আজ ভয়ানক সেই ১৭ এপ্রিল: ৪ বছর ধরে বিচারের আশায় প্রহর গুণছে বড় পিলাকের স্বজনহারা বাঙালী পরিবারগুলো

বড় পিলাক হত্যাকাণ্ড

২০১১ সালের এই দিনে ভূমি বিরোধকে কেন্দ্র করে রামগড়ে স্বশস্ত্র সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয় নিরীহ ৩ বাঙ্গালী, অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্থ হয় পাহাড়ি-বাঙালি’র শতাধিক ঘর-বাড়ি

এম. সাইফুর রহমান, খাগড়াছড়ি ॥

আজ ভয়ানক সেই ১৭ এপ্রিল। ২০১১ সালের এই দিনে ভুমি বিরোধকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণীর বহিরাগত স্বার্থন্নেষী মহল পাহাড়ী-বাঙ্গালীর সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বিনষ্ট করার প্রয়াসে শান্ত পাহাড়কে অশান্ত করে জন্ম দেয় এক কলঙ্কময় অধ্যায়ের। এদিন উপজাতীয় স্বশন্ত্র সন্ত্রাসীদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে প্রাণ হারিয়েছে নিরপরাধ তিন বাঙ্গালী শ্রমিক। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাহাড়ী-বাঙ্গালী উভয় সম্প্রদায় হারিয়েছে প্রায় দু’শতাধিক ঘর-বাড়ি। উৎশৃংখলদের লাগানো আগুনের লেলিহান শিখা পুড়ে ছাই করে দিয়েছে তাদের ঘর-বাড়িসহ স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে, সম্প্রীতিকে।

২০১১ সালের ১৭ এপ্রিল খাগড়াছড়ি’র রামগড় উপজেলার বড়পিলাক কচু বাউন্তী এলাকায় ভূমি বিরোধকে কেন্দ্র করে উপজাতীয় স্বশস্ত্র সন্ত্রাসীরা বাঙ্গালীদের ধারলো অস্ত্র দিয়ে এলোপাথাড়ী কুপিয়ে জখম করে। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হয় নোয়াব আলী, আয়ুব আলী ও সুনিল চন্দ্র সরকার। আহত হয়েছিল অন্তত ৩০জন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রামগড় উপজেলার হাফছড়ি ইউনিয়নের উত্তর শণখোলাপাড়া ও রেয়ং মরং পাড়ায় এবং মানিকছড়ির মহামুনি কার্বারী পাড়ায় উত্তেজিত জনতা পাল্টাপাল্টি নিরীহ পাহাড়ী-বাঙ্গালী উভয় সম্প্রদায়ের প্রায় শতাধিক ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। আগুনের লেলিহান শিখা শুধু এসব ঘর-বাড়িকেই পুড়ে ছাই করে দেয়নি, ধ্বংস করে দিয়েছে শত শত বছরের পাহাড়ী-বাঙ্গালীর সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির বন্ধনকে।

চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ড ও দাঙ্গার চার বছর পার হয়ে গেলেও আজো পুলিশ মামলার তদন্ত শেষ করতে পারেনি। বিচারতো দুরের কথা। ক্ষতিপুরণ পায়নি ক্ষতিগ্রস্ত কোনো বাঙালী পরিবার। এ ব্যাপারে গুইমারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, মামলা তদন্তাধীন রয়েছে, প্রতিবেদন পাঠানো হবে। ওযারেন্ট আসলে আসামীদের গ্রেফতার করা হবে। স্থানীয় বাঙালীদের দাবী, ভিকটিম বাঙালী বলেই মামলার তদন্তে পুলিশের কোনো তাগাদা নেই। বাঙালী বলেই, দেশী বিদেশী এনজিও, দাতা সংস্থা, জাতীয় ও স্থানীয় সুশীল সমাজের কোনো দাবী নেই। শুধু বড় পিলাক নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো বাঙালী হত্যারই বিচার হয়নি আজ পর্যন্ত।

এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৎকালে একদিকে হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ বাঙালিরা বিক্ষোভ মিছিল করে রাস্তায় নেমে এসে চট্রগ্রাম-ফেনী-খাগড়াছড়ি সড়ক অবরোধ করে যানবাহনে ভাংচুর চালায়। বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়িরাও পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলে। ফলে মানিকছড়ি ও রামগড় উপজেলায় পাহাড়ি-বাঙালির মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ ও সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তাৎক্ষণিক ভাবে রাস্তায় নেমে আসে। পাশাপাশি মানিকছড়ি, মাটিরাঙ্গা ও রামগড় তিন উপজেলায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।

প্রত্যক্ষ্যদর্শীরা জানিয়েছেন, যে জমি নিয়ে বিরোধের সূত্রপাত তা কাগজপত্রে বাঙ্গালীদের জায়গা। দীর্ঘ দিন উপজাতীয় একটি মহল বাঙ্গালীদের উচ্ছেদ করে এ জায়গা দখলের চেষ্টা চালিয়ে আসছিল। শেষ পর্যন্ত দখল করতে ব্যর্থ হয়ে তারা এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। তবে যে জায়গা নিয়ে রক্তপাত হানাহানি এত কিছু ঘটে গেল, সেই জায়গায় বাঙ্গালীরা আজও যেতে পারেনি। অদ্যবদি এর কোন সমাধান না হওয়ায় শংকিত এলাকাবাসী। যে কোন সময় এ ভুমি বিরোধকে কেন্দ্র আবারো রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এ ঘটনাকে কেন্দ্রকরে পাহাড়ী-বাঙ্গালী পরস্পর বাদী হয়ে গুইমারা থানায় হত্যা ও অগ্নি সংযোগের ২টি পৃথক মামলা দায়ের করে। এ পরিস্থিতিতে তৎকালীন পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার, খাগড়াছড়ি সাংসদ যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা, জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক মো: জাহেদুল আলমসহ সরকারী-বেসরকারী সকল সংস্থার উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের আশ্বাস দিয়ে ছিলেন। এরপর তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোঃ সালাহউদ্দিনের নেতৃত্বে অন্য দুই সদস্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দেলোয়ার হোসেন সাইদী ও রামগড় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গোপাল চন্দ্র দাসকে নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত কাজ শুরু করেন এবং এর রিপোর্টও জমা দেন। কিন্তু এতকিছুর পরও অদ্যবধি এ হত্যাকান্ডের কোন বিচার পায়নি নিহতের পরিবাগুলো।

এদিকে ৩বাঙ্গালীকে হত্যার ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়ে বিচার দাবী করেন খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপি’র সভাপতি সাবেক সাংসদ ও সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ওয়াদুদ ভূইয়া, পার্বত্য চট্টগ্রাম সম-অধিকার আন্দোলন খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা শাখার সভাপতি আবু ইউছুফ চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান মিল্লাত, জেলা ছাত্রদল সভাপতি কামাল উদ্দিন দীপ্ত, পার্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি এ্যাডভোকেট এয়াকুব আলী চৌধুরী। গতকাল দুপুরে পৃথক পৃথক বিবৃতিতে তারা এ দাবী জানান।

বিবৃতিতে ওয়াদুদ ভূইয়া ১৭ এপ্রিল বড়পিলাক হত্যা ট্রাজেডির ৪র্থ বর্ষিকীতে ঘটনার সাথে জড়িতদের গ্রেফতার এবং ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ না দেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে করেন, এ ঘটনায় নিহতদের তিনটি পরিবার আজ অনাহারে-অর্ধাহারে অমানবিক ভাবে জীবন যাপন করছে। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে প্রশাসনিক কর্তারা তাৎক্ষনিকভাবে নানান আশ্বাস দিলেও এখনো এসব বাস্তবায়ন না করায় সরকারের কঠোর সমালোচনা করে ক্ষতিগ্রস্থদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও দোষীদের অভিলম্বে গ্রেফতারপূর্বক বিচারের দাবী করেন তিনি। এছাড়াও ভবিষ্যতে যেন এঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সবাইকে সজাগ থাকার আহবান জানান তিনি। বিবৃতিতে তিনি বলেন, এ ধরণের ঘটনার সঠিক বিচার না হলে পুনরাবৃত্তি রোধ কখনই সম্ভব নয়।

অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম-অধিকার আন্দোলন খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা শাখার সভাপতি আবু ইউছুফ চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান মিল্লাত ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারপূর্বক শাস্তি দাবী করে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ না দেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

এছাড়াও পার্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি এ্যাডভোকেট এয়াকুব আলী চৌধুরী জানান, নিহতদের পরিবারগুলো এখনো অনাহারে-অদ্যহারে দিনাতিপাত করছে। তাই দ্রুত নিহত পরিবারেরর প্রতি ক্ষতিপূরণের দাবী জানান জানিয়েছেন তিনি। এছাড়াও এখনো সন্ত্রাসীদের হামলায় হতাহতের কোন সুষ্ঠ বিচার না হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে দ্রুত সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার ও অধিকার বঞ্চিত পার্বত্য বাঙ্গালীদের প্রাণ প্রিয় সংগঠন “পার্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদ”র ৮ দফা দাবী যথাযথ বাস্তবায়নে সরকারের প্রতি জোর দাবী জানান তিনি।

অন্যদিকে পার্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় যুগ্ন সম্পাদক আব্দুল মাজিদ জানান, ন্যাক্কারজনক এ ঘটনার প্রতিবাদ ও সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের দাবীতে আমরা সরকারের কাছে জোর দাবী জানাচ্ছি। এছাড়াও ঘটনাস্থল বড়পিলাক এলাকায় কালো ব্যাচ ধারন ও কালো পতাকা উত্তলনের কর্মসূচী গ্রহন করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৎকালে পার্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন ৫দিনের কর্মসুচী গ্রহণ করেছিল। কর্মসূচীর মধ্যেছিল তিন পার্বত্য জেলায় কালো ব্যাজ ধারণ ও কালো পতাকা উত্তোলন, ঘটনাস্থল বড়পিলাক ও খাগড়াছড়ি জেলা শহরের শাপলা চত্বরসহ বিভিন্ন এলাকায় কালো পতাকা উত্তোলন, প্রতিবাদ সমাবেশ, সকল মসজিদে দোয়া, গীর্জা ও মন্দিরে প্রার্থনা, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি জেলায় সকাল-সন্ধ্যা সড়ক পথ ও নৌপথ অবরোধ, সর্বশেষ ২৫ এপ্রিল তিন পার্বত্য জেলায় বিক্ষোভ সমাবেশ ও জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি প্রদান করা। এত সবের পরও প্রকৃত অপরাধিদের বিচারের কাঠগড়ায় না আনায় হতাশায় ভূগছে পাহাড়ে বসবাসরত বাঙ্গালীরা। তাদের প্রশ্ন আদৌ কি এ হত্যাকান্ডের বিচার পাবে নিহতদের স্বজনরা।

বড় পিলাক হত্যাকাণ্ড নিয়ে সেনাসদরের বক্তব্য:

১৭ এপ্রিল খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলার বড়প্লাক এলাকার ছনখোলাপাড়ায় পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সহিংসতায় ৩ বাঙালি নিহত হন এবং অপর দুুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা যায়। এছাড়াও উভয়পক্ষের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। ঘটনার বিবরণে জানা যায়, ওই এলাকার একটি জমিতে হলুদ চাষকে কেন্দ্র করে উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে। উল্লেখ্য, ওই চাষের জমি নিয়ে বাঙালি-পাহাড়ি উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে মালিকানাবিষয়ক বিরোধ চলছিল। এ বিষয়ে ভুল বোঝাবুঝির অবসানকল্পে সিন্দুকছড়ি সেনা জোন কমান্ডার ১৬ এপ্রিল জমির মালিক, হলুদচাষীসহ সংশ্লিষ্ট সভার সঙ্গে এক মতবিনিময় সভা করেন। সভায় উপস্থিত সবাই এ বিষয়ে সবধরনের বিরোধ এড়িয়ে চলার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এছাড়া ১৭ এপ্রিলের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকল্পে একটি সেনা টহল ওই এলাকায় যায়। এ সময়ও তারা কোনো ধরনের উত্তেজনা লক্ষ্য করেনি। হঠাত্ করেই এবং আকস্মিকভাবেই ১৭ এপ্রিল পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের একটি দল ধারালো অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালি হলুদ চাষীদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। ঘটনার পর অনতিবিলম্বে খাগড়াছড়ি পুলিশ প্রশাসনের টহলের পাশাপাশি গুইমারা রিজিয়ন কর্তৃক গোলযোগপূর্ণ এলাকায় ১৭টি টহল প্রেরণ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করা হয়। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে চেষ্টা করেন।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন