আলমগীর নামে এক সৈনিক শান্তিবাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারানোয় এই টিলার নাম আলমগীর টিলা হয়েছে
(২৪)
আমি দশ বছরে চারটি পদাতিক ব্যাটালিয়ান কমান্ড করেছি । ফার্স্ট ব্যটালিয়ান টেকন ওভার ইন দ্য হিল , হ্যান্ডেড ওভার ইন দ্য হিল। সেকেন্ড ব্যাটালিয়ান টেকন ওভার ইন দ্য হিল, হ্যান্ডেড ওভার ইন দ্য প্লেইন। থার্ড ব্যাটালিয়ান টেকন ওভার ইন দ্য প্লেইন, হেন্ডেড ওভার ইন দ্য হিল। ফোর্থ ব্যাটালিয়ান টেকন ওভার ইন দ্য প্লেইন, হ্যান্ডেড ওভার ইন দ্য প্লেইন।
এই থার্ড ব্যাটালিয়ান সিক্স ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে খাগড়ছড়ির দীঘিনালায় এসে গোলন্দাজ ব্রিগেডের অধীনে সন্ত্রাস দমনের দায়িত্বে নিয়োজিত হই। ছয় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সম্ভবতঃ প্রথম পদাতিক ব্যাটালিয়ান পার্বত্য চট্টগ্রামে এন্টি ইনসার্জেন্সি ওয়ারে গোলন্দাজ ব্রিগেডের অধীনে নিয়োজিত হয়েছিল । আমার দায়িত্বে ছিল খাগড়াছড়ি সদর এলাকা। তবে পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণের বিস্তীর্ণ এলাকা ব্যাটালিয়ানের দায়িত্ব পূর্ণ এলাকা হলেও অপারেশনের মেইন ফোকাস ছিল পশ্চিম এবং দক্ষিণে। পূর্বে গোলন্দাজ ব্রিগেডের নিজস্ব ইউনিটসমুহ নিয়োজিত ছিল অপারেশনে। আমার ব্যটালিয়ানের পশ্চিমের সর্বশেষ ক্যাম্প ছিলো জারুলছড়িতে এবং দক্ষিণের শেষ ক্যাম্প ছিল আলমগীর টিলায়।
আমার ব্যটালিয়ানের সাব জোন সদর ছিল জামতলিতে এবং ব্যাটালিয়ান সদর ব্রিগেডের সাথে দীঘিনালায়। আলমগীর টিলা নাম হওয়ার কারণ এখানে এই টিলায় আলমগীর নামে একজন সৈনিক শান্তিবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়। জামতলি থেকে দক্ষিণে তাকালে আলমগীর টিলা দেখা যাবে যেখানে মেঘ এবং পাহাড় একসাথে মিশে গেছে। জামতলি থেকে আলমগীর টিলায় যেতে তিন ঘন্টা সময় লাগে। সমস্ত রাস্তায় ছায়াদার কোন গাছ নাই যার ছায়ায় বসে ক্লান্তি দুর করা যায়। আমি যখনই কোনো পেট্রোল আলমগীর টিলায় পাঠাতাম তখন রুট প্রটেকশন সহ মেডিক্যাল এসিস্ট্যান্ট প্রেরণ করতাম বাড়তি সতর্কতার জন্য।
খাগড়ছড়ির দীঘিনালায় এসে দেখলাম প্রত্যেক আর্মি ক্যাম্পে ব্যাটালিয়ান আনসার বাহিনীর কিছু সৈনিক নিয়োজিত আছে। ক্যাম্প পরিদর্শনে গিয়ে দরবার নিয়ে যা জানতে পারলাম তা হল: আনসারদের অসুবিধা অনেক। তারা রেশন মানি ঠিক মতো পায় না ফলে খাদ্য সমস্যার সৃষ্টি করে। ওদের ছুটি পাওনা থাকার পরেও ছুটি দেওয়া হয় না। আমি নির্দেশ দিলাম রেশন সমস্যা হলে আর্মি রেশন থেকে আনসারদের খাবার ব্যবস্থা যেন করা হয়।
আনসারদের সম্বন্ধে যা জানতে পারলাম তা হলো: এরা খুব নিষ্ঠার সাথে কর্তব্য পালন করে। আর্মির পাশে থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাস দমন অপারেশনে আর্মির সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহযোগী হিসেবে কর্তব্য আনজাম দিয়েছে এই আনসার বাহিনী। শত অসুবিধা সত্যেও আনসারদের সাহসিকতা ও ধৈর্য্যশীলতা আমাকে বিমোহিত করে। আমি একদিন সাব জোনাল হেডকোয়ার্টার জামতলিতে গিয়ে ওখানে স্টেশন্ড আনসার ব্যাটালিয়ান কমান্ডারের সাথে আলোচনা করে ক্যাম্পে কর্তব্যরত আনসারদের অসুবিধা দুর করতে তাকে দৃষ্টি দিতে বললাম।
এর কয়দিন পরে জামতলিতে নিয়োজিত ক্যাপ্টেন শোয়েব মোহাম্মদ তরিকুল্যাহ আমাকে জানালো যে, আনসার ব্যাটালিয়ানের কমান্ডিং অফিসার তাকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে না। ক্যাম্পের ষ্ট্যান্ডিং অপারেটিং প্রসিডিওর ( এস ও পি ) যেমন স্কট ছাড়া একলা সিভিল এলাকায় না যাওয়া, কোথাও গেলে আগাম সাব জোন কমান্ডারকে অবহিত করা, ক্যাম্পের বাইরে নিশিযাপন না করা এমন অনেক আদেশ তিনি মানছেন না।
এমনকি আমি তাঁকে যেসব আদেশ দিয়েছি তারও কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করেননি। পরন্তু তিনি নাকি বলছেন যে, আমি ব্যাটালিয়ান কমান্ডার আপনার সিও ব্যাটালিয়ান কমান্ডার আমরা সমান।
আমি এই সব শুনে আমি আমার অপারেশন অফিসারকে একটি দিন দিয়ে আনসার ব্যাটালিয়ান কমান্ডারকে আমার সাথে চা পানের দাওয়াত দিতে বললাম। যথাসময়ে আনসার ব্যাটালিয়ান কমান্ডার দীঘিনালাতে আমার সাথে চা নাস্তা খেতে এলেন।
চা পানের সময় আনসার ব্যাটালিয়ানের কমান্ডিং অফিসারকে বললাম, আমি প্রত্যেক মাসে একবার আমার ব্যটালিয়ানের সব ক্যাম্প পরিদর্শন করি । এখন থেকে আপনিও আপনার সৈনিকদেরকে প্রতিমাসে একবার করে দেখে আসবেন এবং আমার কাছে প্রতিবেদন দাখিল করবেন সৈনিকদের সুবিধা / অসুবিধা বিষয়ে। আমি আরো বললাম আপনি জামতলিতে ফিরে আপনার একটি ক্যাম্প ভিজিট প্রোগ্রাম আমার কাছে পাঠিয়ে দিবেন যাতে ক্যাম্প ভিজিটের সময় আমি যেন আপনার যাওয়া আসার সময় রুট প্রটেকশন প্রোভাইট করতে পারি। আমার উদ্দেশ্যে ছিল আনসার ব্যাটালিয়ান কমান্ডার ক্যাম্প ভিজিট করলে আনসার সৈনিকদের অনেক সমস্যার সমাধান হবে।
দিনদুই পরে আনসার ব্যাটালিয়ান কমান্ডেরর ক্যাম্প ভিজিট প্রোগ্রাম আমার হাতে এল। তিনি প্রথম ক্যাম্প ভিজিট করতে যেতে চান আলমগীর টিলা ক্যাম্পে। আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না আনসার ব্যাটালিয়ান কমান্ডার ভূল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁর বিশাল বপু নিয়ে আলমগীর টিলা ক্যাম্পে তার প্রথম যাওয়া সুখকর হবে না তা অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারলাম। তাঁর উচিৎ ছিলো প্রথম পরিদর্শন হিসাবে কাছের সহজ পথের কোনো ক্যাম্প সিলেক্ট করা ।
যাইহোক আনসার ব্যাটালিয়ান কমান্ডারের আলমগীর টিলা ক্যাম্পে যাবার দিনে ভোরে রুট প্রটেকশন বসানো হলো। আমি একজন মেডিক্যাল এসিস্ট্যান্টকে পেট্রোলের সাথে দিলাম প্রয়োজনীয় অষুধসহ। অপারেশন অফিসারকে বললাম ওয়্যারলেস সেটে সংবাদ নিয়ে আনসার ব্যাটালিয়ানের কমান্ডিং অফিসারের গমনের বিষয়ে আমাকে অবহিত রাখতে। যাইহোক ঐদিন বেলা তিনটার দিকে তিনি আলমগীর টিলা ক্যাম্পে পৌঁছান। প্রায় তিন/ চার দিন ঐ ক্যাম্পে থেকে পরে তিনি জামতলিতে ফিরে আসেন। এর পরে তাঁর সাথে আমার কথা হয় এবং তিনি স্বীকার করেন যে তাঁর এই আলমগীর টিলা ক্যাম্পে ভিজিট পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাস দমন অপারেশনের ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন সাধন করছে।
এটাই ছিল তাঁর প্রথম কোনো অপারেশন ক্যাম্প ভিজিট। তাঁর এই ভিজিটের পরে আনসার সৈনিকদের সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়ে যায়। আমি এটাই চাচ্ছিলাম যে সে একবার অপারেশন ক্যাম্পে গিয়ে নিজে দেখে আসুক সেখানে কেমন কষ্টের মধ্যে আনসার সৈনিকদের কর্তব্য পালন করতে হয়। এটা ঠিক চামড়ার সোলের জুতা পরে ইটের কুচির উপর দিয়ে হাঁটার মতো মজা কিন্তু জুতার ভিতরে একটা ইটের কুচি ঢুকলে ঠিক তেমনি অসুবিধার সৃষ্টি হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে অপারেশনে না গিয়ে ক্যাম্পে আরাম করে থাকা এক জিনিস আর শত্রুর গুলির সামনে বুক পেতে দিয়ে গ্রীষ্ম বর্ষাকে মাথায় নিয়ে রাত বিরাতে খেয়ে না খেয়ে অপারেশন পরিচালনা করা অন্য বিষয়। দুটো একেবারে আলাদা।
♦ জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান : প্রাক্তন মহাপরিচালক বিডিআর ।