parbattanews

আলীকদমে তামাকে চাষের প্রভাব নদীতে : আইনের বালাই নেই

Alikadam tamak news Pic ev

মমতাজ উদ্দিন আহমদ, আলীকদম (বান্দরবান):
এককালের খরস্রোতা মাতামুহুরী ক্রমশ মৎস্য শূন্য হয়ে পড়ছে। নাব্যতা হ্রাস, তীরবর্তী জমিতে বেপরোয়া তামাক চাষের বিরূপ প্রভাব পড়েছে মাতামুহুরী নদীতে। এখন আর আগের মতো মাছ ধরা পড়ে না জেলের জালে। নদীর তীরে তামাক চাষে অনিয়ন্ত্রিত মাত্রায় ইউরিয়া ও কীটনাশক প্রয়োগের কারণেও প্রতিবছর এ নদীর মাছ নির্বংশ হতে চলেছে।

বাংলাদেশ-আরকান সীমান্তের আলীকদম উপজেলার দক্ষিণ-পূর্ব কোণ থেকে নির্গত খরস্রোতা মাতামুহুরীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল পাহাড়ি উপজেলা লামা ও আলীকদমের সমাজ-সভ্যতা। এককালে এই মাতামুহুরী নদীতে ভেসে চলতো বড় আকারের নৌকা ও সাপ্পান। কিন্তু সে চিত্র আর নেই। নদীর উজানে অব্যাহত বৃক্ষ নিধন, অবাধে পাথর আহরণ ও নদীর তীরে তামাক চাষের কারণে মাটি ক্ষয়ে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। এ নদীর ভূমি ঢাল উত্তর-পশ্চিম মুখি। তাই এ জনপদের সভ্যতা সৃষ্টিকারীনি মাতামুহুরী নদী সর্পিল গতিতে ক্রমশ বয়ে মিশে গেছে বঙ্গোপসাগরে। এ অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকার সাথে এ নদীর রয়েছে গভীর সম্পর্ক। এ নদীর পানি যেমন কৃষকের ফসলে শক্তি যোগায় তেমনি নানা প্রজাতির মাছ ধরে জেলেদের জীবন জীবিকার সহায়ক হতো। এক সময় জেলেরা সকালে মাছ ধরে বিকেলে বাজারে বিক্রি করে পরিবারের অন্ন যোগাতো। এখন সে নদী জেলেশূন্য। সবই যেন এখন স্মৃতি।

নদীর পানি দুষণ:
মৎস্য কর্মকর্তাদের মতে, মাতামুহুরী নদীর দু’তীরে দীর্ঘ দু’দশকের ক্ষতিকর তামাক চাষের বিরূপ প্রভাব পড়ছে মাছের ওপর। তামাক ক্ষেতে অনিয়ন্ত্রিত মাত্রায় ইউরিয়া সার ও নানা ধরণের কীটনাশক ছিটানো হয়। এসব কীটনাশক পানির সাথে মিশে নদীতে পড়ে। এতে নদীর বিভিন্ন প্রজাতির মাছের প্রজনন ক্ষমতা লোপ পাচ্ছে এবং ছোট ছোট মাছগুলি মরে যাচ্ছে।

স্থানীয়দের মতে, তামাক চাষের ক্ষতিকর প্রভাব ছাড়াও মাতামুহুরীতে মৎস্য সম্পদের বিলুপ্তি ঘটছে একশ্রেণীর লোভী মৎস্য শিকারী ও সংশ্লিষ্ট অফিসের দায়িত্বহীনতার কারণে। মৎস্য বিভাগের দায়িত্ব অবহেলার কারণে জেলেরা নদীতে বিষ দিয়ে মাছ আহরণ করে। এতে নদীতে মাছ মরে ভেসে উঠে। বিশেষ করে বিষের কারণে চিংড়ি মাছ মারা পড়ে বেশী। এছাড়াও নদীর যেখানে একটু গভীরতা আছে সেখানেই জেলেরা জঙ্গল কেটে ঘের তৈরি করে। কিছুদিন পর ঘেরের চারপাশে বিষ দিয়ে এক শ্রেণীর পাহাড়ি গাছের ফলের রস ছিটিয়ে মাছ আহরণ করা হয়। প্রকাশ্যে নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল দিয়েও এ নদীতে মাছ শিকার করা হয়। তা দেখেও যেন না দেখার ভান করে মৎস্য বিভাগ। যোগাযোগ করা হলে স্থানীয় মৎস্য কর্মকর্তারা জানান, সুনির্দ্ধিষ্ট অভিযোগ পেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

আইনের প্রয়োগ সময়ের দাবী:
গত ২০০৫ সালে ১৫ মার্চ বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, ‘যেহেতু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৫৩তম সম্মেলনে ধুমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার নিরূৎসাহিত করার জন্য ফার্মওয়ার্ক কনভেনশন অন ট্যোবাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) নামীয় কনভেনশনে ও ১৬ জুন ২০০৩ তারিখে স্বাক্ষর এবং ১০ মে ২০০৪ তারিখে অনুস্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। এ কনভেনশনের বিধানবলী বাংলাদেশে কার্যকর করার লক্ষ্যে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদন, ব্যবহার, ক্রয়-বিক্রয় ও বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হলেও তামাক উৎপাদন নিয়ন্ত্রণে নেই।

সংশ্লিষ্টদের মতে, মানুষের স্বাস্থ্য অপেক্ষা অর্থ কখনই মুখ্য হতে পারে না। তামাক কোম্পানিগুলো শুধু তাদের মুনাফা লাভের আশায় দেশের জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ২০০৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোবাকো কন্ট্রোলকে (এফসিটিসি) অনুসমর্থন করায় বাংলাদেশ এর সুপারিশগুলো মেনে চলার বার্ধবাধকতা রয়েছে। সংশ্লিস্টরা বলছেন, জনস্বাস্থ্যের জন্য আমাদের এফসিটিসি অনুসরণ করতে হবে। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকোর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ধূমপান বা ধূমপান ছাড়াই ৪৩ দশমিক তিন শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক বাংলাদেশি তামাক গ্রহণ করে।
বান্দরবান জেলা মানবাধিকার ইউনিটির বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক মোঃ আবুল কালাম জানান, তামাক সুস্থ পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য ক্ষতিকর চাষ। এ চাষ স্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। তামাক চাষের ফলে মাটির উর্বরা শক্তির বিনাশ হয়। এ উপজেলায় তামাকের আগ্রাসনের ফলে মাতামুহুরী নদীর নাব্যতা হ্রাস এবং বন-জঙ্গলের জীববৈচিত্র হুমকির মধ্যে পড়েছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ও ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, দেশে তামাক সেবনের ফলে প্রায় ৯০ শতাংশ তামাক সেবনের জন্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। তামাক উৎপাদন থেকে সেবন পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে। এতে শরীরে ২২ ধরনের কারসিনুজিন তৈরি হচ্ছে। আর ক্যান্সারের জন্য মানব দেহে একটি কারসিনুজিন তৈরিই যথেষ্ট।

Exit mobile version