parbattanews

আমার বাপ, দাদা চৌদ্দ পুরুষ-কেউ বলেন নাই আমি বাঙ্গালি- মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা

Untitled-110

‘আমরা আমাদেরকে বাংলাদেশি বলে মনে করি এবং বিশ্বাস করি।’

(চার)
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ গণপরিষদে বিতর্কে সংসদ সদস্য পার্বত্য এলাকার উপজাতি জনগণের প্রতিনিধি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা প্রথম রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ‘জাতীয়তা’র ধারণা নিয়ে বাহাস তোলেন। বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে দেশের কোচ-হাজং মনিপুরি-তৈ, মনিপুরি-চাকমা-ত্রিপুরা-রাখাইন-মুন্ডা- লেঙাম-সাঁওতাল-ওঁরাও-ভূমিজ-দেশোয়ালি-কর্মকার-রাজবংশীসহ সব জনগোষ্ঠীর জাতীয়তার পরিচয় রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্ধারিত হয় বাঙ্গালি। এ প্রসঙ্গে ৩১ অক্টোবর ১৯৭২ সালে সংসদ অধিবেশনে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তৎকালীন স্পিকারের মাধ্যমে সাংবিধানিক জাতীয়তা নিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হয়ে তার অবস্থান স্পষ্ট করেন।

“স্পীকার: জনাব আঃ রাজ্জাক ভুঁইয়া আপনার প্রস্তাব পেশ করুন।
জনাব আঃ রাজ্জাক ভুঁইয়া (ইন.ই. ১১৫: ঢাকা-১২): মাননীয় স্পিকার সাহেব, আমি প্রস্তাব করছি যে,
“সংবিধান-বিলের ৬অনুচ্ছেদের পরিবর্তে নিম্নোক্ত অনুচ্ছেদটি সন্নিবেশ করা হোক;
“৬। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে; বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙ্গালি বলিয়া পরিচিত হইবেন।”
জনাব স্পিকার: পরিষদের সম্মুখে জনাব আব্দুর রাজ্জাক ভুঁইয়া প্রস্তাব এনেছেন যে, “সংবিধান-বিলের ৬ নং অনুচ্ছেদের পরিবর্তে নিম্নোক্ত অনুচ্ছেদটি সন্নিবেশ করা হোক;
“৬। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে; বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙ্গালি বলিয়া পরিচিত হইবেন।”
ড. কামাল হোসেন (আইন ও সংসদ বিষয়াবলী ও সংবিধান-প্রণয়ন মন্ত্রী): মাননীয় স্পিকার সাহেব, এই সংশোধনী গ্রহণযোগ্য বলে আমি মনে করি এবং এটা গ্রহণ করা যেতে পারে।
জনাব স্পিকার: শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা।
শ্রীমানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (পি.ই-২৯৯: পার্বত্য চট্টগ্রাম-১): মাননীয় স্পিকার সাহেব, জনাব আব্দুর রাজ্জাক ভুঁইয়া সংশোধনী-প্রস্তাব এনেছেন যে, বাংলাদেশের নাগরিকগণ ‘বাঙ্গালি’ বলে পরিচিত হবেন।
মাননীয় স্পিকার সাহেব,
এ ব্যাপারে আমার বক্তব্য হলো, সংবিধান-বিলে আছে, “বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে”, এর সঙ্গে সুস্পষ্ট করে বাংলাদেশের নাগরিকগণকে ‘বাঙ্গালি’ বলে পরিচিত করবার জন্য জনাব আব্দুর রাজ্জাক ভুঁইয়ার প্রস্তাবে আমার একটু আপত্তি আছে যে, বাংলাদেশের নাগরিকত্বের যে সংজ্ঞা, তাতে করে ভালভাবে বিবেচনা করে তা যথোপযুক্তভাবে গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করি।
আমি যে অঞ্চল থেকে এসেছি, সেই পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরা যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশে বাস করে আসছে। বাংলাদেশের বাংলা ভাষা বাঙ্গালিদের সঙ্গে আমরা লেখাপড়া শিখে আসছি। বাংলাদেশের সঙ্গে আমরা ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশের কোটি কোটি জনগণের সঙ্গে আমরা ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। সব দিয়েই আমরা এক সঙ্গে একযোগে বসবাস করে আসছি। কিন্তু আমি একজন চাকমা। আমার বাপ, দাদা চৌদ্দ পুরুষ-কেউ বলেন নাই, আমি বাঙ্গালি।
আমার সদস্য-সদস্যা ভাই-বোনদের কাছে আমার আবেদন, আমি জানি না, আজ আমাদের এই সংবিধানে আমাদেরকে কেন বাঙ্গালি বলে পরিচিত করতে চায় …….।

জনাব স্পিকার: আপনি কি বাঙ্গালি হতে চান না?

শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা: মাননীয় স্পিকার সাহেব, আমাদিগকে বাঙ্গালি জাতি বলে কখনও বলা হয় নাই। আমরা কোন দিনই নিজেদেরকে বাঙ্গালি বলে মনে করি নাই। আজ যদি এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধানের জন্য এই সংশোধনী পাস হয়ে যায়, তাহলে আমাদের এই চাকমা জাতির অস্তিত্ব লোপ পেয়ে যাবে। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা আমাদেরকে বাংলাদেশি বলে মনে করি এবং বিশ্বাস করি। কিন্তু বাঙ্গালি বলে নয়।

জনাব স্পিকার: আপনি বসুন। Please resume your seat.

শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত: মাননীয় স্পিকার সাহেব, এ ব্যাপারে আমার বক্তব্য হলো, জনাব আব্দুর রাজ্জাক ভুঁইয়া সাহেব যে সংশোধনী এনেছেন, তাতে মনে এ-প্রশ্ন জাগে যে, বাংলাদেশি বাঙ্গালি ছাড়া ভারতের কেউ বাস করছে। আমি শুধু বলতে চাই যে, বাঙ্গালি বলতে এইটুকু বোঝায় যে, যারা বাংলা ভাষা বলে তাদেরকে আমরা বাঙ্গালি বলি।

জনাব স্পিকার: Please resume your seat. আপনি বসুন, আপনি বসুন। এখন পরিষদের সামনে প্রশ্ন হচ্ছে-
“৬ অনুচ্ছেদটির পরিবর্তে নিম্নোক্ত অনুচ্ছেদটি সন্নিবেশ করা হোক:
“৬। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে; বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙ্গালি বলিয়া পরিচিত হইবেন।”
যাঁরা এই প্রস্তাবের পক্ষে আছে, তাঁরা বলুন ‘হ্যাঁ।’
[‘হ্যাঁ’-ভোট গ্রহণের পর-]আর যাঁরা এর বিপক্ষে আছেন, তাঁরা বলুন ‘না।’
[‘না’-ভোট গ্রহণের পর-]আমার মনে হয়, ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হয়েছে অতএব, এই সংশোধনী গৃহীত হলো।

এখন পরিষদের সামনে প্রশ্ন হচ্ছে-
“সংশোধিত আকারে ৬ নম্বর অনুচ্ছেদ সংবিধান-বিলের অংশে পরিণত হোক।” যাঁরা এই প্রস্তাবের পক্ষে আছে, তাঁরা বলুন ‘হ্যাঁ।’
[‘হ্যাঁ’-ভোট গ্রহণের পর-]যাঁরা এই প্রস্তাবের বিপক্ষে, তাঁরা বলুন ‘না।’
[‘না’-ভোট গ্রহণের পর-]‘হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে, ‘হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে, ‘হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে।
অতএব, সংশোধিত আকারে ৬ নম্বর অনুচ্ছেদটি সংবিধান-বিলের অংশে পরিণত হলো।

শ্রীমানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (পি.ই.-২৯৯: পার্বত্য চট্টগ্রাম-১): মাননীয় স্পিকার, আমাদের অধিকার সম্পূর্ণরূপে খর্ব করে এই ৬ নম্বর অনুচ্ছেদ সংশোধিত আকারে গৃহীত হলো। আমি এর প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং প্রতিবাদস্বরূপ আমি অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য পরিষদের বৈঠক বর্জন করছি।
[অতঃপর মাননীয় সংসদ সদস্য পরিষদ-কক্ষ ত্যাগ করে চলে যান]

পরবর্তী পর্ব- ‘শান্তিবাহিনীর আত্মপ্রকাশ’

Exit mobile version