১০ কোটি টাকা বিক্রির আশাবাদ

২০০ বছরের পুরোনো লিচু গ্রাম কিশোরগঞ্জের ‘মঙ্গলবাড়িয়া’

fec-image

দেখতে লাল টুকটুকে, রসে টুইটম্বুর, খেতে সুস্বাদু ও অতুলনীয় ঘ্রাণের কারণে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার মঙ্গলবাড়িয়ার লিচুর খ্যাতি রয়েছে দেশ-বিদেশে। ঠিক কত বছর আগে এবং কীভাবে এখানে লিচু চাষের প্রচলন শুরু হয়েছে, তা জানা না গেলেও প্রবীণদের ধারণা, অন্তত ২০০ বছর আগে এখানে লিচু চাষ শুরু হয়।

প্রথমে শৌখিনতার পর্যায়ে থাকলেও গত কয়েক দশক ধরে এ গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয় লিচু চাষ। মাঙ্গলবাড়িয়ার সাফল্য দেখে পাশের নারান্দি, কুমারপুর, হোসেন্দি ও শ্রীরামদি গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে লিচুর চাষাবাদ।

স্থানীয়রা জানান, প্রায় দুই’শ বছর আগে মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামের জনৈক হাশিম মুন্সি চীন থেকে একটি লিচুর চারা এনে তার বাড়ির আঙ্গিনায় রোপণ করেন। এ গাছ থেকেই এ উন্নত লিচুর জাত ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত গ্রামে।

লিচু চাষ করে নিজেদের আর্থিক স্বচ্ছলতা এনেছে গ্রামবাসী। এবার লিচুর বাম্পার ফলন হওয়ায় খুশি তারা। এখন চলছে লিচু সংগ্রহ ও বিপননের কাজ। সবমিলিয়ে এ মৌসুমে আট থেকে ১০ কোটি টাকার লিচু বিক্রি হবে বলে ধারণা করছে কৃষিবিভাগ।

মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে প্রবেশ করলেই আপনাকে স্বাগত জানাবে সারি সারি ঝুলে থাকা লাল টকটকে লিচু। এ যেন লিচুর রাজ্য। যেদিকে চোখ যায় লিচু আর লিচু। লিচুর ঘ্রাণে মাতোয়ারা চারপাশ। গোলাপরাঙা পাকা লিচুর ভারে নুয়ে পড়েছে অনেক গাছ। ইচ্ছে করলেই হাত বাড়িয়ে তুলে খাওয়া যায়।

লিচু কেনা ও বাগানে ঘুরে বেড়াতে দূর-দূরান্তের লোকজনও ছুটে আসছে মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে। কেউ ছবি তুলছেন, কেউ গাছ থেকে কিনে নিচ্ছেন পছন্দের লিচু। সব মিলিয়ে এই গ্রামে এখন যেন এক মনোরম ও উৎসবমুখর পরিবেশ।

পাশ্ববর্তী উপজেলা কটিয়াদিতে বসবাস করলেও মিম আক্তার এবারেই প্রথম এসেছেন মঙ্গলবাড়িয়ার লিচু বাগানে। জেনেছেন ফেইসবুকের কল্যাণে। তাইতো প্রথমবার হাতের নাগালে এত লিচু পেয়ে উচ্ছ্বসিত তিনি। খাওয়ার পাশাপাশি নিয়েছেন পরিবারের জন্যও।

রাজধানীর বারিধারা ডিওএইচএসের একটি করপোরেট অফিস থেকে সব সহকর্মীরা মিলে এসেছেন মঙ্গলবাড়িয়ায়। তারা জানান, এই লিচুর নামডাক এখন দেশজুড়ে, সে জন্য তারা এসেছেন অফিসের সবার জন্য লিচু নিতে। এসে তারা আশাহত হননি। লিচুর স্বাদ ও ঘ্রাণ তাদের মুগ্ধ করেছে।

দম ফেলারও সময় নেই লিচু চাষি ও পাইকারদের। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত লিচু সংগ্রহ ও বিক্রির কাজে ব্যস্ত সবাই। স্থানীয়রা বলছে, লিচুর হাত ধরেই তাদের জীবনে এসেছে সচ্ছলতা। লিচু বাগানে কাজ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন অনেকে। বর্তমানে মঙ্গলবাড়িয়া ও আশপাশের এলাকায় আট থেকে দশ হাজার ফলবতী লিচুগাছ রয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা। এ খাত থেকে লাভবান হচ্ছে পাইকাররাও। তারা মৌসুমের শুরুতে এক বছরের জন্য কিনে নেয় কৃষকের অনেক গাছ। পরে বেশি দামে বিক্রি করে গাছের উৎপাদিত ফল।

দীর্ঘদিন ধরে লিচু চাষ করছেন এলাকার তৌহিদ মিয়া, তিনি বলেন, এক কানি ক্ষেতে আমারা ৪০ মন ধান পাইতাম, কিন্তু লিচু চাষে খরচ বাদেই ৮০ হাজার টাকা লাভ পাচ্ছি। তাই এখন গ্রামের সবাই লিচু চাষে আগ্রহী হচ্ছে।

একই গ্রামের বাসিন্দা হৃদয় মিয়া পড়াশোনার পাশাপাশি পরিবারের সঙ্গে সময় দিচ্ছেন লিচু চাষে। তিনি বলেন, আমাদের গ্রামের অর্থনীতির চিত্র পাল্টে দিয়েছে এই লিচু। আমাদের এসব লিচু বিক্রি নিয়েও চিন্তা করতে হয় না। ক্রেতা ও পাইকাররা ভালো দাম দিয়ে বাগান থেকেই কিনে নিয়ে যায়।

শতবছর বয়সী মিরাজ আলী বলেন, আমাদের বাপ-দাদাদের দেখছিলাম ছোটবেলায়। নিজেরা খাওনের লাগি লাগাইছিন। এহন দেখতে দেখতে চোক্কের সামনে এই গেরামের ব্যাবসায় পরিণত হইছে।

মঙ্গলবাড়িয়ার লিচু আকারে যেমন বড়, তেমনি রঙ, স্বাদ ও গন্ধেও ব্যতিক্রমি গুণের অধিকারী। যে কারণে সারাদেশে মঙ্গলবাড়িয়ার লিচুর রয়েছে বাড়তি কদর ও চাহিদা। তাই মৌসুমে স্থানীয় বাজারে এগুলো খুব একটা দেখা যায় না। লোকজন গ্রামে গিয়ে সরাসরি কিনে নিয়ে যায় তাদের পছন্দের লিচু। এবার লিচুর ফলন হয়েছে ভালো, তবে দামও বেশি। একশ লিচু বিক্রি হচ্ছে সাত থেকে আটশ টাকায়।

লিচু সংগ্রহ করতে আসা আরেক পাইকার কাজল বলেন, সে এখানে ১৭ থেকে ১৮ বছর ধরে লিচু বাগান ক্রয় করে আসছে। কিছু লিচু স্থানীয় বাজারে নিয়ে বিক্রি করলেও বেশিরভাগ লিচু বাগান থেকেই বিক্রি হয়ে যায়। যার মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলসহ রয়েছে বিদেশি ক্রেতাও।

স্থানীয় আরেক পাইকার তওহিদ বলেন, এবার তিন লাখ টাকার লিচু কিনেছি যা ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা লাভের মুখ দেখাবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মো. সাইফুল হাসান আলামিন জানান, আগাম জাতের লাভজনক এ ‘মঙ্গলবাড়িয়া’ লিচুর আবাদ সমস্ত জেলায় ছড়িয়ে দেয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছে কৃষি বিভাগ।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নূর ই আলম মঙ্গলবাড়িয়ার লিচু নিয়ে বলেন, এ বছর লিচু বিক্রি করে কৃষকরা আট থেকে ১০ কোটি টাকা আয় করবে। স্বল্প খরচে অধিক মুনাফা পাওয়ায় অন্যান্য ফসলের ক্ষেতও এখন কৃষকরা রূপান্তরিত করছেন লিচু বাগানে।

লিচু চাষিরা বলছেন, সম্ভাবনাময় এ খাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও কৃষি বিভাগের আন্তরিক সহযোগিতা থাকলে মঙ্গলবাড়িয়ায় লিচুর আবাদ আরও বাড়ানো সম্ভব। লিচুর পরিকল্পিত চাষাবাদ পাল্টে দিতে পারে স্থানীয় অর্থনীতির চিত্র।

 

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: ‘মঙ্গলবাড়িয়া’, কিশোরগঞ্জ, লিচু গ্রাম
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন