হালদার চরে তামাকের বিকল্প তরমুজ চাষে ঝুঁকছেন চাষিরা

fec-image

দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র “বঙ্গবন্ধু হেরিটাজ” খ্যাত হালদা নদী। খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলার বিশাল চর জুড়ে ২০১৮ সালের আগে সেখানে প্রান্তিক কৃষকের বেশির ভাগই তামাক চাষ নির্ভর ছিল!

ফলে তামাক কোম্পানির লোভনীয় ফাঁদে পা দিয়ে নিঃস্ব হতো কৃষক। আর তামাকের চুলা থেকে নিগৃত বিষাক্ত রাসায়নিক পর্দাথে বিষাক্ত হতো হালদা নদীর মিঠা পানি! এশিয়া মহাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন খ্যাত অমূল্য সম্পদ হালদা রক্ষায় আন্দোলনকারী বিশেষজ্ঞদের দাবি ‘ হালদা নদী রক্ষায়’ সরকারের গৃহীত নানা পদক্ষেপে মাছের উৎপাদনশীলতা রক্ষায় সরকারের গৃহীত প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আইডিএফ) ও পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)।

সংস্থাগুলোর বিভিন্ন ধারাবাহিক কার্যক্রমের ফলে হালদার উজান খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় কমে এসেছে তামাক চাষ। হালদায় বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ নির্গতকারী তামাক চাষ কমে আসায় সতেজতা ফিরেছে হালদা পাড়ে। এক সময়কার তামাক চাষিরা পুরোদমে এখন শাক-সবজি ও মৌসুমী ফল চাষে সফলতা বয়ে আনছে।

তামাক চাষিদের বিকল্প জীবিকা সৃষ্টির ফলে উপজেলার গোরখানা, আছাদতলী, ছদুরখীল এলাকার চাষিরা ঝুঁকছে বিভিন্ন সবজি চাষাবাদে। এরই অংশ অংশ হিসেবে উপজেলার গোরখানা এলাকার ২০-২৫ জন চাষি তামাক চাষ ছেড়ে আইডিএফ ও পিকেএসএফের সহযোগিতায় মালচিং পদ্ধতিতে উচ্চ মূলের ফসল গ্রীষ্মকালীন তরমুজ ও অন্যান্য ফসলাদি চাষাবাদে উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছেন।

সরেজমিন ঘুরে সফল তরমুজ চাষি মো. রমিজ উদ্দীন, মো. চাঁন মিয়া, আলী মিয়া, ফারুক হোসেন ও খোরশেদ আলমের সাথে কথা জানা গেছে, এই প্রান্তিক কৃষকেরা আগে তামাক চাষে নিঃস্ব হয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে দূর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছিল! তামাক বিকল্প চাষে সরকারের সহযোগিতার খবরটি তারা প্রথমে গুরুত্ব দেয়নি। এক পর্যায়ে তামাক বিকল্প নানা প্রজাতির সবজি, বাগ-বাগানে অন্যদের আগ্রহ সফলতা বুঝতে পেরে তারাও এ বছর মালচিং পদ্ধতিতে তরমুজ চাষে জনপ্রতি ১০ শতক জমি তৈরি ও এর ওপর প্রশিক্ষণ নেন আইডিএফের হালদা প্রকল্পে।

গ্রীষ্মকালীণ তরমুজ চাষের ফলে এখন ৫ জনের ৫০ শতক জমিতে তরমুজের ফল-ফুলে এসব কৃষকের মন ছুঁয়ে যায়। মো. ফারুক হোসেন মা পারুল আক্তার জানান, আগে তামাক চাষ করে শারীরিক ও অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব হয়েছি! এবার তামাক বিকল্প তরমুজ চাষে ভাগ্য বদলের স্বপ্ন দেখছি। এখন গাছে ডগায় ডগায় তরমুজ পরিপক্ক হয়ে উঠছে। তবে এলাকার সড়ক যোগাযোগ খুব খারাপ হওয়ায় ক্ষেতের ফল বাজারজাত নিয়ে আমরা শঙ্কিত!

মো. রমিজ উদ্দীন বলেন, এক সময় আমি তামাক চাষে সবাইকে উদ্ভুদ্ধ করতাম! পরে তামাকের ক্ষতিকর দিক বুঝতে পেরে এখন তামাক বিকল্প সরকারের গৃহীত চাষাবাদে সবাইকে ডেকে আনছি। যারা সাড়া দিয়েছেন তারা কম-বেশি সকলের পরিবারে এখন স্বস্তি নিঃশ্বাস।
আগামী সপ্তাহ থেকে ক্ষেতের তরমুজ কাটা শুরু হবে।

এলাকার তরুণ শিক্ষক ও সংবাদকর্মী মো. রবিউল হোসেন বলেন, এক সময় তামাক চাষ নিয়ে সংবাদ প্রকাশে তথ্য বা ছবি সংগ্রহ করতে গেলে তামাক চাষিরা খারাপ আচরণ করত। অনেক পরে হলেও তারা তামাক চাষ ছেড়ে হালদাকে এবং পরিবার-পরিজনকে স্বস্তি দিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, হালদা রক্ষা কমিটির পরামর্শ ও মালচিং পদ্ধতিতে গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষ ও বিভিন্ন জাতের দেশি-বিদেশি সবজির আবাদসহ তামাকে বিকল্প চাষাবাদে ঝুঁকছেন প্রান্তিক কৃষকেরা। এতে যেমন স্বাস্থ্যঝুঁকি কমছে তেমনি পরিবেশেও ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছে। পাশাপাশি উৎপাদিত শাক-সবজি স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন অর্থনৈতিকভাবে।

এ বিষয়ে হালদা প্রকল্প ব্যবস্থাপক ও আইডিএফ’র মৎস্য কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, ২০১৮ সাল থেকে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এর PACE প্রকল্পের অর্থায়নে ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আইডিএফ) হালদা নদীর দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও মিঠা পানির প্রবাহ নিশ্চিত করনে হালদা’র উজান খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলার তামাক চাষীদের বিকল্প জীবিকায়ন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

এরই অংশ হিসেবে বিগত কয়েক বছর যাবত উপজেলার বাটনাতলী, গোরখানা, যোগ্যাছোলা, আছাদতলী এলাকায় তামাক চাষীদের বিকল্প জীবিকায়ন সৃষ্টির লক্ষে কৃষকের মাঝে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদান, সবজি বীজ, মাছের পোনা, মুরগীর বাচ্চা, উন্নত প্রজাতির পেঁপে, আম, কাঁঠাল, শরিফাসহ বিদেশি ফল রামবুটান ও ড্রাগন চারা বিতরণে এখন ওই এলাকার প্রান্তিক কৃষকেরা তামাক বিকল্প চাষাবাদে সাড়া দিচ্ছে।

বর্তমানে উৎপাদিত তরমুজ বাজারজাতকরণে আমরা চাষিদেরকে সহযোগিতা করবো। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম শহরে বিভিন্ন পাইকাররা ৭০০-৮০০ কেজি তরমুজ কেনার অর্ডার করেছে। এছাড়া ওই প্রত্যন্ত জনপদের রাস্তা-ঘাট উন্নয়নে সরকারের নানা পরিকল্পনার পাশাপাশি পিকেএসএফ প্রকল্পেও রাস্তা উন্নয়ন করা যায় কী না, সেটি নিয়েও আমরা চিন্তা ভাবনা করছি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন