parbattanews

‌বিশ্বজুড়ে ব্যয় বাড়ছে সামরিক খাতে, কমছে মানবিক সহায়তা

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বের প্রায় সব দেশের চলমান অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। জ্বালানি ও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, স্থানীয় মুদ্রার দরপতন, মার্কিন ডলারের সংকট ইত্যাদি নানা কারণে সাধারণ মানুষ ক্রমাগত ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। নিষেধাজ্ঞা ও পালটা নিষেধাজ্ঞার জটিল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বিশ্বব্যাপী মূল্যবৃদ্ধির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে এবং পণ্য, খাদ্যসামগ্রী, জ্বালানি ও সারের মূল্যস্ফীতি ঘটিয়েছে। মুদ্রা বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, জাতীয় ঋণের মাত্রা বাড়ছে এবং অনেক দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। আমদানিনির্ভর দেশগুলোকে আমদানি ব্যয় মেটাতে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হচ্ছে এবং মুদ্রার অবমূল্যায়ন হওয়ার কারণে মুদ্রাস্ফীতির চাপ বাড়ছে। বর্তমানে বিশ্বের ৮২টি দেশের সাড়ে ৩৪ কোটি মানুষ খাদ্য নিয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। দেশগুলোতে খাদ্য সহায়তার জন্য বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (ডব্লিউএফপি) কার্যক্রম চলমান রয়েছে। অনাহারের ঝুঁকিতে থাকা এসব মানুষের মধ্যে ৪৫টি দেশের ৫ কোটি মানুষ চরম পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই ধাক্কা চলমান উন্নয়নের গতিকে ধীর করে দিয়েছে। এর মধ্যে শ্রীলংকার উপর যে বিপর্যয় নেমে এসেছিল তার প্রভাব এখনো কিছুটা রয়েছে। শ্রীলংকার পর পাকিস্তান ও আর্জেন্টিনা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে ও তা কাটিয়ে উঠতে সংগ্রাম করছে।

ইতোমধ্যে অনেক বৈশ্বিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ইউক্রেন, আফগানিস্তান, ইয়েমেন, দক্ষিণ সুদান, সিরিয়া, তুরস্কে ভূমিকম্প, ইথিওপিয়া ও সর্বশেষ সুদানের গৃহযুদ্ধ বিশ্বব্যাপী মানবিক সংকটের তালিকা দীর্ঘায়িত করে চলেছে। এর ফলে মানবিক ও ত্রাণ সহায়তার গুরুত্ব ও লক্ষ্য ক্রমাগত পরিবর্তন হচ্ছে। ২০২১ সালের ২৪ অগাস্ট ইথিওপিয়ার ফেডারেল সরকার ও টিগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট-এর মধ্যে সংঘর্ষে ওই অঞ্চলে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। সুদানে গত ১৫ এপ্রিল থেকে চলা সংঘর্ষে শত শত মানুষ নিহত হয়েছে, প্রায় আট লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে পালাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এসব মানবিক বিপর্যয় ত্রাণ সহায়তা ও মানবিক কার্যক্রমের উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলছে। জাতিসংঘ পূর্ব আফ্রিকার তিন-চতুর্থাংশ শরণার্থীর খাদ্য-রেশন ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিয়েছে। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ইথিওপিয়া, কেনিয়া, দক্ষিণ সুদান এবং উগান্ডার শরণার্থীরা। পশ্চিম আফ্রিকার বুরকিনা ফাসো, ক্যামেরুন, চাদ, মালি, মৌরিতানিয়া এবং নাইজারে ডব্লিউএফপির রেশনও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। বুরকিনা ফাসোতে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা এক কোটি ৯০ লাখে পৌঁছেছে। ডব্লিউএফপি আশঙ্কা করছে, দক্ষিণ সুদানে শরণার্থীসহ দেশটির ৮৩ লাখ মানুষ তীব্র ক্ষুধার সম্মুখীন হবে। যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে ইউরোপের দেশগুলো আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। ইউরোপজুড়ে গত ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় শরণার্থী সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছে। ইউএনএইচসিআরের তথ্য মতে, ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৮০ লাখেরও বেশি শরণার্থী ইউক্রেন ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে। বিশ্বব্যাপী ৫৯.১ মিলিয়ন মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সাম্প্রতিককালে, ১ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে ২৮১ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত এবং কয়েক মিলিয়ন মানুষ রাষ্ট্রহীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে।

অন্যদিকে বিশ্বের সামরিক ব্যয় ২০২২ সালে সর্বকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড ছুঁয়ে ২ দশমিক ২৪ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে অস্ত্রের চাহিদা বাড়ছে এবং সেই সাথে বাড়ছে সামরিক ব্যয়। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) ২৪ এপ্রিল বৈশ্বিক সামরিক ব্যয় সম্পর্কিত বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ইউরোপের দেশগুলোর সামরিক খাতে ব্যয় বেড়েছে ১৩ শতাংশ, যা গত ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এই ব্যয় বৃদ্ধির সাথে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধ সম্পর্কিত হলেও ইউরোপের অন্য দেশগুলো রাশিয়ার হুমকির প্রতিক্রিয়ায় নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সামরিক ব্যয় বাড়িয়েছে। এ কারণে ফিনল্যান্ড ৩৬ শতাংশ, লিথুয়ানিয়া ২৭ শতাংশ, সুইডেন ১২ শতাংশ এবং পোল্যান্ডে ১১ শতাংশ সামরিক ব্যয় বাড়িয়েছে। ফিনল্যান্ড গত এপ্রিলে ন্যাটোর ৩১তম সদস্য হয়েছে, পাশাপাশি সুইডেনও এখন ন্যাটো জোটে যুক্ত হতে চাচ্ছে। নেদারল্যান্ডস, স্পেন, ইটালির মতো ইউরোপীয় দেশগুলোও গত দশকে সামরিক খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, বৈশ্বিক সামরিক ব্যয়ের ক্রমাগত বৃদ্ধি এটাই প্রমাণ করে যে, আমরা বর্তমানে একটি অনিরাপদ বিশ্বে বসবাস করছি।

বিশ্বে সামরিক ব্যয়ের ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ব্যয় শতকরা ০.৭ ভাগ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৮৭৭ বিলিয়ন ডলার, যা বিশ্বের মোট সামরিক ব্যয়ের শতকরা ৩৯ ভাগ। ইউক্রেনকে দেয়া অব্যাহত আর্থিক সামরিক সহায়তার কারণে এই ব্যয়ের পরিমাণ বেড়েছে। ২০২২ সালে ইউক্রেনের জন্য মার্কিন আর্থিক সামরিক সহায়তার পরিমাণ ছিল ১৯.৯ বিলিয়ন ডলার। চীন সামরিক খাতে ব্যয়ের দিক থেকে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে, ২০২২ সালে এই খাতে চীনের বরাদ্দ ছিল আনুমানিক ২৯২ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২১ সালের তুলনায় ৪.২ শতাংশ বেশি। চীনের সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে আঞ্চলিক প্রতিবেশী দেশগুলোতে। জাপান ২০২২ সালে সামরিক খাতে ৪৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৫.৯ শতাংশ বেশি। একই সাথে তাইওয়ান তাদের ব্যয় বাড়িয়েছে ১৩.৯ শতাংশ এবং সাউথ কোরিয়া বাড়িয়েছে ৪.৬ শতাংশ। অস্ট্রেলিয়ার সামরিক ব্যয় ৪ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ১৮০ কোটি ডলার। অস্ট্রেলিয়া সরকার দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কেনার পেছনে এক হাজার ৯০০ কোটি অস্ট্রেলীয় ডলার খরচ করার ঘোষণা দিয়েছে।

রাশিয়ার সামরিক ব্যয় ২০২২ সালে আনুমানিক ৯ দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে প্রায় ৮৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার, যা বৈশ্বিক মোট সামরিক ব্যয়ের ৩.৯ শতাংশ। সামরিক ব্যয়ে বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে আছে ভারত। ২০২২ সালে ভারত সামরিক খাতে ৭ হাজার ৬৬০ কোটি ডলার ব্যয় করেছে, যা সামরিক খাতে বিশ্বের মোট খরচের ৩.৬ শতাংশ। সৌদি আরব পঞ্চম বৃহত্তম সামরিক ব্যয়কারী দেশ, ২০২২ সালে তাদের ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়ে আনুমানিক ৭৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।

২০২২ সালে ন্যাটো সদস্য দেশগুলোর সামরিক ব্যয় ছিল মোট ১২৩২ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২১ সালের তুলনায় ০.৯ শতাংশ বেশি। বিশ্বে সামরিক খাতে ব্যয়ের তালিকায় ৩.১ শতাংশ নিয়ে যুক্তরাজ্যের অবস্থান ষষ্ঠ, যার পরিমাণ ৬৮.৫ বিলিয়ন ডলার। এর পরেই মোট ব্যয়ের আড়াই শতাংশ জার্মানির আর ২.৪ শতাংশ ফ্রান্সের। ইউক্রেনে সামরিক ব্যয় ২০২২ সালে ছয় গুণের বেশি বেড়ে ৪৪ বিলিয়ন ডলার হয়েছে, জাতীয় প্রবৃদ্ধির শতকরা হিসাবে সামরিক খাতে খরচ ২০২২ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৩৪ ভাগ। এটা একটা দেশের সামরিক ব্যয়ের সর্বোচ্চ এক বছরের বৃদ্ধির রেকর্ড। ২০২২ সালে এশিয়া ও ওশেনিয়ার দেশগুলোর সম্মিলিত সামরিক ব্যয় ছিল ৫৭৫ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ২.৭ শতাংশ বেশি এবং এই ব্যয় ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা অব্যাহত রেখেছে।

২০২১ সালের সেনা অভ্যুত্থানের পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো মিয়ানমারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এরপরও দেশটির সামরিক সামর্থ্য কমেনি বা তাদের সমরাস্ত্র কেনা থেমে নেই। প্রতি বছর দেশটি তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট ও সামরিক সামর্থ্য বাড়িয়ে যাচ্ছে। ২০২২ সালে মিয়ানমারের প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল সাড়ে ২২৮ কোটি মার্কিন ডলার। প্রতিবেশী দুই দেশ চীন এবং ভারতের সাথে সুসম্পর্ক থাকায় মিয়ানমার এই দুইটি দেশ থেকে বেশিরভাগ অস্ত্র ক্রয় করে থাকে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক জান্তার ক্ষমতা দখলের পর চীন, রাশিয়া এবং সার্বিয়া দেশটিকে যুদ্ধ বিমান, সাঁজোয়া যান, রকেট এবং কামান সরবারহ করেছে।

বিশ্বব্যাপী মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সশস্ত্র সংঘাত এবং ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে। এর ফলে খাদ্যাভাব দেখা দিচ্ছে, দারিদ্র্য বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে উদ্বাস্তু ও বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা ও সংকটের কারণে দাতারা অনুদান কমিয়ে দেওয়ায় ডব্লিউএফপি রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্যসহায়তা প্রায় ১৭ শতাংশ কমিয়েছে। রোহিঙ্গাদের খাবারের জন্য মাথাপিছু মাসিক বরাদ্দ ছিল ১২ ডলার, গত ১ মার্চ থেকে তা কমিয়ে ১০ ডলার করা হয়েছে। নতুন তহবিল জোগাড় না হলে আগামী দিনগুলোতে এই সাহায্যের পরিমাণ আরও কমতে পারে। তহবিল সংকটের কারণে সুযোগ-সুবিধা আরও কমে যেতে পারে এই আশঙ্কায় রোহিঙ্গাদের দুশ্চিন্তা বাড়ছে।

বাংলাদেশ গত প্রায় ছয় বছর ধরে ১.২ মিলিয়ন রোহিঙ্গার ভার বহন করে চলছে। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে প্রতিবছর ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ভবিষ্যতে এই ব্যয় আরও বাড়তে পারে। বাংলাদেশের একার পক্ষে অনির্দিষ্টকালের জন্য এই ব্যয় বহন করা সম্ভব নয়। নিরাপত্তা নিশ্চিতে ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের ব্যয় বহনের জন্য বন্ধুরাষ্ট্র ও দাতাগোষ্ঠির কাছে সহায়তা চাওয়া হয়েছে, যা প্রাপ্তি এখনও অনিশ্চিত।

সারা বিশ্বে সামরিক ব্যয় বেড়েই চলছে, সেই সাথে বাড়ছে মানুষের দুর্দশা ও নিপীড়িত বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা। বিশ্বব্যাপী এই সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি মানবিক সহায়তাও বাড়ানোর উদ্যোগ চলমান রাখতে হবে। একটা শান্তিময় বিশ্বের প্রত্যাশায় সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি যেন চলমান মানবিক সহায়তা ও ত্রাণ কার্যক্রমের উপর প্রভাব না ফেলে তা নিশ্চিত করতে বিশ্ব মানবতাবোধকে জাগ্রত রাখতে হবে।

লেখক: ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন, এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, এমফিল, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক

Exit mobile version