অস্ত্র রপ্তানি করতে বাংলাদেশের বৃহত্তর পরিকল্পনা

fec-image

স্বনির্ভর একটি প্রতিরক্ষা শিল্পের ভিত্তি গড়ে তোলার বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে একটি ‘বিশেষায়িত ডিফেন্স ইকোনমিক জোন’ বা সামরিক অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এই উদ্যোগের লক্ষ্য সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর ব্যবহারের জন্য ড্রোন, সাইবার প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন ধরণের অস্ত্র ও গোলাবারুদের চাহিদা পূরণ। পাশাপাশি এসব রপ্তানির সম্ভাবনাও লক্ষ্যে রয়েছে।

বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের অভ্যন্তরীণ চাহিদার পরিমাণ প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার। এর পাশাপাশি বিজিবি, কোস্টগার্ড, পুলিশ, আনসার ও ভিডিপি এবং আধা-সামরিক নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর প্রতিরক্ষা হার্ডওয়্যারের বড় ধরণের চাহিদা রয়েছে। তাই একটি শক্তিশালী নিজস্ব প্রতিরক্ষা শিল্প এ চাহিদার বড় অংশ পূরণ করতে পারবে, এবং পরবর্তীতে রপ্তানির পথও খুলে দিতে পারবে বলে জানান সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তারা।

কর্মকর্তাদের মতে, এ শিল্পের বিকাশে রাজস্ব বাজেট, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি), যৌথ উদ্যোগ কিংবা সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের (এফডিআই) -এর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে প্রায় ১৫,০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রতিরক্ষাখাতের আধুনিকায়ন এবং আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের জন্য প্রযুক্তি হস্তান্তর, যৌথ বিনিয়োগ, পিপিপি ও এফডিআই সহজ করতে বেশকিছু নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

গত সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় বিশেষায়িত ডিফেন্স ইকোনমিক জোন স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানা গেছে। সভায় উচ্চ পর্যায়ের সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশের সরকার ও প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের উদীয়মান প্রতিরক্ষা উৎপাদনখাতে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে ওই সভার কার্যবিবরণীতে উঠে এসেছে, যা টিবিএস দেখেছে।

এবিষয়ে জানতে চাইলে বেজা’র নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী গত বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, “প্রতিরক্ষা শিল্পে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বিশেষায়িত ডিফেন্স ইকোনমিক জোন স্থাপনের বিষয়ে কাজ চলছে। জোনটি কোন এলাকায়, কি পরিমাণ জমি নিয়ে স্থাপন করা হবে, তা এখনও নির্ধারিত হয়নি। আমরা এখন পলিসি ও সাংগঠনিক কাঠামো নিয়ে কাজ করছি। বিভিন্ন বন্ধুসুলভ দেশের সঙ্গে কথা হচ্ছে। প্রতিরক্ষা শিল্পকে রপ্তানিমুখী শিল্পে পরিণত করার লক্ষ্যও রয়েছে।”

আশিক চৌধুরী যিনি একইসঙ্গে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষেরও (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান, এই শিল্পে বিনিয়োগে আগ্রহী পক্ষগুলোর মধ্যে চীন বা তুরস্ক রয়েছে কি-না, এমন প্রশ্নে কোনো মন্তব্য করতে রাজী হননি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ৩০ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টা নীতিগত দিকনির্দেশনার অনুমোদন দেন। বেজার চেয়ারম্যানের অনুরোধ পাওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রতিরক্ষা শিল্প স্থাপন সম্পর্কিত একটি সমন্বিত জাতীয় নীতিমালার খসড়া ধারণাপত্র (কনসেপ্ট পেপার) তৈরি কাজ শুরু করেছে।

সভায় তাঁরা জানান, সামরিক বাহিনী ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনের প্রস্তাব পেয়েছে। বিডা’র কাছেও এ ধরনের বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। তবে কিছু নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয় থাকায় সেগুলো নিয়ে আলোচনা শুরু করতে বিলম্ব হচ্ছে।

বেসরকারি বিনিয়োগকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে
সভায় উপস্থিত ছিলেন অর্থসচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার। ম্যাকডোনাল্ড ডগলাস, লকহিড মার্টিন -এর মতো বেসরকারি প্রতিরক্ষা শিল্প প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ দিয়ে প্রতিরক্ষা শিল্পে বেসরকারি বিনিয়োগের উপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

এখাতে বিনিয়োগের জন্য এক বছরের বাজেট থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা সংকুলান করা সম্ভব না হলেও কয়েক অর্থবছরে এই পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব বলে জানান অর্থসচিব। এছাড়া, ডিফেন্স ইকোনমিক জোন স্থাপনের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত অব্যবহৃত কারখানার জমিসহ সুনির্দিষ্ট জমি অধিগ্রহণের ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয় পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তা করবে বলে জানান অর্থসচিব।

সামরিক শিল্পের জন্য একটি বিশেষায়িত ডিফেন্স ইকোনমিক জোন স্থাপনে স্বল্পমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়ে অর্থসচিব বলেছেন, “এতে দ্রুত কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে।”

প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা উদ্যোগটিকে স্বাগত জানিয়েছেন, তবে সতর্ক পরিকল্পনার ওপর জোর দিয়েছেন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ (বিআইপিএসএস)-এর সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) এ এন এম মুনিরুজ্জামান বলেন, প্রতিরক্ষা খাতে স্বনির্ভরতা একটি কৌশলগত অপরিহার্যতা।

তিনি বলেন, সব দেশই প্রতিরক্ষাখাতে স্বনির্ভর হতে চায়। ডিফেন্স ইকোনমিক জোন স্থাপন করা সেই লক্ষ্যের জন্য অপরিহার্য। প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনে ব্যাপক বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত দক্ষতার প্রয়োজন হয়। ১৫,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ যথেষ্ট নয়।

তিনি আরও বলেন, বেসরকারি খাতকে বড় আকারে বিনিয়োগে সক্ষম করতে হবে, এবং প্রযুক্তিগত ঘাটতি যৌথ উদ্যোগ ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পূরণ করতে হবে। বেসরকারিখাতের সেই বিনিয়োগ সক্ষমতা রয়েছে কি-না, তা যাচাই করতে হবে।

বাংলাদেশের মতো দেশের প্রতিরক্ষা পণ্যের চাহিদা সীমিত উল্লেখ করে মনিরুজ্জামান বলেন, “তাই এখাতে গড়ে উঠা শিল্প টিকিয়ে রাখতে হলে রপ্তানির পথ খুঁজতে হবে। কিন্তু, প্রতিরক্ষা পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতা পূর্ণ এবং অনেক বড় বড় খেলোয়াড়রা সেখানে নতুন নতুন প্রযুক্তি নিয়ে খেলছে। তাই রপ্তানির সুযোগ পেতে হলে ওইসব বিদেশি কোম্পানির সরাসরি বিনিয়োগ বা তাদের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে যেতে হবে। তাহলে এটি সম্ভব হবে।”

প্রতিরক্ষা পণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে পড়েছে
সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশ পাকিস্তান গত চার বছর ধরে প্রতিবছর ৪৫০ মিলিয়ন ডলার এবং ভারত ২.৭৬ বিলিয়ন ডলার প্রতিরক্ষা শিল্পে বিনিয়োগ করতে সক্ষম হয়েছে। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা শিল্পে ১১.৩ বিলিয়ন ডলার, জার্মানি ৩.৩ বিলিয়ন ডলার, চীন ২.৪ বিলিয়ন ডলার, দক্ষিণ কোরিয়া ৬২১ মিলিয়ন ডলার, তুরস্ক ৬০০ মিলিয়ন ডলার, নেদারল্যান্ড ২৫৮ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।

শক্তিশালী প্রতিরক্ষা শিল্প স্থাপনের উপর গুরুত্ব তুলে ধরে সেনাবাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা শিল্পে খুব একটা অগ্রসর হতে পারেনি। অথচ একই ধরণের অর্থনৈতিক শক্তি নিয়ে অনেক দেশ এমন অবস্থানে চলে গেছে, যেখানে পৌঁছাতে আমাদের ন্যূনতম ২৫-৩০ বছর লেগে যাবে।

ওই কর্মকর্তা জানান, এখাতের শিল্পে একটি ইকো-সিস্টেম গড়ে তোলা দরকার, যা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আমদানি ছাড়াই কার্যকর থাকতে পারে।

সভায় বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানান, সামরিক শিল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কমপক্ষে পাকিস্তানের সমকক্ষ হবার সামর্থ্য রাখে।

তিনি বলেন, “জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় যেকোন মূল্যে প্রতিরক্ষা বাহিনী ও শিল্পকে শক্তিশালী করার জন্য এই উদ্যোগ এখনই নেওয়া উচিত।” ডিফেন্স ইকোনমিক জোন স্থাপনের জন্য গাজীপুরের বাংলাদেশ অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির মতো নির্ধারিত অঞ্চল থাকা উচিত বলেও উল্লেখ করেন বাণিজ্য সচিব।

সভায় একজন কর্মকর্তা বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে সমরাস্ত্র বা সামরিক যান-সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরণের প্রতিরক্ষা শিল্প বেসরকারি উদ্যোগে প্রসার লাভ করেছে। বাংলাদেশের বড় শিল্প গ্রুপগুলোও এধরনের ভূমিকা রাখতে পারে।

তবে শিল্প মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু বাধার কথা উল্লেখ করে বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সাধারণত গ্যারান্টি বা আইনি সুরক্ষা চান, যা বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন ও নীতিমালায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই। তাই বিনিয়োগ কীভাবে হবে এবং বিনিয়োগকারীদের কীভাবে নিশ্চয়তা দেওয়া হবে, তা আসন্ন নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে মত দেন তিনি।

বর্তমান প্রতিরক্ষা ক্রয় আইন ও সংশ্লিষ্ট বিধি-বিধান বেসরকারি অংশগ্রহণ সীমিত করে রেখেছে, যা দূর করে বিনিয়োগকারীদের পথ করে দিতে নতুন আইন প্রণয়নের উপর গুরুত্ব দেন অন্য একজন কর্মকর্তা।

সভায় অংশগ্রহণকারীরা পরামর্শ দেন, তুরস্ক বা পাকিস্তানের নীতিমালা অনুসরণ করে একটি স্থায়ী সমন্বয় কাঠামো গঠন করা উচিত, যা প্রতিরক্ষা শিল্প বিকাশের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করবে।

প্রক্রিয়া তদারকিতে গঠিত হলো দুটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি

বৈঠকে দুটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়—
‘প্রতিরক্ষা শিল্প উন্নয়ন সম্পর্কিত জাতীয় নীতিমালা’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা উপদেষ্টাকে সভাপতি করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
সামগ্রিক অগ্রগতি তদারকির জন্য ‘বাংলাদেশ জাতীয় প্রতিরক্ষা শিল্প-উন্নয়ন সমন্বয় পরিষদ’ নামে আরেকটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বর্তমানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নির্বাচিত সরকারের সময় সাধারণত প্রধানমন্ত্রীরা এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

ডিফেন্স ইকোনমিক জোনে উৎপাদিত অস্ত্র-গোলাবারুদ রপ্তানির উপর গুরুত্বারোপ করে সভায় বক্তারা বলেন, অস্ত্র-গোলাবারুদ রপ্তানির ক্ষেত্রে একই দ্রব্যের নিট আমদানিকারক রাষ্ট্রের অবস্থান হতে বাংলাদেশের উত্তরণ প্রয়োজন হবে। অন্যান্য সরঞ্জামের ক্ষেত্রে দেশের সকল সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর প্রয়োজন মেটানোর পর রপ্তানির সুযোগ রাখা যেতে পারে।

নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তা সভায় বলেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন শিপইয়ার্ড ফ্রিগেটসহ বড় সমুদ্রগামী জাহাজ উৎপাদনের লক্ষ্যে কার্যক্রম আরম্ভ করেছে। এক্ষেত্রে জাহাজগুলো প্রস্তুতের পর বিদেশে রপ্তানির সুযোগ না থাকলে তা বিনিয়োগে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

এ শিল্পের বিকাশে বন্ধুসুলভ দেশগুলোর সঙ্গে কৌশলগত জোট-নির্ভর হওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তিনি বলেন, এবিষয়েও একটি নীতিগত অবস্থান গ্রহণ ও নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন