আইন দিয়ে যে সমস্যার সমাধান সম্ভব সে বিষয়গুলো দিয়ে ভূমি কমিশনকে কাজ চালিয়ে যেতে বললেন আইনমন্ত্রী

পার্বত্যনিউজ রিপোর্ট:
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিধি তৈরির অজুহাতে বিলম্ব না করে আইনের মাধ্যমে যেসব সমস্যার সমাধান করা যায় সে বিষয়গুলো নিয়ে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে। ‘বর্তমান সরকার দ্রুততম সময়ে শান্তি চুক্তির সব বিষয়াদি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আন্তরিকভাবে কাজ করছে।’

মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর রমনায় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) অডিটোরিয়ামে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা নিষ্পত্তিকরণে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ ও বাধাসমূহ নিরূপণে করণীয়’ শীর্ষক এক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন। সেমিনারটির আয়োজন করে বিআইআইএসএস।

মন্ত্রী বলেন, ‘১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তিচুক্তি সইয়ের পর থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার চুক্তিটির পূর্ণ বাস্তবায়নে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং ১৯৯৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়েছে। এছাড়াও বর্তমান সরকার ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইন ২০০১’ প্রণয়ন ও ২০১৬ সালে এর সংশোধনী আনে। এভাবেই ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে সরকার।

আনিসুল হক বলেন, প্রচুর সমস্যা থাকা সত্ত্বেও পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধান করার উদ্যোগ নেয়নি। স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধুই প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা নিরসন ও উন্নয়নের উদ্যোগ নেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর এই উদ্যোগ থেমে যায়।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অভ প্রফেশনালসের বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রফেসর ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, কাপ্তাই ড্যাম তৈরি করে পাকিস্তান রাষ্ট্র তাদের ভূমি চ্যুত করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্র তাদের ফিরিয়ে এনেছে। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্কট হচ্ছে আস্থার সঙ্কট। পার্বত্য চট্টগ্রামে আস্থা ফিরিয়ে আনতে সেখানকার জনগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।

প্রফেসর আনোয়ার হোসেন আরো বলেন, শান্তিুচুক্তিতে যে আঞ্চলিক পরিষদ রয়েছে তা সংবিধান বিরোধী। এককেন্দ্রীক রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের মধ্যে কোনো আঞ্চলিক পরিষদ থাকতে পারে না। এটার নাম হিল কাউন্সিল বা পাহাড়ী পরিষদ হতে পারে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার বলেন, ভূমি সমস্যা পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল সমস্যার অন্যতম। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরিয়ে আনতে এই সমস্যার আশু সমাধান কাম্য। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিতে সরকারের আন্তরিকতা সত্ত্বেওেএ ব্যাপারে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়নি এটাই বাস্তবতা। ভূমি সমস্যা নিরসনে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নেতৃবৃন্দ খুব একটা এগিয়ে আসেননি। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের বেশিরভাগ বৈঠকেই অনুপস্থিত থেকে কোরাম সঙ্কট সৃষ্টি করাসহ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা কোনো সহযোগিতা করেননি। পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নেতৃবৃন্দ কখনোই নিজেদের সার্বিকভাবে জনগনের নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিক করার চেষ্টা করেননি, বরং তারা শুধু নিজ উপজাতির নেতা হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতেই সচেষ্ট। ফলে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিতে নিজ স্বার্থের সঙ্কীর্ণতার উর্দ্ধে উঠে তাদের পক্ষে নিষ্পত্তি করা দুরহ ব্যাপার বলে আমার মনে হয়। ভূমি সমস্যা সমাধানে তাদের এই মনোভাব একটা বিরাট অন্তরায় হিসাবে বিবেচিত হতে পারে।

তিনি বলেন, ১৯৯৯ সালে ভূমি কমিশন গঠন হবার পরে এ পর্যন্ত ৫টি ভূমি কমিশন গঠিত হলেও কমিশনের চেয়ারম্যানগণ আন্তরিকতার সাথে কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করলেও সদস্যদের অনীহার কারণে প্রয়োজনীয় জনসংযোগ স্থাপনে এ কমিশন কোনো কার্যকর ভূমিকার রাখতে পারেনি। ফলে কমিশন স্থানীয় গনগনের আস্থা অর্জনে এখনো পুরোপুরি সক্ষম হয়নি। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন কার্যকর হলে ভূমির মালিকানা নির্ধারণ ও হস্তান্তরের ব্যাপারে হেডম্যান ও কার্বারীদের ক্ষমতা খর্ব হবে বলেও তাদের মাঝে এক ধরণের শঙ্কা বিদ্যমান। এটাও ভূমি কমিশন কার্যকর করার ক্ষেত্রে একটা বড় বাধা।

জেনারেল জাহাঙ্গীর বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর ধারণা পার্বত্য চট্টগ্রামের জমি, বন ও পাহাড় তাদের সামাজিক সম্পত্তি। তারা মনে করেন প্রচলিত পদ্ধতি ও প্রথাগতভাবে নিজস্ব আবাদকৃত জমি ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল জমির উপর তাদের সামাজিক বা যৌথ মালিকানা রয়েছে এবং এর জন্য তাদের কোনো কাগজপত্র বা চুক্তির প্রয়োজন নেই। গত ১ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে বান্দরবানে অনুষ্ঠিত হেডম্যান ও কার্বারী সম্মেলনে হেডম্যানগণ বলেন, যেসকল জমিতে কোনো না কোনো সময় উপজাতি জনগন জুম চাষ করেছে তা অটোম্যাটিক্যালি তাদের হয়ে গেছে। এর জন্য আর কোনো কাগজপত্রের প্রয়োজন নেই। পাহাড়ে কোনো খাস জমি নেই বলেও তারা দাবী জানান। তাদের এ ধরনের সনাতনী চিন্তা ভাবনা ভূমি সমস্যা নিরসনে আরেকটি অন্তরায় হিসাবে বিবেচিত হতে পারে।

তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন আইন ২০০১ এবং সংশোধনী ২০১৬ তে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত শতকরা ৪৯ ভাগ অউপজাতি জনগোষ্ঠীর কোনো প্রতিনিধি নেই। অপরদিকে চেয়ারম্যান ও ডিভিশনাল কমিশনার যারা পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী নন, তারা ব্যাতিত কমিশনের সকল সদস্যই উপজাতি জনগোষ্ঠীর। সুতরাং কমিশনের কাছ থেকে সঠিক বিচার পাওয়ার ব্যাপারে অউপজাতি জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রবল সংশয় বিদ্যমান।

এই সকল বাধাসমূহ উত্তোরণের উপায় সম্পর্কে তিনি বলেন, ভূমি সমস্যা নিরসন কল্পে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বসবাসকারী সকল জনগোষ্ঠী, সামরিক ও অসামরিক প্রশাসন, রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দ, এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কর্তৃক স্বতস্ফুর্ত ও আন্তরিক সহযোগিতা ও সমর্থন প্রদান করতে হবে। এই সহযোগিতা ও সমর্থন প্রদান ছাড়া কোনোভাবেই কমিশনের পক্ষে এখানে কাজ করা অত্যন্ত দুরহ ব্যাপার। স্থানীয় নেতৃবন্দ ও গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গের একপেশে মনোভাব সম্পূর্ণ পরিহার করে ভূমি সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে এবং তাদেরকে মনে করতে হবে যে তারা জনগণের প্রতিনিধি, কোনো পার্টিকুলার উপজাতির প্রতিনিধি তারা নয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনকে সাধারণ জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য নিরপেক্ষ মনোভাব পোষণ করতে হবে এবং তাদের বিবিধ কার্যাবলীর মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে যে তারা পক্ষপাতিত্বহীন ভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যার নিরসন করতে সক্ষম।

তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনকে শুরুতে কম বিরোধ সম্পন্ন সমস্যার সমাধান করে জনগণের আস্থা অর্জন করে ধাপে ধাপে বেশি বিরোধ সম্পন্ন সমস্যার সমাধান করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনকে লক্ষ্য রাখতে হবে যে তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর কোনো অংশই যেন তাদের অধিকার বঞ্চিত না হয়। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন বিধিমালা অতিদ্রুত প্রণয়ন করতে হবে এবং বর্ণিত আইনে যেসকল বিষয় স্পষ্ট নয় সেসকল বিষয়গুলোকে এই বিিধিমালার দ্বারা স্পষ্ট করতে হবে। বিধিমালা তৈরির সময় লক্ষ্য রাখতে হবে তা যেন পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী সকল উপজাতি ও অউপজাতি জনগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করতে পারে।

উক্ত সেমিনারে আরও বক্তব্য রাখেন, মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার, ব্যারিস্টার সরোয়ার হোসেন প্রমুখ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিসের মহাপরিচালন মেজর জেনারেল আবদুর রহমান।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন