নিজস্ব প্রতিনিধি:
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা বলেছেন, ১৯৪৭ সালের পর বার বার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের দেশান্তরী হতে বাধ্য করা হয়েছে। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে, সিলেট অঞ্চলে, উত্তরবঙ্গে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে অগণিত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জনগণ দেশান্তরিত হয়েছেন।
সোমবার (৬ আগস্ট) ঢাকার সুন্দরবন হোটেলে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ২০১৮ উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
লিখিত বক্তব্যে আরও বলেন, ১৯৬০ সালে কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে প্রায় লক্ষাধিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী উচ্ছেদের শিকার হন এবং তাদের মধ্যে ৬০ হাজারের অধিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মানুষ ভারত ও মায়ানমারে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। এখনও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অঞ্চলের মানুষ নীরবে দেশত্যাগ করছেন।
ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং-এর সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য জান্নাত-ই-ফেরদৌস, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ফোরামের সহ-সাধারণ সম্পাদক ডা. গজেন্দ্রনাথ মাহাতো এবং বাংলাদেশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নারী নেটওয়ার্ক এর সদস্য সচিব চঞ্চনা চাকমা।
সন্তু লারমা আরও বলেন, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে পাঁচ লক্ষাধিক সেটেলার বাঙ্গালীকে অবৈধভাবে পূনর্বাসন দিয়ে সেখানকার জুম্ম ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করার চক্রান্ত অব্যাহত রয়েছে। দেশান্তর ছাড়াও গারো, সাঁওতালসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা ব্যাপকহারে শহরমুখী হয়েছেন। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের এই স্থানান্তরের ক্ষেত্রে পুশ ফ্যাক্টর ও পুল ফ্যাক্টর উভয়েই কাজ করেছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অঞ্চলসমূহ ক্রমান্বয়ে নিরাপত্তাহীনতাসহ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটে জর্জরিত হচ্ছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অঞ্চলগুলোতে কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষা, উন্নত বাসস্থানসহ নানা চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। তিনি ‘মাইগ্রেশন’কে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জীবনে অভিশপ্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
এবার জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত ২০১৮ সালের আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ”Indigenous Peoples’ Migration and Movement”। এই মূলসুরের সাথে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করেছে, “আদিবাসী জাতিসমূহের দেশান্তর: প্রতিরোধের সংগ্রাম”।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি ৮ দফা দাবি উত্থাপন করে বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছেন। দাবিগুলো হলো:
১. ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জাতিসমূহের সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের উপর সকল প্রকার নিপীড়ন ও নির্যাতন বন্ধ করার লক্ষ্যে একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অধিকার সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা।
২. মানবাধিকার লংঘন বন্ধ করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জোরপূর্বক দেশান্তরকরণ প্রক্রিয়া বন্ধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৩. ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং জাতীয় বাজেটে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখা।
৪. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অবিলম্বে যথাযথ বাস্তবায়ন করা এবং এ লক্ষ্যে সময়সূচি-ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা বা রোডম্যাপ ঘোষণা করা। ভূমি কমিশন আইন অবিলম্বে কার্যকর করা।
৫. জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২০০৭ সালে গৃহীত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র অনুসমর্থন ও বাস্তবায়ন করা। আইএলও কনভেনশন ১০৭ বাস্তবায়ন ও ১৬৯ নং কনভেনশন অনুস্বাক্ষর করা।
৬. সমতল অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ভূমি সমস্যা সমাধানের জন্য ভূমি কমিশন গঠন করা। মধুপুর গড়ে গারো ও কোচদের ভূমিতে ঘোষিত রিজার্ভ ফরেস্ট বাতিল করা।
৭. মৌলভীবাজার জেলার ঝিমাই ও নাহার খাসিয়া পুঞ্জির খাসিয়াদের ভূমি অধিকার নিশ্চিত করা এবং চা বাগানের লীজ বাতিল করা।
৮. ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নারীদের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং তাদের ওপর এ পর্যন্ত যে সমস্ত মানবাধিকার লঙ্ঘণের ঘটনা (ধর্ষণ, গণধর্ষণ, হত্যা, অপহরণ, বৈষম্য-নির্যাতন ইত্যাদি) ঘটেছে সেসব ঘটনার পূর্ণ তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা।
সংবাদ সম্মেলনে ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, ‘দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা রাষ্ট্রীয়ভাবে উপেক্ষিত এবং এক অভিশপ্ত জীবনযাপন করছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের দেশান্তরীকরণ আমরা হারে হারে টের পাচ্ছি।
ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, দেশেতো কতরকমের আন্তর্জাতিক দিবস পালিত হয়! জাতিসংঘ যেহেতু ২০০৭ সালে আদিবাসী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র পাশ করেছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘের একটি সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবেই এই আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালন করা উচিত।