parbattanews

নাইক্ষ্যংছড়ির সংগ্রামী পিতার অভাবী ছেলেটি ৩৮তম বিসিএস ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন

৮ ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। আর্থিক অস্বচ্ছলতা, লজিং থেকে টিউশনি করা অভাবী সেই ছেলেটিই শতপ্রতিকূলতা পেরিয়ে এখন বিসিএস ক্যাডার। এর আগে ৩৬তম বিসিএস নন-ক্যাডার থেকে নিয়োগ পেয়েছিলেন শিক্ষক হিসেবে। মোহাম্মদ সোলাইমান সিকদার বর্তমানে কর্মরত আছেন আদর্শগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে। সদ্য প্রকাশিত ৩৮তম বিসিএস (শিক্ষা) ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি।

এর আগে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুমের তুমব্রু গ্রামের অধিকতর সংগ্রামী এক কামার-পিতা’র অভাবী ও মেধাবী সন্তান জয়দেব কর্মকার ৩৬তম বিসিএস (শিক্ষা)-এ উত্তীর্ণ হয়ে বর্তমানে বান্দরবান সরকারি কলেজে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন। জয়দেব কর্মকার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার অধিবাসীদের মধ্যে প্রথম বিসিএস ক্যাডার, এবার এ উপজেলার দ্বিতীয় বিসিএস ক্যাডার হওয়ার গৌরব অর্জন করলেন মোহাম্মদ সোলাইমান সিকদার।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের দুর্গম আলীক্ষ্যং গ্রামের এক নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান সোলাইমান। তার পিতার নাম আলতাফ হোসেন। বর্তমানে নাইক্ষ্যংছড়ি থানায় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী (পরিচ্ছন্ন কর্মী) হিসেবে কর্মরত।

সোলাইমান এর সংগ্রামী জীবনের গল্প এখন নাইক্ষ্যংছড়ি তথা বাইশারী ইউনিয়নের মানুষের মুখে মুখে। পার্বত্যনিউজের সাথে কথা বলতে গিয়ে অকপটেই সোলাইমান জানিয়েছেন, তার জীবনে নানা চড়াই উৎরাইয়ের কথা। পিতা ছিলেন বাংলাদেশ পুলিশের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী এবং মা গৃহিণী। প্রত্যন্ত গ্রামে বিদ্যুতের আলো না থাকায় হারিকেনের আলোয় ভাঙ্গা ঘরে করেছেন পড়াশোনা। নিজ গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর পার্শ্ববর্তী রামু উপজেলার ঈদগড় এএমবি উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন।

বাইশারীর আলীক্ষ্যং থেকে ঈদগড় এএমবি উচ্চ বিদ্যালয়ের দূরত্ব ৬ কি.মি। যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত অনুন্নত থাকায় রোদ-বৃষ্টি-ঝড় মাথায় করে প্রতিদিন ১২ কি.মি কাঁদামাটির দুর্গম পথ ভেঙ্গে যেতে হতো হাই স্কুলে। শৈশব কিশোর এভাবে কাটিয়ে সবকিছুকে জয় এবং জীবনের সকল বাধা অতিক্রম করে তিনি এখন সফল মানুষ। ছোট বেলা থেকে নরম, ভদ্র আর শান্ত স্বভাবের ছিলেন সোলাইমান। তার ভদ্রতার জন্য এলাকা ও শিক্ষক মহলের পাশাপাশি বর্তমান কর্মস্থলেও বেশ প্রশংসিত।

জীবনের দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে বর্তমান অবস্থানে পৌঁছানোর বিষয়ে তিনি বলেন- আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে ৮ম শ্রেণি থেকেই এইচএসসি পাস পর্যন্ত ঈদগাহ, কক্সবাজারে লজিং থেকে লেখাপড়া করেছেন। বাবার ছোট চাকরির সামান্য বেতনেই তার পরিবার চলতো। এই আর্থিক অসচ্ছলতার মাঝেও বাবা সাধ্যমতো সহযোগিতা করেছেন।

৩৮তম বিসিএস-এর মাধ্যমে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়া সোলাইমান ২০০৫ সালে ঈদগাহ আদর্শ শিক্ষা নিকেতন থেকে এসএসসি এবং ২০০৭ সালে ঈদগাহ ফরিদ আহমেদ কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে যথাক্রমে ২০১৩ ও ২০১৪ সালে অনার্স ও মাস্টার্স পাশ করেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর নিজেকে মেলে ধরেছেন।

স্বপ্নজয় বিষয়ে তিনি বলেন, আসলে ছোট বেলা থেকে এপর্যন্ত আসতে নানা দুর্গম পথ অতিক্রম করে এসেছি। অসচ্ছল পরিবারের ছেলে হয়েও কখনো ভেঙে পরিনি। জীবনের স্বপ্ন থাকলেও। ক্লাসের পাঠ্যবইয়ের প্রতি অমনোযোগী ছিলেন তিনি।

বর্তমানের স্বপ্ন পূরণের সাফল্যের পেছনে পরিবার থেকেই অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। তার প্রেরণার সবচেয়ে বড় উৎস বাবা-মা এবং ‘বাবার সংগ্রামী জীবন’।

ছাত্র অবস্থায় লেখালেখি শুরু করেছিলেন সোলাইমান। বিসিএস পরীক্ষার্থীদের বহুল পঠিত শাহ মো. আবদুল হাই এর ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সংগঠন ও পররাষ্ট্রনীতি’ গ্রন্থের সহলেখক হিসেবে রোহিঙ্গা সংকট ও ভূ-রাজনীতি, ফিলিস্তিন সংকট, কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা, ইরাক ও কুর্দিস্তান সংকট ও কোরিয়া উপদ্বীপ সংকটঃ দুই কোরিয়া পুনঃএকত্রীকরণের ভবিষ্যৎ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনীতি, বৈশ্বিক পরিবেশ ও বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে কাজ করার সুযোগ হয়েছে তার। এই জন্য ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে গবেষণা এবং শিক্ষকতার মহান ব্রত নিয়ে দেশমাতৃকার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করতে চান তিনি।

একজন গ্রামের ছাত্রের সফলতার বিষয়ে জানতে চাইলে নাইক্ষ্যংছড়ি হাজী এমএ কালাম ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মো. শাহ আলম বলেন- নাগরিক সুবিধা বিহীন প্রত্যন্ত এলাকা থেকে একজন ছাত্র উঠে আসা নিসন্দেহে ধন্যবাদ পাওয়ার দাবি রাখে সোলাইমান।

তিনি জানান, সফলতার জন্য প্রতিভার পাশাপাশি প্রয়োজন ধৈর্য, ইচ্ছাশক্তি আর পরিশ্রম। একজন ছাত্র প্রতিযোগিতামূলক শহরে না থেকেও গ্রামের ন্যাচারাল মেধা নিয়ে সফলতা বয়ে আনতে পারে তার বাস্তব উদাহরণ এটি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপির উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি আরও বলেন- মন্ত্রী যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই বক্তব্য রাখেন সেখানেই বান্দরবানের ছেলে-মেয়েদের সচিবালয়ে চাকরি করার স্বপ্নের কথা বলেন। সোলাইমান নিজেকে মন্ত্রীর এই অনুভূতির একজন অংশিদার বলে মনে করেন।

এদিকে মোহাম্মদ সোলাইমান সিকদারের বেড়ে ওঠা এলাকা বাইশারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম ও আলীক্ষ্যং মৌজা প্রধান মংথোয়াই হ্লা মারমা বলেন, সোলাইমান তার পিতার স্বপ্ন পূরণ করেছেন। আমাদের বিশ্বাস ওর বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে গ্রামের ছেলে-মেয়েদের সহযোগিতায় অবদান রাখবেন। এই সফলতায় বাইশারী তথা পুরো নাইক্ষ্যংছড়ির মানুষের মুখ উজ্জল হয়েছে বলে জানান তারা।

Exit mobile version