আদিবাসী প্রশ্নে সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষিত

kk

তারেক মোরতাজা

‘আদিবাসী’ প্রশ্নে সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে সরকারি লোকজনই এখন ক্ষুদ্রজাতি সত্তাকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার আন্দোলনে নেমে পড়েছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান। তিনি নিজে পাহাড়িদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বাঙালিদের সেখানে ‘বিষকাঁটা’ হিসেবে উল্লেখ করে বক্তৃতা দিয়ে আসছেন। তার মতে, পাহাড়িদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া দরকার।
বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলায় ৪৫টি ক্ষুদ্রজাতি সত্তার মানুষ বসবাস করছেন। সরকার এবং এসব মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নিজেরাও নিজেদের মনে করে থাকেন উপজাতি বা জুম্মু হিসেবে। কিন্তু সমতলে উৎসাহীরা আদিবাসী হিসেবে তাদের স্বীকার করতে চাচ্ছেন। আসলে তারা আদিবাসী নন, এমন কথা সরকারের। এর পক্ষে সরকারের যুক্তি হলো ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বরের শান্তিচুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ আইনসহ নানা কিছু।
পাহাড়িদের একটি বড় অংশ যারা ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট বা ইউপিডিএফ নামে সক্রিয় তারাও আদিবাসী শব্দটি মেনে নিতে নারাজ। এটি কেবল সমতলে এনজিও, বিদেশী সংস্থা এবং জনসংহতি সমিতির কিছু নেতার মুখে শোনা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার নিজেও সরকারের অবস্থান মানেন না। তিনি আদিবাসী হিসেবে পাহাড়িদের অভিহিত করেন। তার যুক্তি হলো উপজাতি শব্দটি অনেকে নিজেদের জন্য সম্মানজনক মনে করেন না তাই এটা বদলে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করতে হবে। এ জন্য তার মন্ত্রণালয় থেকে আইনিপ্রক্রিয়ার কথাও তিনি জানিয়েছেন।
জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা যিনি আবার আদিবাসী ফোরামেরও সভাপতি, তিনিও পাহাড়ি জনগণকে আদিবাসী হিসেবে উল্লেখ করেন। সঞ্জীব দ্রং নামে একজন গবেষক ও অ্যাক্টিভিস্ট নিজেদের আদিবাসী হিসেবে দাবি করেন। তিনি তার বিভিন্ন লেখায় এ বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। তিনি নিজেও একজন আদিবাসী নেতা হিসেবে অন্যদের কাছ থেকে স্বীকৃতি নিচ্ছেন। কিন্তু পাহাড়ে বসবাসরত ইউপিডিএফ নেতা চন্দন চাকমা বলছেন, তারা আদিবাসী ননÑ পাহাড়ি। আদিবাসী শব্দটিতে তাদের ঘোরতর আপত্তি।
ইউপিডিএফের প্রধান প্রসিত খীসা নিজেও পাহাড়ের মানুষকে আদিবাসী বলে স্বীকার করতে চান না। তার মতে, পাহাড়ে বসবাসকারীরা পাহাড়ি, তারা আদিবাসী নয়। জনসংহতি সমিতির বিদ্রোহী গ্রুপের নেতা ও পাহাড়িদের অধিকারের প্রশ্নে কট্টরপন্থী বলে পরিচিত সুধা সিন্ধু খীসাও নিজেদের আদিবাসী নয়, জুম্ম জনগণ বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। অথচ সমতলে কিছু বুদ্ধিজীবী, গণমাধ্যমকর্মী, বিদেশী সংস্থা পাহাড়িদের আদিবাসী বলছেন। এ ক্ষেত্রে তারা রাষ্ট্রের নির্দেশনা মানছেন না।
২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (সমন্বয়-২) মো: মজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়েছে ‘বাংলাদেশে বসবাসকারী বিভিন্ন ভাষাভাষি ৪৫টি ুদ্র ুদ্র যেসব উপজাতি বসবাস করছে তারা বাংলাদেশ সংবিধান, পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ আইন, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন এবং ১৯৯৭ সালের চুক্তিতে উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলোকে ‘উপজাতি’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। তাদেরকে কোথাও আদিবাসী হিসেবে অভিহিত করা হয়নি। তথাপি উপজাতীয় কিছু নেতা, বুদ্ধিজীবী, পাহাড়ে বসবাসরত শিক্ষিত ব্যক্তিরা এমনকি সাংবাদিকেরাও ইদানীং উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলোকে উপজাতি না বলে আদিবাসী হিসেবে অভিহিত করতে দেখা যাচ্ছে।
এ ছাড়া এতদবিষয়ে বিভিন্ন এনজিও প্রতিষ্ঠান, বিদেশী সংবাদমাধ্যম, জাতিসঙ্ঘের আড়ালে থাকা খ্রিষ্টান রাষ্ট্রগুলো এসব ব্যক্তির সহায়তায় তাদের একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সহায়তায় অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।’ ওই চিঠিতে আরো বলা হয়, ‘ইউএনডিপি, ডানিডা, এডিবিসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় কোটি ডলার বিনিয়োগ এবং উপজাতীয়দের ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাদের অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তারা উপজাতীয়দের আদিবাসী হিসেবে প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।’ এতে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় ‘এরূপ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলে উপজাতীয়দের ভবিষ্যতে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া আবশ্যক হয়ে পড়বে।’ এর আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতিসঙ্ঘ শাখা থেকে ১৯ আগস্ট ২০০৮ পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়, ‘ইনডেজিনিয়াস ইস্যুজ’ প্রশ্নে জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে ‘দ্য কান্ট্রি হ্যাজ সাম ট্রাইবাল পপুলেশন্স, অ্যান্ড দেয়ার আর নো ইনডিজিনিয়াস পিপলস’- মানে হলো দেশে কিছু উপজাতি রয়েছেন, তবে তারা আদিবাসী নন। সিনিয়র সহকারী সচিব (জাতিসঙ্ঘ-২) ইকবাল আহমেদ স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে জাতিসঙ্ঘের ৬৩তম অধিবেশনে বিষয়টি আলোচিত হবে এবং বাংলাদেশের ুদ্র জাতিসত্তাকে আদিবাসী চিহ্নিত করা সমীচীন হবে কি না সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে।
জবাবে ৯ সেপ্টেম্বর ২০০৮ পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব কাজী আবুল কালাম এক চিঠিতে জানান, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসরত সকল জনগোষ্ঠী দু’টি প্রধান ভাগে বিভক্ত: যথা- (ক) উপজাতি ও (খ) অ-উপজাতি (বাঙালি)।’ এতে তিনি বলেন, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার কর্তৃক গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক জাতীয় কমিটির সহিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির চুক্তির ক-খণ্ডের ১, খ-খণ্ডের ৮, ১১, ১৪(খ), ২৪ (ক), ৩৪ (গ), গ-খণ্ডের ৩, ৭, ৮(ক), ৯(ঙ), ১৩ ও ঘ-খণ্ডের ১, ২, ৩, ১০, ১১, ১৯ ধারাসমূহে, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮ এর ২(গ), ৫(খ), ৫(২), ৫(৩), ৫(৫), ৭(১),৭(২), ৮(১), ৮(৩), ২৮, ২৯ (১), ধারাসমূহে, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন ১৯৮৯ এর ২(খ), ৪(১) (খ), ৪(৩), ৪(৪), ৫(১), ৫(২), ৬(১), ৬(৩), ১৪, ১৯, ২৫(২), ২(২), ৬২ ও ৬৬ ধারাসমূহে সকল পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসরত অবাঙালিদের উপজাতি হিসেবে উল্লেখ করা আছে।’ এ অবস্থায় ‘দেশে কিছু উপজাতি রয়েছে; কেনো আদিবাসী নয়।’ এমন বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় একমত পোষণ করে।
সৌজন্যে- দৈনিক নয়াদিগন্ত
Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

One Reply to “আদিবাসী প্রশ্নে সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষিত”

  1. আদিবাসী হিসেবে যেসকল বৈশিষ্ট থাকা দরকার তার একটিও উপজাতীদের নেই

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন