parbattanews

অপুষ্টিতে ভোগা রোহিঙ্গা শিশুরা মহামারীর সময়ে অনেক বেশি ঝুঁকিতে

সাধারণ দিনগুলিতে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয়শিবিরের ধুলোমাখা রাস্তার ওপর স্থাপন করা পুষ্টি কেন্দ্রটি মানুষের ভিড়ে উপচে পড়ে। ইউনিসেফের সহযোগিতায় পরিচালিত ২৭টি কেন্দ্রের মধ্যে এটি একটি কেন্দ্র। মারাত্মক এবং মাঝারি মাত্রার অপুষ্টিতে ভুগছে এমন শিশুদের জীবন রক্ষায় চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে এই কেন্দ্রটি।

বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর বিস্তার হ্রাস করতে মার্চের শেষের দিক থেকে শুরু হওয়া দেশব্যাপী লকডাউন ব্যবস্থা ইউনিসেফের পুষ্টি কেন্দ্রগুলোর কার্যক্রমকে প্রভাবিত করেছে। মানুষের ভিড় কমাতে এবং শারীরিক দূরত্ব মেনে সেবা প্রদান নিশ্চিত করার কারণে ইউনিসেফ ও তার সহযোগীদের সেবাদান কার্যক্রমের আকার সীমিত করতে হয়েছে, যা মানবিক সুযোগ সুবিধা প্রদানকে আরও কঠিন করে তুলছে।

কক্সবাজার ইউনিসেফের নিউট্রিশন ম্যানেজার ডাক্তার করণভীর সিং-এর মতো অনেক বিশেষজ্ঞই কোভিড-১৯ এর প্রভাব নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন।

ড. সিং জানান, “আশ্রয়শিবিরগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মাত্রা অনেক বেশি। এখানে প্রচুর মানুষ একসাথে ভিড়ের মাঝে বাস করছে এবং এখানকার স্যানিটেশন ব্যবস্থাও বেশ খারাপ। এখানে কোন রোগের প্রাদুর্ভাব এসব কারনেই অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের অনেক বেশি ঝুঁকিতে ফেলবে।”

রোহিঙ্গা শরণার্থী

মিয়ানমারে নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা আট লক্ষ ষাট হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আশ্রয়শিবিরগুলোতে বাস করছে। আশ্রয়শিবিরগুলোতে বসবাসকারী ১১ শতাংশেরও বেশি শিশু তীব্র অপুষ্টি এবং ৩০ শতাংশের বেশি শিশু দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টিতে ভুগছে।

বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহ ব্যাহত করার পাশাপাশি বিকল্প খাদ্যের সংখ্যাকে সীমিত করার ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ হুমকি হিসাবে দেখা দিয়েছে। অনেক রোহিঙ্গা পরিবার পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার গ্রহণের সুযোগ পায় না। তারা যে খাবার খায় তাতে বৈচিত্র্য না থাকার কারণে এটি শিশুদের বিকাশ, বৃদ্ধি এবং এমনকি বেঁচে থাকার জন্য হুমকীস্বরূপ।

আমরা ভয় পাচ্ছি কারণ আমাদের জীবন বাঁচাতে আমরা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছি। যদি আমাদের শিশুরা মারা যায় তবে আমাদের কি হবে?

ভয় ও অনিশ্চয়তার সাথে লড়াই

বিশ্বব্যাপী, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৪৫ ভাগের মৃত্যু হয় অপুষ্টির কারণে। একজন সুস্থ ও সবাস্থ্যবান শিশুর চেয়ে তীব্র অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর মৃত্যুর সম্ভাবনা নয় গুণ বেশি। ২০২০ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয়শিবিরে কোভিড-১৯ সংক্রমণের প্রথম ঘটনা নিশ্চিত হওয়া এবং আশেপাশের বাংলাদেশী কমিউনিটির মধ্যে সংক্রমণ বৃদ্ধির ফলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভয় ও আশঙ্কা বেড়ে চলেছে।

কক্সবাজারের ঘণবসতিপূর্ণ আশ্রয়শিবিরে বসবাসকারী পাঁচ শিশু সন্তানের মা ফাতেমা জানান, “আমরা ভয় পাচ্ছি কারণ আমাদের জীবন বাঁচাতে আমরা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছি। যদি আমাদের শিশুরা মারা যায় তবে আমাদের কি হবে?”

কমিউনিটি পুষ্টি স্বেচ্ছাসেবক তসলিমাতা বলেন, “আমি যখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে মহিলাদের সাথে কথা বলি তখন তারা করোনাভাইরাস নিয়ে অনেক প্রশ্ন করেন।” তিনি আরও বলেন, “আমি তখন তাদের হাত ধোয়া এবং শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখার বিষয়ে বলি।”

লকডাউনের মাঝেও কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া

গত বছর কমিউনিটি পুষ্টি স্বেচ্ছাসেবীরা শরণার্থী আশ্রয়শিবিরগুলোতে প্রতি মাসে অপুষ্টির মাত্রা নিরূপণের জন্য গড়ে এক লক্ষ পয়ত্রিশ হাজার শিশুর স্ক্রিনিং করেছে। তবে, কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রনে গৃহীত পদক্ষেপের কারণে এসব সেবাদান কার্যক্রম এখন স্থগিত রয়েছে।

রোহিঙ্গা পরিবারগুলোতে অপুষ্টির ঝুঁকি কমানোর জন্য কমিউনিটি পুষ্টি স্বেচ্ছাসেবীরা এখন রঙিন কোডেড টেপ ব্যবহারের মাধ্যমে অপুষ্টির নতুন ঘটনা চিহ্নিত করতে রোহিঙ্গা মায়েদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। শিশুর বাহুতে রঙিন কোডেড টেপ জড়িয়ে অপুষ্টির মাত্রা পরিমাপ করা হয়ে থাকে।

বর্তমানে, এই প্রক্রিয়াটি স্ক্রিনিংয়ের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াগুলোর তুলনায় বেশ ছোট আকারে চলছে তবে তীব্র অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের চিকিৎসা এবং সহায়তা নিশ্চিত করতে পুষ্টি কর্মীরা দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে।

ইতোমধ্যে এই পদ্ধতির ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া গেছে। কারণ, মার্চ মাসে লকডাউনের প্রাথমিক পর্যায়ের তুলনায় মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে পুষ্টিকেন্দ্রে সেবা গ্রহণের জন্য নতুন শিশুর ভর্তি চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে গৃহীত পদক্ষেপের কারণে শরণার্থী আশ্রয়শিবিরগুলোতে সহায়তা কর্মীদের চলাচল সীমাবদ্ধ থাকলেও রোহিঙ্গা মা ও সেবাদানকারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ইউনিসেফ এখন এই কার্যক্রমটিকে তরান্বিত করেছে।

সামনের সারিতে থাকা সাহসী স্বাস্থ্যকর্মীরা

শত কষ্টের মাঝেও রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের শিশুরা হাসি আর আনন্দে পুষ্টি কেন্দ্রের খেলার মাঠটিকে ভরে রাখে। এই হাসির শব্দগুলি এখন অনেকটা ম্লান হয়ে গেলেও শিশুদের সাহস সামনের সারির কর্মীদের চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করছে।

ইউনিসেফের সহযোগী কনসার্ন ওয়াল্ডওয়াইড দ্বারা পরিচালিত পুষ্টি কেন্দ্রের ম্যানেজার আলিমূল জানান, “অপুষ্টির হাত থেকে আরও শিশুদের রক্ষা করতে আমাদের কাজ চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন । আমারা যেসব শিশুদের সুস্থ করে তুলতে সাহায্য করেছি তাদের হাসি দেখে খুব আনন্দ হয়।”

কক্সবাজার থেকে আটশ’ কিলোমিটারেরও বেশি দুরে আলিমূলের পরিবার বাস করে। দেশজুড়ে সকল ধরনের গণপরিবহন বন্ধ হবার কারণে তার পরিবারের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লেও আলিমূলের বাড়ি যাওয়ার কোনও উপায় নেই।

শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের জন্য জরুরি সেবাদান কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে সামনের সারির কর্মীদের এই ত্যাগ ইউনিসেফকে সহযোগিতা করে চলেছে।

শরণার্থী আশ্রয়শিবিরে আসার পর থেকে হাম, কলেরার প্রকোপ, খারাপ স্যানিটেশন ব্যবস্থা, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এবং আবহাওয়ার ঝুঁকির মতো আরও অনেক বিপদের সন্মুখিন হতে হয়েছে রোহিঙ্গা শিশুদের। ইতোমধ্যে অপুষ্টির সাথে লড়াই করছে এমন শিশুদের স্বাস্থ্যের অবনতি ছাড়াও এসব কারণে আরও অনেক শিশু পুষ্টিহীনতার শিকার হতে পারে।

অপুষ্টিতে ভুগছে এমন শিশুদের চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রাখা ইউনিসেফের জন্য অত্যন্ত জরুরি। সুষম পুষ্টি প্রতিটি শিশুর ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে যা তাদের ভালভাবে বেড়ে উঠতে এবং তাদের কমিউনিটির একজন সক্রিয় সদস্য হয়ে উঠতে সাহায্য করে।

কক্সবাজার ইউনিসেফের নিউট্রিশন ম্যানেজার ড. করণভীর সিং বলেন, “রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কোভিড-১৯ মহামারীর মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু এই জটিল সময়ে আমরা প্রতিটি শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে কাজ করে যাব। কোভিড-১৯ সংকটটি যেন পুষ্টি সংকটে রূপ না নেয় তা মোকাবেলায় আমাদের এখনই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে ।”

সূত্র: ইউনিসেফ

Exit mobile version