অনুসন্ধানী প্রতিবেদন: ভূষণছড়া গণহত্যা

fec-image

রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক বৈরীতার কারণে পৃথিবীতে অনেক নৃশংস ঘটনা ঘটেছে এবং ইতিহাসে তার স্থানও হয়েছে। অসভ্য বর্বর যুগের মতো ঘটনাগুলো আধুনিককালেও বিচার্য হচ্ছে না। প্রাচীন ভারতীয় সম্রাট অশোক, যুদ্ধের নৃশংসতায় গভীর মর্মাহত হয়ে, অহিংস বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে আজীবন যুদ্ধ পরিহারসহ রাজ্য শাসন করেছিলেন। এটা একটা অনন্য মানবতাবাদী নজির। মধ্যযুগে ইসলামী সভ্যতার শুরুতে যুদ্ধাভিযানকালে খলিফার পক্ষ থেকে সেনাপতিদের উপদেশ দেয়া হতো: নিরস্ত্র সাধারণ লোককে যেন হত্যা করা না হয়। শিশু, বৃদ্ধ, রোগী ও স্ত্রীলোকেরা যেন আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়। ফল-ফসল ও ধর্মস্থান যেন ধ্বংস না হয়। অযথা গণহত্যা করা যাবে না।

বৌদ্ধ ধর্মের পঞ্চ মূলনীতির প্রথমটি হলো: প্রাণী হত্যা থেকে বিরতি গ্রহণ করা। ইসলাম ধর্মেরও মূলনীতি হলো: অযথা প্রাণী হত্যা হারাম বা নিষিদ্ধ। বিকশিত সভ্যযুগের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে, জেনেভা কনভেনশনের মাধ্যমে, নিরপরাধ নিরস্ত্র লোকজনকে নির্বিচারে ও দলবদ্ধভাবে হত্যা করাকে দণ্ডনীয় যুদ্ধাপরাধ রূপে ঘোষণা করা হয়েছে। সে থেকে জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে, যুদ্ধাপরাধের বিচার হচ্ছে। অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী রাষ্ট্রপ্রধান, সেনাপ্রধান ও সরকার প্রধানদেরও রেহাই দেয়া হচ্ছে না। বসনিয়ায় অনুষ্ঠিত গণহত্যার জন্য সাবেক যুগস্লাভ রাষ্ট্রপ্রধান মি. স্লাভদান মিলোসেভিচ বর্তমানে বন্দি ও বিচারাধীন আছেন। কম্বডিয়ার সাবেক সরকার প্রধান পলপটের গণহত্যার বিচারটিও প্রক্রিয়াধীন আছে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন অনুষ্ঠিত গণহত্যার বিচার হোক, এটা একটি চলমান দাবি এবং সাথে সাথে এ দাবিটিও উত্থিত হচ্ছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে দু’ দশকের অধিক কাল ধরে, বিদ্রোহী পার্বত্য জনসংহতি সমিতি ও তার সশস্ত্র সংগঠন শান্তিবাহিনী, যেসব নৃশংস গণহত্যা চালিয়েছে, তারও বিচার অনুষ্ঠিত হোক। এসব গণহত্যার জ্বলন্ত প্রমাণ হলো ১৯৮৪ সালের ৩১ মে অনুষ্ঠিত ভূষণছড়া গণহত্যা ও ১৯৯৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর সংঘটিত পাকুয়াখালি গণহত্যা। ভূষণছড়ায় একই অর্ধ রাত্রি সময়কালে হত্যা করা হয়েছে তিন শতাধিক নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, যুবা ও শিশুকে। তাদের গণ কবরগুলো এখনো প্রমাণ বহন করছে! ঘটনাটি অবশ্যই মর্মান্তিক ও বিচার্য যুদ্ধাপরাধ।

পাকুয়াখালিতে আলোচনা বৈঠকের জন্য আহুত ৩৬ জন যুবকের উপর অতর্কিতে শান্তিবাহিনী সদস্যরা আক্রমণ করে। তার মধ্যে একজন মাত্র পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হয়।তারই খবর ও পথ প্রদর্শনে পরের দিন ২৮টি লাশ উদ্ধার করে আনা হয়। অবশিষ্ট ৭ জন অদ্যাবধি নিখোঁজ আছে। লংগদু সদরে ঐ লাশগুলো সারি বেঁধে একই গণকবরে শায়িত। পানছড়ির ৯ জন শহীদের লাশ রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত সফর করেছে। বাকি প্রায় ত্রিশ হাজার নিহতের লাশ, বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে, পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অধিকাংশের দাফন কাফন পর্যন্ত কপালে জুটেনি। বেওয়ারিশ ও নিখোঁজ লাশ হিসেবে শিয়াল কুকুরের খোরাক হয়ে, কেবল কংকাল রূপে পাহাড় ও বনে পড়ে আছে। এই নৃশংসতা বিনা বিচারে পার পেয়ে গেলে, এটি অপরাধ ও দণ্ডনীয় কুকর্ম বলে নজির স্থাপিত হবে না। এটা হবে আরেক নিন্দনীয় ইতিহাস। দেশে সেসময় সামরিক শাসন ও সংবাদ প্রচারের উপর সেন্সর ব্যবস্থা আরোপিত থাকায় এবং পাহাড় অভ্যন্তরে যাতায়াত ও অবস্থান সহজ আর নিরাপদ না হওয়ায়, অধিকাংশ গণহত্যা ও নিপীড়ন খবর হয়ে পত্র পত্রিকায় স্থান পায়নি। তবু অসমর্থিত ছিটেফোঁটা তথ্যের ভিত্তিতে মানবাধিকার সংগঠনগুলো, যে হিসাব প্রকাশ করেছে, তাতে জানা যায়, উপজাতীয় বিদ্রোহীদের হাতে নিহতের সংখ্যা প্রায় ৩০,০০০। এটা আঁতকে উঠার মতো বড় ঘটনা। দুঃখজনক ব্যাপার হলো: এতদাঞ্চলে কর্মরত আর্মি, বিডিআর, পুলিশ ও সিভিল প্রশাসন, প্রতিটি নৃশংস ঘটনাকে তদন্ত ও তদারক করেছেন। তবে তথ্য প্রচার ও সংরক্ষণের ব্যাপারে তাদের মুখে কুলুপ আঁটা। প্রতিপক্ষ উপজাতীয়রা তিলকে তাল করে নিজেদের পক্ষে প্রচার চালিয়েছে। তাদের বিপক্ষে নৃশংসতার প্রচার হয়নি। এতে দুনিয়াব্যাপী একতরফা ধারণা জন্মেছে যে, পার্বত্য উপজাতিরা সত্যই নির্যাতনের শিকার।

আরও পড়ুন


রাজনগর গণহত্যা দিবসের আহ্বান

পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃহত্তম গণহত্যা ভূষণছড়া গণহত্যাকাণ্ড

পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃসংশ গণহত্যা পাকুয়াখালী ট্রাজেডি

মাটিরাঙ্গা গণহত্যার কথা

রামগড়ে বাঙালিদের গণকবর


কর্তৃপক্ষীয় ধামাচাপা ও দমনকে অবজ্ঞা করে, নির্যাতিত বাঙালিরা, কিছু কিছু ক্ষেত্রে, ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এবং পাল্টা কিছু ঘটায়। অনুরূপ ঘটনাবলী থেকে তাদেরকে বিরত রাখার পক্ষে দমন পীড়ন যথেষ্ট বিবেচিত না হওয়ায়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের প্রতি খয়রাতি অনুগ্রহ বিতরণও করা হয়েছে। পাকুয়াখালির নিহতদের উদ্ধারকৃত ২৮টি লাশ এক শোকাবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে এবং সাম্প্রদায়িক প্রতিশোধপরায়ণতার উদ্ভব ঘটায়। কঠোরতার মাধ্যমে তা দমনের ব্যবস্থা গৃহীত হলে, বাঙালিরা আরো ক্ষেপে যাবে, এই বিবেচনায়, উপস্থিত কয়েকজন মন্ত্রী ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাঙালিদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন ও নিহতদের পরিবার প্রতি পঞ্চাশ হাজার করে টাকার ক্ষতিপুরণ দান ঘোষণা করেন এবং উপস্থিত নিহতদের দাফন কাফনের ব্যবস্থা করা হয়। পরে বিএনপি দলের পক্ষ থেকেও পাঁচ হাজার টাকা করে অনুদানের ঘোষণা আসে। আওয়ামী সরকার ও বিএনপি দলের মঞ্জুরকৃত এই সান্ত্বনামূলক ব্যবস্থা,তাৎক্ষণিকভাবে বাঙালিদের ধৈর্য ধারণে উদ্বুদ্ধ করে। তবে অনুরূপ কোনো সান্ত্বনামূলক ব্যবস্থা অন্যান্য নিহতদের বেলায় গৃহীত হয়নি। অথচ, ভূষণছড়া গণহত্যা পরিদর্শনে প্রেসিডেন্ট এরশাদ স্বয়ং সরেজমিনে উপস্থিত হয়েছিলেন। ওসি, ডিসি, এসপি, বিগ্রেডিয়ার, কমিশনার, ডিআইজি, জিওসি ইত্যাদি কর্মকর্তারাও হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। কিন্তু সবাই তৎপর ছিলেন ঘটনাটি চাপা দিতে ও লাশ লুকাতে। কয়েকদিন যাবৎ একটানা গণকবর খননের প্রক্রিয়া চলেছে। তজ্জন্য জীবিত ‘সেটেলারদের’ আহার নিদ্রা ও বিশ্রামের ফুরসত ছিলো না। গর্তে গর্তে গণকবর রচনা করে, একেক সাথে ৩০/৪০টি লাশকে চাপা দেয়া হয়েছে। এভাবে লোকালয়গুলো পঁচা লাশ ও দুর্গন্ধ থেকে মুক্ত হলেও পাহাড় ও বনে অবস্থিত বিক্ষিপ্ত লাশগুলো দাফন-কাফনহীন অবস্থায় পঁচতে থাকে ও শিয়াল কুকুরের খাদ্য হয়। দুর্গত পরিবারগুলো পোড়া ভিটায় খাদ্য ও আচ্ছাদনহীন হয়ে দিনযাপনে বাধ্য হয়। তাদের সবাইকে পরিবার প্রতি বরাদ্দকৃত তিন একর পাহাড়ি জমি থেকে নিরাপত্তার অজুহাতে তুলে এনে, নদী তীরবর্তী নিরাপত্তা ক্যাম্প এলাকায় বিশ শতক পরিমাণ আবাসিক ভিটাতে জড়ো করা হয়। এদের অনুদান ও ক্ষতিপূরণসহ পুনর্বাসন প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু অদ্যাবধি এরা অবহেলিত। এই হত্যা ও অবহেলা অমানবিক আচরণ। আজ দীর্ঘ দিনের মাথায়ও দেখা যায়, তাদের অধিকাংশ নিত্য আনে নিত্য খায়, বলতে গেলে কায়িক মজুর। ঘরের আশেপাশে ফল ফসল ও তরিতরকারী উৎপাদন, বাঁশ, গাছ কাটা, মাছ ধরা, মজুর খাটা ও ছোট খাটো বেপারই তাদের জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন। অথচ দেশ ও জাতির জন্য এদের ত্যাগ বিরাট। এই নেংটি বলীরা আছে বলেই এই পর্বত্যাঞ্চল বাংলাদেশ হয়ে আছে। কেবল সৈন্য বলে এতদাঞ্চলের বাংলাদেশ হয়ে থাকা অসম্ভব। এতদাঞ্চলের প্রতিরক্ষার অংশ বাঙালি বসতি স্থাপন। তাদের দাবি: সকল ক্ষেত্রে সমানাধিকার ও পৃষ্ঠপোষণ।

২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রসঙ্গক্রমে ভূষণছড়া গণহত্যার বিষয়টি আলোচিত হয়। তখন কিছু ভুক্তভোগী ভোটার নিজেদের ক্ষোভ-দুঃখ নিয়ে সোচ্চার হোন। এই ক্ষোভ-দুঃখ স্থানীয়সহ জাতীয় পত্র পত্রিকা প্রকাশ করে। আলোচনার বিষয়টি ছিলো অত্যন্ত মর্মান্তিক। তাতে সাংবাদিক ও মানবতাবাদী মহলে সঙ্গতভাবেই দুঃখবোধ সমবেদনা ও প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তারা তথ্য প্রচারের অতীত অপারগতার ক্ষতি পূরণে এগিয়ে আসেন। বিষয়টি নিয়ে তথ্যানুসন্ধান পরিচালিত হয়। বেরিয়ে আসে তিন শতাধিক নিহতের নাম, ধাম, পরিচয়, ঘটনার নৃশংসতা ও বহু গণকবর। এসবই ৩১ মে ১৯৮৪ সালের এক অর্ধরাত্রের নৃশংসতার শিকার, যার হোতা হলো বিদ্রোহী সশস্ত্র সংগঠন শান্তিবাহিনী। ঘটনাস্থল বরকল থানাধীন ভূষণছড়া নামক ইউনিয়ন ও তার পার্শ্ববর্তী বাঙালিঅধ্যুষিত এলাকা। তাদের অপরাধ হলো: তারা বহিরাগত বাঙালি। সরকারি প্ররোচনায় তারা এতদাঞ্চলে এসে পার্বত্য জায়গা জমিতে ভাগ বসিয়েছে, যে জায়গা জমির অধিকাংশ খাস হলেও আগে ছিলো একচেটিয়া উপজাতীয় নিয়ন্ত্রণাধীন। এই বাঙালিদের দ্বিতীয় অপরাধ হলো তারা বাংলাদেশ আর্মির ঢাল, যারা বিদ্রোহী শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র প্রতিপক্ষ। বাঙালি হত্যা ও তাড়ানো মানে আর্মিকে দুর্বল করা এবং বেকায়দায় ফেলা। যার মানে, বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ও অখণ্ডতাকে হীনবল করে দেয়া। তখন জুম্মল্যান্ডের স্বায়ত্তশাসন, এমন কি স্বাধীনতা লাভও হবে সহজ। এই হলো উপজাতীয় নৃশংসতার মূল লক্ষ্য ও কারণ।

প্রত্যক্ষদর্শী ভুক্তভোগী, এতিম ও বিধবাদের মৌখিক বর্ণনায় পাওয়া গেলো নিহতদের এক বিরাট তালিকা। তবে আগে পরে নিহত সব শহীদদের তালিকা আরো বিরাট। তা পেতে আরো অনুসন্ধানের দরকার। এখানে শুধু ৩১ মে ১৯৮৪ তারিখের ভূষণছড়াবাসী বাঙালি শহীদদের সংখ্যা হলো তিনশতের অধিক। তালিকা প্রস্তুত করার পর যাত্রা শুরু হলো গণকবর পরিদর্শনে। পাড়া, বন, পাহাড় ও দূর দূরান্তে তা ছড়ানো ছিটানো। দুদিন পায়ে হেঁটে অত্যন্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে তার কিছু কিছু দেখা হলো। লোকালয়ে অবস্থিত প্রধান দুটি গণকবরের অবস্থান হলো ভূষণছড়া ইবতেদায়ী মাদরাসা প্রাঙ্গন ও প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গন। এখানে প্রথমটিতে এক সাথে ৩৮ জন শহীদ শায়িত আছেন এবং দ্বিতীয়টিতে আছেন ২৩ জন। বর্ণনা মতে, বনে পাহাড়ে বহু কংকাল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তা খুঁজে দেখা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য।

ভুক্তভোগীদের আহাজারিতে প্রকাশ পেলো: এ পর্যন্ত সান্ত্বনামূলক কোনো সরকারি অনুদান বা ক্ষতিপূরণ তাদের ভাগ্যে জুটেনি। অথচ, হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত উপজাতীয় জনগণ, প্রতিশোধ ও শাস্তির ভয়ে সীমান্ত পারে গিয়ে আত্মগোপন করায়, তাদের ফিরিয়ে এনে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয়ে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। বাঙালিদের ধন, মান ও প্রাণ গেলেও তাদের প্রতি সরকারসহ উপজাতি নিয়ন্ত্রিত জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ বিরূপ ও বিরাগভাজন।

কোনো বড় যুদ্ধে কয়েক ঘণ্টার ভিতর কোনো একক পরিবেশে অত্যন্ত নৃশংসভাবে এত বিপুল সংখ্যক বেসামরিক সাধারণ মানুষকে কুপিয়ে, পিটিয়ে, গুলিতে ও আগুনে পুড়িয়ে মারার খুব বেশি নজির ইতিহাসে নেই। এ কাজটি শাস্তিযোগ্য ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অপরাধ হলেও, এখানে তার কোনো তত্ত্ব-তালাশ ও বিচার অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা হচ্ছে না, এটা আশ্চর্যজনক। ঘটনাটি যারা ঘটিয়েছে তারা এবং ভুক্তভোগী মহলও চিহ্নিত। এ নিয়ে সে সময় বরকল থানায় ডায়রীও করা হয়েছে। দেশের প্রেসিডেন্টসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রায় সবাই ঘটনাগুলোর ভয়াবহতার প্রত্যক্ষদর্শী। এ ঘটনাগুলোর বিচার নিষিদ্ধ করে কোনো ইনডেমনিটি আইনও জারি করা হয়নি। তবে দীর্ঘদিন পরে সম্পাদিত পার্বত্য চুক্তির দ্বারায় সাধারণ ক্ষমা ঘোষিত হয়েছে, যা চিহ্নিত অপরাধীদের পক্ষে ছাড়পত্র বিশেষ। ভুক্তভোগী ও ফরিয়াদী নেংটি বাঙালিরা এই চুক্তি ও ক্ষমার তাৎপর্য সম্বন্ধে অজ্ঞ হলেও, গুণী ও জ্ঞানীজন বুঝেন, চুক্তি ও ক্ষমার সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার জড়িত নয়। এটা চিফ হুইপ আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ ও পার্বত্য জনসংহিতি সমিতি প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার মধ্যকার সমঝোতা।

ঘটনাটির নৃশংসতার অনুসন্ধান, তার দায় দায়িত্ব নিরূপণ, তার বিচার অনুষ্ঠানে ট্রাইবুনেল গঠন ইত্যাদি এবং দোষী বা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পাকড়াও করে ট্রাইবুনালের নিকট সোপর্দ করতে, সরকারের পক্ষে কোনো বাধা নেই। তবে এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে বিরূপ রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া স্থানীয় উপজাতি সমাজে ও আন্তর্জাতিকভাবে ঘটা সম্ভব, এটাই সরকারের বিবেচ্য। এই সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া সরকারের উপর অতিমাত্রিকভাবে ক্রিয়াশীল। অথচ, এটি আসলে আন্তর্জাতিকভাবে অনুমোদিত অপরাধ। দুনিয়াবাসী পক্ষপাতমূলকভাবে জানে, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরা নিরীহ আর নির্যাতিত। বিপরীতে তারাও যে গুরুতর অনেক নৃশংসতা ও অপরাধের হোতা, এ কথা বিচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অবগত হলে, তারা ধিক্কার জানাতো অবশ্যই। বাংলাদেশ আর বাঙালিদের অনেকে বিপক্ষদের বিরুদ্ধে অনেক বাড়াবাড়ির জন্য দায়ী। তাদের অনেকে উচ্চ পদে ক্ষমতাসীন থাকাকালে, নিজেদের কুকর্মের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ হওয়ার আশংকায়, অনুরূপ বিচার অনুষ্ঠানের বিরোধী। তারা পক্ষে বিপক্ষে বিচার অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রভাব খাটাচ্ছেন।

আমাদের অভিমত, বিচার একতরফা কাম্য নয়। দেশ ও বাঙালি পক্ষের অপরাধীদেরও রেহাই দেয়া উচিত হবে না। নির্যাতিত উপজাতিদের পক্ষেও রাষ্ট্রকে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখে, দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের জন্য সোপর্দ করা আবশ্যক। সাধারণভাবে অভিযুক্ত পক্ষ হলো: জনসংহতি সমিতি ও তার সশস্ত্র অঙ্গ সংগঠন শান্তিবাহিনী। এই সংগঠন দুটির কারা গণহত্যার মতো গুরুতর নৃশংসতার জন্য দায়ী, জীবিত ফরিয়াদীদের সাক্ষ্যে ও দলিল পত্রের মাধ্যমে তা নির্ণয় করা সম্ভব। সুশাসন, ন্যায় বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে, অপ্রিয় হলেও সরকারকে গণহত্যার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিশেষে আমাদের আবেদন, এখানকার বিপুল এতিম, বিধবা ও দুস্থদের প্রতি সরকার সদয় হোন।

ভয়াল রাতের বর্ণনা
স্থানীয় ভুক্তভোগী প্রত্যক্ষদর্শী মুরব্বীদের বর্ণনায় মর্মন্তুদ বর্ণনা পাওয়া গেলো। তারা জানালেন, ৩০ মে তারিখ দিনের বেলায় খবর রটে যায় সামনের রাত্রেই শান্তিবাহিনী জ্বালাও-পোড়াও, মারদাঙ্গা শুরু করতে যাচ্ছে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু করার কিছু ছিলো না। বাঙালিরা নিরস্ত্র। নিরাপদ আত্মগোপনের বা পালাবার জায়গাও নেই। বাড়ি ঘর ছেড়ে পাহাড়, বনে লুকাতে গেলে, সেখানেও শান্তিবাহিনী ও বিদ্বিষ্ট পাহাড়িরা ওঁৎপেতে বসা। সরকারের পক্ষে শান্তিরক্ষী হিসেবে আছে কিছু ভিডিপি সদস্য, আর্মি আর বিডিআর সৈনিক। তাও যথেষ্ট নয়। তাদের ক্যাম্প অনেক দূরে দূরে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙালি বসতিগুলো পাহারা দেয়া ও নিরাপদ রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং নিরূপায় হয়ে আল্লাহ ভরসা, যা হবার হবে। এরূপ অনিশ্চয়তা ও ভয়ের ভেতরই নিজ নিজ বাড়ি ঘরে থাকতে হলো তাদের। সবার জানা মতে, নদী তীরবর্তী বাঙালি বসতিগুলোর পিছনে সংলগ্ন পাহাড় ও বনে শান্তিবাহিনী ও তাদের দোসররা অবস্থান করতো। শালিশ বিচার ও চাঁদা দান উপলক্ষে কোনো কোনো বাঙালির সেখানে যাতায়াত ও কমান্ডার মেজর রাজেশের সাথে সাক্ষাত সম্পর্ক ছিলো। বিপদের আশঙ্কায়, স্থানীয় বাঙালিদের পক্ষে, ঐ কমান্ডারের দয়া ভিক্ষা করে দু’ একজন লোক চেষ্টাও করেন, কিন্তু তা নিষ্ফল হয়।

এই ভয়াল রাতের প্রথম শহীদ হলো শেফালী বেগম নামের ২০ বছরের এক যুবতী, সে থমথমে অবস্থা অবলোকন ও প্রাকৃতিক কাজ সারার জন্য রাত আনুমানিক আটটায় ঘরের বাহির হয়েছিলো। সে জানতো না ইতিমধ্যে শান্তিবাহিনীর যাতায়াত ও সমাবেশ হওয়া শুরু হয়ে গেছে। সামনে পড়ে যাওয়ায় শেফালীকেই গুলিতে প্রথম প্রাণ দিতে হলো। কলাবন্যা, গোরস্থান, ভূষণছড়া, হরিণা হয়ে ঠেগামুখ সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত এই বিরাট এলাকা জুড়ে সন্ধ্যা থেকে আপতিত ভয়াল নিস্তব্ধতা বিরাজমান। কুকুর শিয়ালের ও সাড়া নেই। আর্মি, বিডিআর, ভিডিপি সদস্যরাও ক্যাম্প-বন্দি। অতর্কিতে বাইরের দিক থেকে রাত আটটায় ধ্বনিত হয়ে উঠলো, শেফালী হত্যার সাথে জড়িত ঐ গুলির শব্দটি। তার পরই ঘটনার শুরু। চতুর্দিকে ঘর-বাড়িতে আগুন লেলিহান হয়ে উঠতে লাগলো। উত্থিত হতে লাগলো আহত নিহত লোকের ভয়াল চিৎকার এবং তৎসঙ্গে গুলির আওয়াজ, জ্বলন্ত গৃহের বাঁশ ফাটার শব্দ, আর আক্রমণকারীদের উল্লাস মুখর হ্রেসা ধ্বনি।

এভাবে হত্যা, অগ্নিসংযোগ আর্তচিৎকার ও উল্লাসের ভিতর এক দীর্ঘ গজবী রাতের আগমন ও যাপনের শুরু। চিৎকার, আহাজারি ও মাতমের ভিতর রাতের পর সূর্যোদয়ে জেগে উঠলো পর্যুদস্ত জনপদ। হতভাগ্য জীবিতরা আর্তনাদে ভরিয়ে তুললো গোটা পরিবেশ। অসংখ্য আহত ঘরে ও বাইরে লাশে লাশে ভরে আছে পোড়া ভিটা, পথঘাট ও পাড়া। সবাই ভীত বিহবল। এতো লাশ, এতো রক্ত আর এতো ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, এক অর্ধরাতের ভিতর এলাকাটি বিরান। অদৃষ্টপূর্ব নৃশংসতা। অভাবিত নিষ্ঠুরতা। ওয়্যারলেসের মাধ্যমে এই ধ্বংসাত্মক দুর্ঘটনার কথা স্থানীয় বিডিআর ও আর্মি কর্তৃপক্ষ ঊর্ধ্বমহলে অবহিত করেন। শুরু হয় কর্তৃপক্ষীয় দৌড়ঝাঁপ, আগমন ও পরিদর্শন। চললো লাশ কবরস্থ করার পালা ও ঘটনা লুকানোর প্রক্রিয়া। ঘটনাটি যে কত ভয়াবহ, মর্মন্তুদ আর অমানবিক এবং শান্তিবাহিনী যে কত হিংস্র, পাশবিক চরিত্র সম্পন্ন ও মানবতা বিরোধী সাম্প্রদায়িক সংগঠন, তা প্রচারের সুযোগটাও পরিহার করা হলো। খবর প্রচারের উপর জারি করা হলো নিষেধাজ্ঞা। ভাবা হলো: জাতীয়ভাবে ঘটনাটি বিক্ষোভ ও উৎপাতের সূচনা ঘটাবে দেশজুড়ে, উপজাতীয়রা হবে বিপন্ন।

ঘটনার ভয়াবহতা আর সরকারি নিষ্ক্রিয়তায় ভীত সন্ত্রস্থ অনেক বাঙালিই স্থান ত্যাগ করে পালালো। পলাতকদের ঠেকাতে পথে-ঘাটে, লঞ্চে গাড়িতে, নৌকা, সাম্পানে চললো তল্লাশী ও আটকের প্রক্রিয়া। তবু নিহত আর পলাতকরা মিলে জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই হলো এই জনপদ থেকে লাপাত্তা। শুরু হলো জীবিতদের মাধ্যমে লাশ টানা ও কবরস্থ করার তোড়জোড়। খাবার নেই, পরার কাপড় নেই, মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, চারদিকে কেবল পঁচা লাশের দুর্গন্ধ, পালাবারও পথ নেই। নিরূপায় জীবিতরা। লাশ গোঁজানো ছাড়া করারও কিছু নেই। দয়াপরবশ কর্তৃপক্ষ কিছু আর্থিক সহযোগিতায় এগিয়ে এলেন। এটাকে দয়া বলা ছাড়া উপায় কী? পেটে দিলে পিঠে সয়, এ যেন তাই।

মুরব্বীদের মাঝে খুঁজে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী লোকদের খোঁজ পেলাম। ঐ লাশ উদ্ধার ও দাফনের সাথে জড়িত উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা হলেন: শামসুর রহমান, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, বরকল থানা; জয়নাল আবেদীন, সাবেক চেয়ারম্যান ভূষণছড়া ইউনিয়ন কাউন্সিল; আব্দুল হামিদ মেম্বার, ভূষণছড়া ইউনিয়ন কাউন্সিল; কাসেম দেওয়ান, আনসার-ভিডিপি কর্মকর্তা; আলি আজম, প্লাটুন কমান্ডার, ভিডিপি; সাহেব আলী, ভিডিপি সদস্য; শামসুল আলম, পল্লী ডাক্তার ও ভিডিপি কমান্ডার; মীর মোহাম্মদ আবু তাহের, মেম্বার ভূষণছড়া ইউনিয়ন কাউন্সিল; ওমর আলী, পল্লী ডাক্তার; আ. হক সরকার,বাঙালি গ্রুপ লিডার; আ. রাজ্জাক,বাঙালি গ্রুপ লিডার ও অন্যান্য অনেক।

উপরোক্ত ব্যক্তিদের মাঝে জনাব শামসুল রহমান ও কাসেম দেওয়ান ছাড়া অন্যান্যরা পরেও সরেজমিনে ঘটনাস্থলেই আছেন। তারা সবাই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বক্তা। তাদের বর্ণনাতেই নিহতদের নিমোক্ত তালিকা প্রস্তুত করা হলো।

১। নুরুল ইসলাম, পিং রহিম উদ্দিন (১ জন)।
২। আবু বকর সিদ্দিক, পিং আ. রব (১ জন)।
৩। শাফিয়া খাতুন, পিং আ. রব (১ জন)।
৪। মধুমিয়া, পিং আ. রহমান (১ জন)।
৫। ছাদেক আলী, পিং ইমান আলী (১ জন)।
৬। শহিদ উদ্দিন গং এক পরিবার (৬ জন)।
৭। আলতামাস, পিং এজাবুল বিশ্বাস গং এক পরিবার (৭ জন)।
৮। আ. হান্নান গং এক পরিবার (৭ জন)।
৯। আজগর আলী গং এক পরিবার (৫ জন)।
১০। ফজলুর রহমানস গং এক পরিবার (৩ জন)।
১১। ওমর আলী গং এক পরিবার (৫ জন)।
১২। আইনুল হক গং এক পরিবার (৫ জন)।
১৩। রুস্তম আলী গং এক পরিবার (২ জন)।
১৪। জাকারিয়া গং এক পরিবার (৫ জন)।
১৫। ওমর আলী (২) গং এক পরিবার (৭ জন)।
১৬। আ. শুকুর মুন্সি গং এক পরিবার (৫ জন)।
১৭। সাইফুদ্দিন গং এক পরিবার (৩ জন)।
১৮। গুল মোহাম্মদ গং এক পরিবার (৭ জন)।
১৯। আলী আকবর গং এক পরিবার (৩ জন)।
২০। মো. আলী গং এক পরিবার (৩ জন)।
২১। তোফানী শেখ গং এক পরিবার (৬ জন)।
২২। আব্দুস সোবহান গং এক পরিবার (৩ জন)।
২৩। নাসির উদ্দিন,পিং ওমর আলী (১ জন)।
২৪। নিজাম উদ্দিন গং এক পরিবার (৩ জন)।
২৫। মোস্তফা গং এক পরিবার (৩ জন)।
২৬। ওমর আলী (১ জন)।
২৭। মোফাজ্জল হোসেন গং একপরিবার (২ জন)।
২৮। আব্দুল মোতালেব গং এক পরিবার (৩ জন)।
২৯। আসমত আলী মাল, পিং আহাম্মদ আলী মাল (১ জন)।
৩০। খলিলুর রহমান, পিং আতাহার হাওলাদার (১ জন)।
৩১। নুরুল ইসলাম গং এক পরিবার (৩ জন)।
৩২। জামাল আহাম্মেদ,পিং আব্দুল বারী (১ জন)।
৩৩। মো. ইউসুফ শেখ গং এক পরিবার (৫ জন)।
৩৪। আকবর আলী গং এক পরিবার (৪ জন)।
৩৫। শাহজাহান গং এক পরিবার (২ জন)।
৩৬। মো.সিদ্দিক মোল্লা, পিং ইব্রাহিম মোল্লা (১ জন)।
৩৭। আসব আলী, পিং নজব আলী (১ জন)।
৩৮। রজব আলী, পিং অসিম উদ্দিন (১ জন)।
৩৯। রবিউল, পিং সুন্দর আলী (১ জন)।
৪০। লোকমান, পিং মো. আলী (১ জন)।
৪১। হোসেন ফরাজী, পিং ওয়াজ উদ্দিন (১ জন)।
৪২। সিরাজউদ্দিন গং এক পরিবার (২ জন)।
৪৩। ওলি মন্ডল, পিং হানিফ মন্ডল (১ জন)।
৪৪। আকলিমা, পিং মালুখা (১ জন)।
৪৫। আসিয়া খাতুন, স্বামী আছর আলী (১ জন)।
৪৬। শামসুদ্দিন গং এক পরিবার (৬ জন)।
৪৭। কালু মিয়া গং এক পরিবার (২ জন)।
৪৮। জুছিনা বেগম স্বামী আব্দুল হামিদ (১ জন)।
৪৯। সিদ্দিক আহমদ গং এক পরিবার (৩ জন)।
৫০। মুসলেম গং এক পরিবার (৩ জন)।
৫১। আ. রাজ্জাক গং এক পরিবার (২ জন)।
৫২। আ. রাজ্জাক (২) গং এক পরিবার (৮ জন)।
৫৩। আ. হামিদ গং এক পরিবার (৬ জন)।
৫৪। আ. হাই গং এক পরিবার (৬ জন)।
৫৫। সকিনা বিবি গং এক পরিবার (৪ জন)।
৫৬। আ. খালেক গং এক পরিবার (৬ জন)।
৫৭। বেলাল মুন্সি গং এক পরিবার (৬ জন)।
৫৮। আ. রউফ গং এক পরিবার (৬ জন)।
৫৯। নিজামউদ্দিন গং এক পরিবার (৪ জন)।
৬০। আইয়ুব আলী গং এক পরিবার (৪ জন)।
৬১। সুলেমান গং এক পরিবার (২ জন)।
৬২। আ. মান্নান গং এক পরিবার (২ জন)।
৬৩। সুলতান ফরাজি গং এক পরিবার (২ জন)।
৬৪। নজরুল ইসলাম ও তার ছেলে (২ জন)।
৬৫। আ. খালেক (১ জন)।
৬৬। মো. গুলজার ও তার ছেলে (২ জন)।
৬৭। দুগ্ধপোষ্য শিশু ও বৃদ্ধ, বৃদ্ধা আনুমানিক (১০০ জন)।
৬৮। ফতেআলী, সুবহান ও নুরুল ইসলাম (৩ জন)।
৬৯। জসিম উদ্দিন মেম্বারের পরিবার সদস্য (৩ জন)।
৭০। ইউপি চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদিনের ছেলে (১ জন)।
সর্বমোট নিহত হয়েছে ৩৭০ জন।

ওয়্যারলেসের খবরে ঘটনা অবগত হয়ে, স্থানীয় বিডিআর জোন কমান্ডার প্রথম পরিদর্শক হিসেবে সকাল ৭টায় ভূষণছড়া আসেন। তৎপর রাঙ্গামাটি থেকে আর্মির রিজিওন কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার আনোয়ার সাহেব হেলিকপ্টার যোগে সকাল সাড়ে ৮টায় পৌঁছেন এবং তিনি গুরুতর আহত ৮৫ জনকে চট্টগ্রামের সিএমএইচে চিকিৎসার জন্য পাঠান। ঐ আহতদের মধ্যে নিমোক্ত ব্যক্তিরা এখনো জীবিত ও ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী, যথা: ১, আ. রব, পিং হাফেজ উদ্দিন; ২। ফিকি বেগম, স্বামী মোফাজ্জল আলী; ৩। আ. হাই, পিং একিন মিয়া; ৪। মোজাম্মেল আলী, পিং পেশকার আলী; ৫। আবুল হাসেম, পিং-অজ্ঞাত; ৬। তারা বানু, স্বামী মোজাম্মেল আলী; ৭। জামাল আহমেদ, পিং-আস্রব আলী।

রাষ্ট্রীয় তৎপরতা
৩১ মে বুধবার ১৯৮৪ এর রাতের এই মর্মান্তিক ঘটনার দুঃসংবাদে তখনকার রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান প্রেসিডেন্ট এরশাদ তিন দিন পর জুনের ৩ তারিখ শনিবার ভূষণছড়া আসেন। তখনো লাশ দাফন চলছিলো। ভূখা, নাঙ্গা, আশ্রয়হীন দুর্গতরা তার আগমনে হাহাকারে ফেটে পড়ে। এই প্রথম তিনি কিছু অনুদান মঞ্জুর করেন এবং লোকদের মৌখিক সান্ত¦না দেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে এই হুঁশিয়ারীও উচ্চারণ করেন যে, উপজাতীয়দের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক কিছু করা যাবে না। তাতে তারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে, আমাদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করবে। উপদ্রুত উপজাতিরা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিলে আন্তর্জাতিকভাবেও বাংলাদেশের বদনাম হবে। বিষয়টি পার্বত্য সমস্যাকে আরো জটিল করবে। যারা মারা গেছে তাদের তো আর ফেরত পাওয়া যাবে না। তবে সমস্যাটির শান্তি পূর্ণ সমাধানে আমরা চেষ্টা করছি। এরূপ ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় তারও ব্যবস্থা নিচ্ছি। সবাই ধৈর্য্য ধরুন এবং নতুন করে জীবন শুরু করুন। দুঃস্থদের খাওয়া পরা ও গৃহ নির্মাণের জন্য অনুদান দেয়া হবে। আপাতত নদী পারের নিরাপদ ক্যাম্প এলাকাই আপনাদের বসবাসের জন্য বরাদ্দ করা হলো। পরে বাগান ও কৃষিযোগ্য জমির ব্যবস্থা করা হবে।

এ সবই হলো ক্ষমতাবাদী সান্ত্বনার বুলি। আজ বহু বছর পরও ঐ দুঃস্থ লোকেরা জমি পায়নি। তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য স্কুল মাদরাসা নেই। চিকিৎসা সেবার জন্য কোনো হাসপাতাল স্থাপিত হয়নি। জীবন জীবিকা প্রায় শূন্যের উপর চলে। এরা যেন চরম দুর্দশাগ্রস্ত হতভাগ্য জনগোষ্ঠী।

সূত্র: অনুসন্ধানী প্রতিবেদন: ভূষণছড়া গণতহ্যা ১ ও ২, আতিকুর রহমান, পার্বত্য তথ্যকোষ (৩),পর্বত প্রকাশনী, পৃষ্ঠা: ১৪৫-১৫৪, প্রকাশকাল ২০০৭।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন