parbattanews

আরসা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কার্যকর প্রচারণার অস্ত্র

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বা তাতমাদাও এবং গেরিলা আরাকান আর্মি (এএ)দের মধ্যে যখন চলছে সশস্ত্র লড়াই। যখন রাখাইন রাজ্যে হচ্ছে বহু বেসামরিক নাগরিক হতাহতসহ হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়া, ঠিক এমতাবস্থায় দৃশ্যপট হল মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কার্যকর আরেকটি সশস্ত্র গ্রুপ এবং প্রচারণার অস্ত্র আরাসা‘র। যারা এখন আবার রাখাইনের মংডুর চারপাশে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে পুনর্গঠিত হচ্ছে।

যারা ২০১৭ সালের আগস্টে কিছুটা গোপনে থেকে মিয়ানমারের সীমান্ত পোস্টে হামলা করেছিল এবং তার জবাবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরু করে যেটা এখন রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। যারা আবারও বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে পুনর্গঠিত হচ্ছে।

বেশ কয়েক মাস ধরে সামরিক দিক থেকে দৃষ্টিসীমার বাইরে রয়েছে আরসা। তাদের পুনরায় আবির্ভাবের কারণে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে যে, তাদের এই পুনর্গঠিত হওয়ার উদ্দেশ্য কি, কিভাবে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী তাদের জবাব দেবে, এবং রাখাইনে এখনও যে সব রোহিঙ্গা রয়ে গেছে, তাদের উপর এর কি প্রভাব পড়বে।

মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর মিডিয়া মুখপাত্র মিয়াওয়াদি ডেইলি ২ মে জানিয়েছে যে, ‘আরসা চরমপন্থী বাঙ্গালি সন্ত্রাসীরা’ মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের ৪১ নং পিলারের কাছে মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) উপর হামলা করেছে। কথিত ওই হামলায় পুলিশের দুজন সেনা আহত হয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৩ এপ্রিল এক বিবৃতিতে বলেছে যে, কয়েক দিন আগে একই এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে বন্দুকযুদ্ধের পর দুজন আরসা সেনার মৃতদেহ সেখানে পাওয়া যায়, এবং সেখান থেকে মাদক, আইইডি এবং এ সম্পর্কিত সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়।

১৫ এপ্রিল, মংডুর খামাউনসিক গ্রামে আরসা এবং বিজিপির মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় এক সেনা নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে।

এছাড়াও ২০১৭ সালের আগস্টের সহিংসতার পর তাতমাদাও-আরসার মধ্যে সবচেয়ে বড় সংঘর্ষে ৩০ মার্চ ১৩ ‘বার্মিজ সন্ত্রাসী সামরিক সেনা’র মধ্যে ১১ জন মারা গেছে’ বলে দাবি করেছে আরসা। লাইং জিরো ওয়া গ্রামে ওই সংঘর্ষ হয়েছে।

৯ এপ্রিল নিরাপত্তা বাহিনী দাবি করে যে, তারা আরসা সন্ত্রাসীদের একটি ‘অস্থায়ী ক্যাম্প’ খুঁজে পেয়েছে। তাদের দাবি অনুযায়ী সশস্ত্র গ্রুপটি প্রতিশোধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

মিয়াওয়াদির রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে যে, ‘গোপন সংবাদের’ ভিত্তিতে দুটো তাবু চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে ৫.৫৬ মিলিমিটারের দশ রাউণ্ড গুলি, একটি ওয়াকি-টকি, দূরবিন, একটি ক্যামোফ্লাজ পোশাক, অন্যান্য কাপড় চোপড়, একটি কোরান, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের একটি আইডি কার্ড – যেটাতে ২৬ বছর বয়সী বেলি আমিন নাম রয়েছে এবং চালের বস্তা উদ্ধার করা হয়।

আরসার কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার সাথে আসলে কোভিড-১৯ সঙ্কটের কোন যোগসূত্র নেই। বরং ২০১৭ সালে কথিত গণহত্যার কারণে মে মাসে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে মিয়ানমার সরকারের যে অগ্রগতি জানানোর কথা রয়েছে, সেটির কারণেই আরসার তৎপরতা বেড়ে গেছে।

আরসার সাথে পশ্চিমা ত্রাণ সংস্থাগুলোর যোগাযোগ রয়েছে বলে তাতমাদাও যেটা অভিযোগ করে থাকে, সেটারও ইঙ্গিত রয়েছে রিপোর্টে। এতে বলা হয়েছে, তাবু থেকে পাওয়া জিনিসের মধ্যে আরও পাওয়া গেছে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রগ্রামের (ডাব্লিউএফপি) হাই এনার্জি বিস্কুট এবং সূর্যমুখী তেল। বিস্কিটে জাপানের পতাকার ছাপ রয়েছে এবং লেখা আছে ‘জাপানের জনগণের পক্ষ থেকে’।

২৩ জানুয়ারি আইসিজে যে নির্দেশ দিয়েছে, সেটা অনুসারে রোহিঙ্গাদেরকে নির্যাতন থেকে রক্ষার জন্য মিয়ানমার সরকার কি পদক্ষেপ নিয়েছে, সেটার অগ্রগতি চার মাসের মধ্যে জানাতে হবে। কৌতুহলের বিষয় হলো আরসাকে নিয়ে সম্প্রতি এমন সময় এ সব রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে, যেগুলোও রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

দ্বিতীয়ত, আরসা একটি কার্যকর প্রচারণার অস্ত্র যেটার মাধ্যমে তাতমাদাওয়ের জন্য আসল হুমকি আরাকান আর্মির দিক থেকে মনোযোগ অন্য দিকে সরিয়ে রাখা যায়। মিয়ানমারে একটা প্রজন্মের মধ্যে আরাকান আর্মি আর তাতমাদাওয়ের যুদ্ধটা সবচেয়ে তীব্র রূপ নিয়েছে এবং হাজার হাজার মানুষ রাখাইন ও চিন রাজ্যে তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছে।

সরকার ২০১৪ সালের সন্ত্রাস দমন আইনের অধীনে ২৩ মার্চ আরাকান আর্মিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করে। আরাকান আর্মি হলো সন্ত্রাসী ঘোষিত দ্বিতীয় সংগঠন। প্রথম সন্ত্রাসী ঘোষণা করা হয়েছিল আরসাকে।

এই ঘোষণা আইনগত দিক থেকে আরাকান আর্মি আর আরসাকে পাশাপাশি ফেলে দিয়েছে, যেটা সরকার এবং সামরিক বাহিনী প্রচারণার সময় কাজে লাগায় এবং দুই সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যে যোগাযোগ রয়েছে বলে দাবি করে তারা। এই অভিযোগ রাখাইনের রাজনৈতিক নেতা এবং আরাকান আর্মিকে চরম ক্ষুব্ধ করেছে, যারা অস্বীকার করে আসছে যে, আরসার সাথে তাদের সামরিক বা রাজনৈতিক কোন যোগাযোগ নেই এবং এই ধরনের সরকারী ভাষ্যের উদ্দেশ্য হলো জাতিগত রাখাইনদের সত্যিকারের প্রতিনিধিত্বকারী সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন হিসেবে আরাকান আর্মির গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা।

আরাকান আর্মির ১০ হাজারের বেশি যোদ্ধা রয়েছে এবং ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে তাতমাদাওয়ের সাথে তাদের কঠিন লড়াই হয়েছে এবং তাতমাদাওকে তারা কঠিন শাস্তি দিয়েছে। সেই তুলনায় আরসা হালকা সশস্ত্র ছোটখাটো দল ছাড়া কিছু নয়।

একসময় সোশাল মিডিয়ায় আরসার যে জোরালো উপস্থিতি ছিল, সেটা বেশ আলোচিত হয়েছিল। ২০১৮ সালের মে মাসে এশিয়া টাইমস এক রিপোর্টে জানিয়েছিল যে, এই গ্রুপের টুইটার একাউন্টটি পশ্চিমা পাঠক পেয়েছে এবং সেখানে তারা নিয়মিত ‘অফিশিয়াল’ বিবৃতি প্রকাশ করতো। কৌতুহলের বিষয় হলো বেশ কয়েক মাস ধরে এই তৎপরতাটা কমে গিয়েছে।

কিন্তু সম্প্রতি আবার যখন গ্রুপটি সক্রিয় হয়েছে, তখন তারা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি রিপোর্টের নিন্দা ও প্রতিবাদ করেছে, যে রিপোর্টে বিস্তারিত বলা হয়েছে যে, কিভাবে হিন্দু বেসামরিক নাগরিকদের হত্যাকাণ্ডের সাথে আরসা সম্পৃক্ত ছিল। তাদের এই প্রতিবাদের মাধ্যমে বিদেশী অধিকার কর্মীদের যুক্তিটাকেই সঙ্গত মনে হয় যে, আরসা মূলত মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সৃষ্টি একটি গ্রুপ, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডকে যুক্তিযুক্ত প্রমাণের জন্য যাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে।

২০১৮ সালের মে মাস থেকে আরসা নিয়মিত বিবৃতি দিয়েছে এবং বিভিন্ন ধর্মীয় দিবসে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। ২০১৯ সালের শুরুর দিক থেকে তারা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টের প্রতিবাদ শুরু করেছে, যেগুলো তাদের পছন্দ হয়নি। এর মধ্যে রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি), সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের বিভিন্ন রিপোর্ট।

২৫ মার্চ আরসা বেশ কিছু ধারাবাহিক অডিও বার্তা প্র কাশ করে, যেখানে রোহিঙ্গাদের প্রতি স্বাস্থ্য সুপারিশ মেনে চলার আহ্বান জানানো হয়। ২০১৯ সালের শুরুর দিকে, এই গ্রুপটি ৬৯ পাতার একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে, যেটার শিরোনাম ছিল ‘রিভাইভিং দ্য কারেজাস হার্টস’। এতে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের অন্যায়ের বিবরণ দেয়ার পাশাপাশি, তাদের সমসাময়িক সঙ্ঘটিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে।

রিপোর্টে আরসা নেতা আত্তাহ উল্লাহর পরিচয় আসলো এমন একটা সময় যখন গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে, তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে এবং আরেক গেরিলা খালিদ তার জায়গায় দায়িত্ব নিতে পারে।

এই খালিদই ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে মংডুতে পুলিশের একটি গাড়িতে হামলা করে সেটাকে নাটকীয়ভাবে ভিডিও করেছিল। ওই হামলায় বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা আহত হয়। এরপর থেকে অজানা কারণে আরসার হামলার ঘটনা অনেক কমে যায়।

নিরাপত্তা হুমকির দৃষ্টিকোণ থেকে আরসা কিছু ছোটখাটো জিহাদী ছাড়া কিছু নয়। তবে, সাম্প্রতিক লড়াইগুলোতে দেখা যাচ্ছে তাদের সীমান্তবর্তী এলাকায় অভিযান চালানোর সামর্থ রয়েছে এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে হতাহত করারও সক্ষমতা রয়েছে। গণহত্যার যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য এবং আরাকান আর্মিকে দোষারোপ করার জন্য আশেপাশে এই অশুভ শক্তির উপস্থিতিটা তাতমাদাওয়ের।

Exit mobile version