পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসলেও ভূমি জটিলতায় নিজভূমে পরবাসী দাবী বাঙালিদের

আজ শান্তিচুক্তির ২২ বছর পূর্তি

fec-image

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বরে করা পার্বত্য শান্তি চুক্তির  ২২ বছর পূর্তি হলো আজ। সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর ১৯৯৮ সালে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন শান্তিবাহিনী চার দফায় আত্মসমর্পন করে। এরমধ্যে-

♦  ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ তারিখে ৭৩৯জন আত্মসমর্পন করেন সমর্পন করেন। তাদের সমর্পনকৃত অস্ত্রের মধ্যে ১৪টি টি-৫৬ রাইফেল, এসএমজি টি-৫৬ ১২টি, এলএমজি ৭টি, জি থ্রি রাইফেল ১৩১টি, এসএমসি ৩১টি, ৩০৩ ব্রেন এলএমজি ১৪টি, মোর টি-৬৩ ৩টি, মোর(ব্রিটিশ) ৪টি, থ্রি নট থ্রি রাইফেল ৮১টি, পিস্তল/রিভলভার ৫টি, সিএম স্ট্যান্ড ২৪টি, ২ মোর ১টি, ৪০ এমএম আরএল ১টি, পাইপ গান ২৬টি, এসএলআর ৮৩, স্মল ব্রোক রাইফেল  ১টি। মোট ৪৩৮টি।

♦ ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ তারিখে বাঘাইহাট স্কুলে ৫৪২জন, তাদের জমা দেয়া অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে টি-৫৬ রাইফেল ১৩টি, এসএমজি টি-৫৬ ৯টি, এলএমজি ৬টি, জি থ্রি রাইফেল ৩২টি, এসএমসি ১৪টি, মোর টি-৬৩ ১টি, থ্রি নট থ্রি রাইফেল ১০০টি, পিস্তল/রিভলভার ৪টি, পাইপ গান ৪টি, এসএলআর ৩৬। মোট ২১৯টি।

♦ ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ তারিখে বাঘাইছড়ির বরাদম স্কুলে ৪৪৩ জন অস্ত্র সমর্পন করেন।  এরমধ্যে এসএমজি টি-৫৬ ২টি, জি থ্রি রাইফেল ২টি, এসএমসি ১৫টি, থ্রি নট থ্রি রাইফেল ৩০টি, এসএলআর ১১টি। মোট ৬০টি।

♦ ৫ মার্চ ১৯৯৮ তারিখে পানছড়ির দুদুকছড়িতে ২২২ জন শান্তি বাহিনীর সদস্য অস্ত্র সমর্পন করেন।  এরমধ্যে টি-৫৬ রাইফেল ৯টি, এসএমজি টি-৫৬ ৬টি, জি থ্রি রাইফেল ৯টি, এসএমসি ১টি, থ্রি নট থ্রি রাইফেল ৩টি, এসএলআর ৩। মোট ৪৪টি। সর্বমোট ১৯৪৬ জন ৭৬১টি অস্ত্র জমা দিয়ে আত্ম সমর্পন করেন।

প্রতিবছর দেশী-বিদেশী অর্থায়নে ডামাডোল বাজিয়ে ২ ডিসেম্বর বিতর্কিত “শান্তিচুক্তির” বর্ষপূর্তি উদযাপন করলেও পার্বত্যাঞ্চলে কখনোই স্থায়ী শান্তি ফিরবে কিনা তা নিয়ে উপজাতীয় সংগঠনগুলোর মধ্যেও সংশয় রয়েছে। একদিকে পার্বত্য জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) দিবসটি শান্তিচুক্তির বর্ষপূর্তি হিসেবে পালন করে, পক্ষান্তরে ইউনাইটেড পিপলস ডেমক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) দিবসটিকে ‘জাতীয় বেইমান দিবস’ হিসেবে পালন করছে বরাবরের মত। এসকল কারণে পার্বত্য জনপদে এখনও আতঙ্ক বিদ্যমান।

গত ২১ বছরে চুক্তির ৭২ টি ধারার মধ্যে ৪৮ টি পূর্ণ বাস্তবায়ন, ১৫টির আংশিক বাস্তবায়ন এবং ৯টি  ধারার বাস্তবায়ন  প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী ৩ পার্বত্য জেলায় হস্তান্তরযোগ্য  ৩৩ টি বিষয়ে মধ্যে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ ৩০টি ,খাগড়াছড়িতে ৩০টি এবং বান্দরবান জেলা পরিষদে ২৮টি বিষয় হস্তান্তর করা হয়েছে। অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে পাহাড়ের মানুষ অতীতের সকল রের্কড ছাড়িয়েছে। স্বাধীনতার আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিলো ৪১ কিলোমিটার সড়ক। যা বর্তমানে ১ হাজার ৫ শত ৩৫ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে অসংখ্য ব্রীজ কালর্ভাট। পাশাপাশি ৫টি স্থল বন্দর নির্মানেরও পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। চুক্তির পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে এবং উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

সূত্র আরো জানান, সরকারের পাশাপাশি ১২০টি এনজিও পাহাড়ে কাজ করছে সামগ্রিক উন্নয়নে। এসবের পাশাপাশি দেশের সার্বভৌম রক্ষায় নিযোজিত সেনাবাহিনীর উদ্যোগেও বিপুল সংখ্যক উন্নয়ন পরিকল্পনা এরই মধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে। সব মিলে এ সরকার পাহাড়ের আমূল পরিবর্তন করেছেন।

সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শান্তিচুক্তির পূর্বে নিরাপত্তা বাহিনী ১৬০৯ অস্ত্র উদ্ধার করেছে। এর মধ্যে গ্রেনেড ৩৫৯টি, মর্টার ৭০টি, মাইন ১৩টি এবং অন্যান্য গোলাবারুদ সাড়ে ৪ লক্ষ। এই পরিসংখ্যানে আরো দেখা গেছে, শান্তিচুক্তির পরে ২০০৫ সাল থেকে ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত ২৬৩০টি অস্ত্র ও ১৮৪৫৬৯টি গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে নিরাপত্তা বাহিনী।

শান্তিচুক্তির পূর্বে ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত শান্তিবাহিনী কর্তৃক ২৩৮ জন উপজাতি, ১০৫৭ জন বাঙালি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ১৭৮ জন উপজাতি ও ৬৮৭ জন বাঙালি। অপহরণের শিকার হয়েছে ২৭৪ জন উপজাতি ও ৪৬১ জন বাঙালি।

একই পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শান্তিচুক্তির পরে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত শান্তিবাহিনী কর্তৃক ৪৪১ জন উপজাতি,২৭১ জন বাঙালি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ৬৭২ জন উপজাতি ও ৮২৮ জন বাঙালি। অপহরণের শিকার হয়েছে ৯৯১ জন উপজাতি ও ৪২০ জন বাঙালি।

সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনীর ৩৫৯ জন সদস্য নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৪৩০ জন এবং অন্যভাবে ২২৭ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। একই পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শান্তিচুক্তির পূর্বে শান্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর ৩৪৩ জন সদস্য নিহত হয়েছে। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর ১৭৩, বিজিবি ৯৬, পুলিশ ৬৪, আনসার ভিডিপির ১০ জন। নিহত সেনা সদস্যদের মধ্যে অফিসার ৫ জন, জেসিও ৩ জন, বাকিরা সৈনিক।

এছাড়াও দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় সড়ক দুর্ঘটনা, ম্যালেরিয়াসহ বিভিন্ন রোগ, ভূমিধস প্রভৃতি কারণে মারা গেছে আরো অনেকে। এর মধ্যে শান্তিচুক্তির পূর্বে শুধু ম্যালেরিয়ায় নিরাপত্তা বাহিনীর ১৬০ জন এবং পরে ৮১ জন মারা গেছে। উভয় কারণে আহত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিপুল সংখ্যক নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। তবে শান্তিচুক্তির পরে পার্বত্য চট্টগ্রামে নানা কারণে নিরাপত্তা বাহিনীর মোট ১৬ জন সদস্য মারা গেছে। এর মধ্যে শান্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধে মারা গেছে ১১ জন, ৫ জন রাঙামাটির ভূমিধসে। এদের মধ্যে সেনাবাহিনীর ৮ জন, বিজিবি ২ জন,  পুলিশ ২ জন ও আনসার ভিডিপি ৪ জন।

তবে স্থানীয় বাঙ্গালীদের অধিকাংশই আজ নিজ দেশে পরবাসী বলে দাবী করে বাঙ্গালী নেতারা বলেন, ১৯৯৮ সালে উপজাতীদের সাথে শান্তি চুক্তির পর তাদের সব উন্নতি হয়েছে। চাকুরী,জীবনমান, শিক্ষা, ঋণ গ্রহণ ও ভূমি অধিকারসহ সব কিছুর। তারা যেন পাহাড়ের রাজা আর বাঙ্গালীরা প্রজা। তারা পরবাসীও বটে। কেননা নানা কারণে এখানে কৌশলে সবচেয়ে ভূমি দখল করে রয়েছেন– আরো করতে তৎপরতা চালাচ্ছেন উপজাতীয় স্বশস্ত্র সংগঠনগুলো। যারা সরকারের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করলেও সরকারের কাজের কৃতজ্ঞতা স্বীকার তারা করেন না।

বান্দরবান কোর্টের একজন এডভোকেট নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন, আজ স্বাধীনতার ৪৯ বছর পার হচ্ছে। স্বাধীন রাষ্ট্রের সর্বত্র দেওয়ানী আইন-কানুন একই রকম হওয়ার কথা। কিন্ত হয়েছে ভিন্নভাবে। পার্বত্য বিশেষ অ্যাক্টের মারপ্যাঁচে এখানকার ভূমি ব্যবস্থাপনা, বেচাকেনা ও বরাদ্দসহ সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করেন নৃ-গোষ্ঠীর নেতারা। তাদের হাতে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব থাকায় পার্বত্যাঞ্চলে ভূমি জটিলতা নিরসন হয়নি যুগযুগ ধরে।

পার্বত্য  নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল হামিদ বলেন,পার্বত্য এলাকায় জমির সমস্যা সব চেয়ে বড়। পাহাড়ি-পাহাড়ি,পাহাড়ি-বাঙ্গালী বা বাঙ্গালী-বাঙ্গালীদের মধ্যে জমি নিয়ে মামলা মোকদ্দমা দিন দিন বাড়ছে পার্বত্য এলাকায়। বিশেষ করে নৃ-গোষ্ঠীর হাতে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব থাকায় ভূমি জটিলতা শেষ হচ্ছে না। তিনি আরো জানান, তাদের একক কর্তৃত্বের কারণে বাঙ্গালীরা নিজ দেশেই পরবাসী। এখন সময় এসেছে এ বিষয়টি নিয়ে ভাববার-সমাধানের।

উল্লেখ্য ২০১১ সালের আদম শুমারী অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় এককভাবে বাঙ্গালী প্রায় ৪৯ শতাংশ, বাকি সব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মিলে ৫১ শতাংশ। বাঙ্গালীরা সংখ্যার দিক থেকে বেশী হলেও তারা সুবিধাতে পিছিয়ে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: শান্তিচুক্তি, শান্তিচুক্তির বর্ষপূর্তি
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন