হাসিনা সরকার পতনের পর আরাকান আর্মির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলেছে ভারত

কালাদান প্রকল্পের মূল অংশ হিসেবে ভারতীয় অর্থায়নে গড়ে তোলা সিত্তে বন্দর। ছবি: পিটিআই
fec-image

৫ আগস্টে বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ভারতের কাছে নিশ্চয়তার জায়গা না থাকায় চট্টগ্রাম বন্দর এর পরিবর্তে কালাদান মাল্টিমোডাল প্রকল্পের দিকে জোর দেয়। কিন্তু ওই অঞ্চলে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের কোনো কর্তৃত্ব ছিল না।

ফলে রাখাইনের নিয়ন্ত্রণে থাকা আরাকান আর্মির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে তোলে ভারত। কিন্তু এর আগে মিয়ানমারে ২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশটির সামরিক জান্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেছিল ভারত। এমনকি ক্ষমতা গ্রহণের পর জান্তা সরকার ভারত সীমান্তবর্তী প্রায় শতভাগ এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারালেও নীতি পরিবর্তন করেনি দিল্লি।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের গতকাল প্রকাশিত এশিয়াসংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ৫ আগস্টের পর আরাকান আর্মির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকও করেছে নয়াদিল্লি। এমনকি লংত্লাই জেলার ডেপুটি কমিশনার গোপনে সীমান্ত পার হয়ে পালেতাও টাউনশিপে গিয়েছেন।

এছাড়া মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যের শীর্ষ কর্মকর্তারা আইজলে আরাকান আর্মির প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। আর এ যোগাযোগগুলো গড়ে উঠেছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছায়।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং অভ্যুত্থান পরিচালনার পরপরই ভারতের লক্ষ্য ছিল নেপিদোর শাসকগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ অবস্থানে থাকা। যার পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল সীমান্ত নিরাপত্তা, আঞ্চলিক যোগাযোগ নিশ্চিত ও চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নিজেদের অবস্থান শক্ত করা।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযানে সহায়তার জন্যও তারা মিয়ানমারের একের পর এক শাসকের ওপর নির্ভর করেছে, যাদের অনেকেরই ঘাঁটি ছিল সীমান্তের ওপারে।

এ প্রেক্ষাপটে নরেন্দ্র মোদির সরকার ধরে নিয়েছিল, অভ্যুত্থানের পর নেপিদোর সামরিক সরকার সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়ী হবে। কিন্তু এ ধারণা ছিল মারাত্মক ভুল। মিয়ানমারের যেসব এলাকা ভারতের সীমান্তবর্তী, সেগুলোর ওপর ক্রমে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে সামরিক জান্তা। তবে এর পরও নেপিদোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখে দিল্লি।

ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট (পুবে চলো) নীতিমালায় পালেতাও ও সিত্তের অবস্থান কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মূলত এ দুই শহরকে কেন্দ্র করেই ভারতের অর্থায়নে বাস্তবায়ন হচ্ছে উচ্চাভিলাষী কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট।

২০১৮ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয়, যার আওতায় বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে শুল্কমুক্ত পণ্য পরিবহনের সুযোগ দেয়া হয়।

ফলে কালাদান প্রকল্পটির তাৎক্ষণিক গুরুত্ব কিছুটা কমে আসে। যদিও এটি ছিল ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির অংশ এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবেলায় একটি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। কিন্তু অবস্থার পটপরিবর্তন ঘটে ২০২৪ সালের আগস্টে।

শেখ হাসিনা সরকারের পতন ভারতের কালাদান প্রকল্প নিয়ে কৌশলগত হিসাব-নিকাশকে আমূল পাল্টে দেয়। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার বা ভবিষ্যতের কোনো সরকার চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে শুল্কমুক্ত পণ্য পরিবহন চালু রাখবে কিনা, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয় ভারতের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে।

ফলে নয়াদিল্লি আবার কালাদান প্রকল্পকে গুরুত্ব দিতে শুরু করে। তবে এ প্রকল্পে অগ্রসর হতে হলে আরাকান আর্মির সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা অপরিহার্য ছিল। শুধু কালাদান নয়, সীমান্ত নিরাপত্তা এবং চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের মতো অন্যান্য কারণেও এ সম্পর্ক গড়ে তোলার কৌশল সামনে আসে। ফলে ভারতের সরকার ধীরে ধীরে আরাকান আর্মি এবং চিন জনগোষ্ঠীর সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে থাকে।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত আরাকান আর্মির সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়। মিজোরামের লংত্লাই জেলার ডেপুটি কমিশনার (যিনি নয়াদিল্লির নিযুক্ত) গোপনে সীমান্ত পার হয়ে পালেতাও টাউনশিপে যান। কালাদান প্রকল্পের অগ্রগতি পরিদর্শন করেন।

এরপর মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যের সিনিয়র কর্মকর্তারা আইজলে আরাকান আর্মির প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন, যা হয় নয়াদিল্লির নির্দেশে। এছাড়া ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র কর্মকর্তারাও দিল্লি ও আইজলে আরাকান আর্মির প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তবে এ পুরো প্রক্রিয়াটি জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি।

গত বছর নভেম্বরে রয়টার্সের এক খবরে বলা হয়, ভারত নভেম্বরে দিল্লিতে একটি সেমিনারে মিয়ানমারের সেনাবিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এতে আরাকান আর্মি ছাড়াও চিন ও কাচিন সশস্ত্র গোষ্ঠীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। অনুষ্ঠানটি আয়োজন করেছিল ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্ট থিংকট্যাংক ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স।

অনুষ্ঠানে জ্যেষ্ঠ ভারতীয় কর্মকর্তারাও ছিলেন। এটি ছিল ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে মিয়ানমারের বিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রথম আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ। অনেকে ধারণা করেন, এ তথ্য ইচ্ছাকৃতভাবে ফাঁস করা হয়েছে, যাতে একদিকে ভারতের নতুন নীতির বার্তা পৌঁছায়, অন্যদিকে জান্তা সরকারের প্রতিক্রিয়া যাচাই করা যায়।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের তথ্যমতে, গত বছরের জুন থেকেই মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো নিয়ে নীতিপরিবর্তনের পরিকল্পনা করছিল ভারত। ৫ আগস্ট বাংলাদেশে সরকার পতনের পরিপ্রেক্ষিতে তড়িঘড়ি করে তা বাস্তবায়নের পথে হাঁটে নয়াদিল্লি, ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে তোলে আরাকান আর্মিসহ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন