১৫ বছরে দুর্নীতি-অনিয়মে ভেঙ্গে পড়েছে খাগড়াছড়ির প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম
ঘুষ বাণিজ্যে অযোগ্য ও দলীয় ক্যাডারদের নিয়োগ এবং স্বজনপ্রীতির কারণে দলীয়-প্রভাবশালীদের সংযুক্তি আদেশে শহরে নিয়ে আসা ও বর্গা শিক্ষকের কারণে খাগড়াছড়িতে প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম ভেঙ্গে পড়েছে। অনেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় চলছে বর্গা শিক্ষক দিয়ে। অনেকে বিদ্যালয়ে না গিয়ে করছে ঠিকাদারী ব্যবসা। এইভাবে গত ১৫ বছর ধরে চলছে খাগড়াছড়ির প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম। ফলে খাগড়াছড়িতে প্রাথমিক শিক্ষার মান কমছে। ঝড়ে পড়ছে দুর্গম এলাকার শিক্ষার্থীরা। শুধু তাই নয়, অন্য জেলার নাগরিকও ভুয়া-জাল সনদ দিয়ে খাগড়াছড়িতে শিক্ষাকতা করছেন। মিডিয়ার খবর প্রচার হলেও বিগত দিনে কোন ব্যবস্থা নেননি নিয়োগ প্রতিষ্ঠান খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ।
জানা গেছে, খাগড়াছড়িতে ৫৯৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের পদ তিন হাজার ১৬টি মধ্যে কর্মরত রয়েছেন দুই হাজার ৮৭৭ জন শিক্ষক। তার মধ্যে ৫৫ জন শিক্ষক রয়েছেন ডেপুটিশনে। তারা সংযুক্তির আদেশ নিয়ে শহরের বিদ্যালয়গুলোতে এসেছেন। ফলে দুর্গম এলাকার বিদ্যালয়গুলো শিক্ষক নেই বললেই চলে। এতে করে দুর্গম এলাকার বিদ্যালয়গুলো শিক্ষক সংকটে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে।
অভিযোগ রয়েছে, বিগত ১৫ বছরে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ অধীনস্থ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যতার পরিবর্তে প্রাধান্য দেওয়া হয় ঘুষ বাণিজ্য ও দলীয় ক্যাডার। ছিল পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি। শিক্ষক নিয়োগে জনপ্রতি ১৫-২০ লাখ টাকা উৎকোচ নেওয়া হয়। টাকা দিলে চাকরি হতো, না দিলে হতো না। স্থানীয় সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী ও পরিষদের সদস্যরা এমন দুর্নীতি ও অনিয়মের সাথে সরাসরি জড়িত ছিল। অনেকে টাকা দিয়েও নিয়োগ পাননি।
খাগড়াছড়ি শহরের মিলনপুরের বাসিন্দা কমল বিকাশ ত্রিপুরা অভিযোগ, তিনি তার এক আত্মীয়ের জন্য ১৫ লাখ নিয়োগের আগের দিন চেয়ারম্যানের হাতে পৌঁছে দেন। কিন্তু চাকরি হয়নি, টাকাও ফেরত পাননি। শুধু কমল বিকাশ ত্রিপুরা নয়, এ ধরনের বহু কমল সুদে টাকা দিয়েও চাকরি জোটেনি। বিগত দিনে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে নাগরিক সমাজ বিক্ষোভ-মিছিলসহ নানাভাবে প্রতিবাদ করলেও কোন প্রতিকার পায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর খাগড়াছড়ি আসন থেকে বিনা ভোটে নির্বাচিত ও সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী এবং পরিষদের অপর ১৪ সদস্য পালিয়ে গেছেন।
খাগড়াছড়িতে অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বিদ্যালয়ে না গিয়ে ঠিকাদারীসহ বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত। কিন্তু প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস করেন না কেউ। তাদের মধ্যে অন্যতম মাইসছড়ি আনন্দ মোহন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সাজেদ মাহমুদ। তাকে প্রতিদিনই দেখা যায়, সড়ক ও জনপদ বিভাগ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের বারান্দায়। মাস শেষে কোন একদিন বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে এক মাসের স্বাক্ষর করে বেতন উত্তোলন করেন কথিত শিক্ষক সাজেদ মাহমুদ। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি চাকরি ছেড়ে দেবো।
একই অভিযোগ মটিরাঙ্গা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শশাংক ত্রিপুরা লিটনের বিরুদ্ধে। স্থানীয়দের অভিযোগ আওয়ামী লীগ দলীয় প্রভাব খাটিয়ে তিনি বিদ্যালয়ে যান না। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে দেখা যায় শশাংক ত্রিপুরা লিটনকে। তবে বহু চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
খাগড়াছড়ির দুর্গম এলাকার অনেক বিদ্যালয় চলে বর্গা শিক্ষক দিয়ে। তারমধ্যে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার মাকুমতৈছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভাড়াটে বা বর্গা শিক্ষক দিয়ে পাঠদান করানোর অভিযোগ ছিল বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নাছমিন আক্তারসহ অন্যান্য শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১১ সালের মাঝামাঝি এ বিদ্যালয়ে যোগদান করেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নাছমিন আক্তার। তিনি সরকারি বরাদ্দে নয়-ছয় করার পাশাপাশি নানা অজুহাতে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকেন। এজন্য খগেশ্বর ত্রিপুরা নামে স্থানীয় এক যুবককে তিন হাজার টাকা মাসিক বেতনে ভাড়াটে শিক্ষক হিসেবে রেখেছেন। বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হ্যাপি আক্তার ও প্রমোদ ত্রিপুরার পাশাপাশি বর্গা শিক্ষক খগেশ্বর ত্রিপুরা পাঠদান করাচ্ছেন। খাগড়াছড়িতে ভুয়া ও জাল সনদেও অনেকেই শিক্ষকতা করছেন। তারমধ্যে তিংকু চাকমা একজন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ওই বিদ্যালয়ে চার জন শিক্ষক কর্মরত থাকলেও অধিকাংশ সময় বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকেন। তবে প্রমোদ ত্রিপুরা ও হ্যাপী আকতার মাঝেমধ্যে বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকলেও অপর দুই শিক্ষক বিদ্যালয়ে নিয়মিত আসেননা বললেই চলে।
খাগড়াছড়ি প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. শফিকুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, খাগড়াছড়ি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা জেলা পরিষদের হাতে ন্যস্ত। নিয়োগ, বদলী ও ডেপুটেশন সব কিছুই জেলা পরিষদ নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা এখানে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারি না। বর্গা শিক্ষকদের বিদ্যালয়ে না যাওয়া, বর্গা শিক্ষক দিয়ে ক্লাস চালানো ও ঠিকাদারি ব্যবসায় জড়িত থাকার বিষয়ে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভুয়া ও জাল সনদে খাগড়াছড়িতে শিক্ষক পদে নিয়োগ পান রাঙ্গামাটি পৌর এলাকার উৎপল চাকমার ছেলে তিংকু চাকমা। এ নিয়ে বাংলাভিশন ডিজিটালে সংবাদ প্রকাশ হলে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। তদন্তে ঘটনা সত্যতা পাওয়া গেলেও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বর্তমানে ওই শিক্ষক খাগড়াছড়ি জেলার গুইমারা উপজেলার সিন্দুকছড়ি সরকারি প্রাথমিকি বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।