলাদেশ তাতে সহায়তা করে।

প্রকৃতপক্ষে জান্তা সরকার কর্তৃক রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নেয়ার আগ্রহ মূলত রাখাইন এর সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখার শেষ চেষ্টার অংশ বিশেষ। রাখাইন এর নিয়ন্ত্রণ হারানোর পর থেকেই টাটমাডো রোহিঙ্গাদেরকে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাখাইনে থাকা রোহিঙ্গা যুবকদেরকে জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে মিয়ানমার আর্মিতে প্রশিক্ষণ দেয়ার অনেক ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রয়েছে। বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গা যুবকদের মিয়ানমার আর্মিতে যোগ দেয়ার বিনিময়ে দেয়া হয়েছে নাগরিকত্বসহ নানা প্রলোভনের টোপ। এতে অনেক রোহিঙ্গা যুবক ইতোমধ্যেই ক্যাম্প থেকে ফিরে গিয়ে মিয়ানমার আর্মির প্রশিক্ষণ নিয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে, অনেকে আবার প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ না করেই পালিয়ে এসেছে।

তাই এমুহূর্তে মিয়ানমারের অখণ্ডতা টিকিয়ে রাখার জন্য রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়া ছাড়া জান্তার কাছে ভিন্ন কোন অপশন নেই। আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ করার জন্য যেমন সৈনিক প্রয়োজন। একই সাথে যুদ্ধে জয় করা ভূখণ্ডের সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখতেও স্থানীয় জনগণের সমর্থন প্রয়োজন। এ কারণেই রাখাইন ফিরে পেতে জনতা সরকারের হাতে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার কোন বিকল্প নেই। এটাই হলো এই ঘোষণা ও আগ্রহের মূল কারণ। তবে বাংলাদেশ এহেন পরিস্থিতিতে দারুন অনুকুল সময়ে উপনীত হয়েছে। তারা বিদ্যমান দুই গ্রুপের নিকট থেকেই সুবিধা নিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে সেজন্য দরকার নিখাঁদ দেশপ্রেম।

♦ লেখক: সম্পাদক, পার্বত্যনিউজ, চেয়ারম্যান, সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশন

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: মিয়ানমার, রোহিঙ্গা, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন