আলীকদমে পদ্মা ইসলামী লাইফের অভিনব প্রতারণা!

padma_life_banglanews24_141164552

মমতাজ উদ্দিন আহমদ, আলীকদম (বান্দরবান):
দ্বিগুণ লাভের প্রলোভন দেখিয়ে সরলমনা মানুষের কাছে বিমা পলিসি বিক্রির পর মাসিক কিস্তির (প্রিমিয়াম) টাকা কোম্পানির পলিসি লেজারে না তুলে হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতারণার স্বীকার গ্রাহকরা দিনের পর দিন কোম্পানির শাখা অফিসে ধরণা দিয়েও কোন সুফল পাচ্ছেন না। সম্প্রতি পদ্মা ইসলামী লাইফের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে লিখিতভাবে এমন অভিযোগ করেছেন বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার খুইল্যা মিয়া পাড়ার প্রতারিত গ্রাহকরা।

গত ১২ নভেম্বর করা এই অভিযোগ পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৭ সালে খুইল্যা মিয়া পাড়ার আবু বক্কর মাস্টারের বাড়িতে বসে পদ্মা ইসলামী লাইফের লোক পরিচয়ে চকরিয়া নিবাসী মো. কবির হোসেন ও নুরুল আমিন চেয়ারম্যান কোরআন ও হাদীসের আলোকে নানা ধরনের নসিহত করে পাড়ার লোকজনকে পদ্মা ইসলামী লাইফে বিমা পলিসি কেনার প্রস্তাব দেয়। ওই সময় গ্রাহকদের বলা হয় মাসিক ১০০ টাকার পলিসি খুললে ১০ বছরে সঞ্চয়ের দ্বিগুণ অর্থাৎ ২৪ হাজার টাকা এককালীন দেওয়া হবে।

অভিযোগে প্রকাশ, পদ্মা ইসলামী লাইফ শরীয়া মোতাবেক পরিচালিত হওয়ার বিষয়ে গ্রাহকদের আশ্বস্থ করায় তারা মাসিক ১০০ টাকা প্রিমিয়ামের পলিসি গ্রহণে রাজি হন। ২০০৭ সালের মাঝামাঝি থেকে গ্রাহকরা মাসিক কিস্তিতে পলিসির টাকা জমা দেওয়া শুরু করেন। গ্রাহকরা তাদের কিস্তির টাকা জমা দিতেন আবু বক্কর মাস্টারের কাছে। আবু বক্কর মাস্টার পলিসির টাকা তার ভগ্নিপতি মো. কবির হোসেন’র (কক্সবাজার জোনাল হেড কোয়ার্টারের অধীন চকরিয়া ব্রাঞ্চের কমিশন এজেন্ট) মাধ্যমে কোম্পানিতে জমা দিতেন। চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত গ্রাহকদের পলিসির টাকা জমা নেওয়া হয়।

অভিযোগকারীরা বলেন, চলতি বছরের জুন থেকে হঠাৎ আবু বক্কর মাস্টার গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া বন্ধ করে দেন। এ সময় আবু বক্কর মাস্টারের সঙ্গে গ্রাহকরা যোগাযোগ করলে তিনি জানান, কবির হোসেন টাকা নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে গ্রাহকরা কবির হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি নানা ছলচাতুরীপূর্ণ কথা বলতে থাকে। একপর্যায়ে কবির হোসেন জানান, আবু বক্কর মাস্টার আলীকদম ব্রাঞ্চের ম্যানেজার। পদ্মা ইসলামী লাইফে তার কোড নম্বর- ৭৮২১।

তবে আবু বক্কর মাষ্টার বলেন, তিনি কোন সময়ই পদ্মা ইসলামী লাইফের ম্যানেজার ছিলেন না। পদ্মা লাইফের কর্মকর্তারা রহস্যজনক কারণে তাকে ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার পরিচয় দিচ্ছেন। এ বিষয়ে তিনি পদ্মা লাইফের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে অভিযোগ দিবেন।

পদ্মা ইসলামী লাইফের চেয়ারম্যান এবিএম জাফর উল্লাহ এ অভিযোগের বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘মেয়াদ শেষে গ্রাহকের যে টাকা দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে তা ঠিক আছে। ১০ বছর মেয়াদী ১০০ টাকার এই পলিসিটির বিপরীতে গ্রাহকদের মেয়াদ শেষ ২৪ হাজার টাকাই দেওয়া হয়’।

তবে তাঁর এ কথার সাথে পদ্মা লাইফের জানুয়ারী ২০০৯ সালে মুদ্রিত ‘পরিকল্প পরিচিতি ও প্রিমিয়াম তালিকা’ বইয়ের দেয়া তথ্যের সাথে মিল খুজে পাওয়া যায়নি। এ বইতে ১০০ টাকার দশবছর মেয়াদী বীমা অংক দেখানো হয়েছে ১২,১৮০ টাকা। এই বীমা অংকের সাথে মুদারাবা নীতিতে প্রতি বৎসর মুনাফা যুক্ত হবে’ উল্লেখ করা হয়। সেখানে ২৪ হাজার টাকাই দেওয়া হবে বলে বলা হয়নি।

অপরদিকে, পদ্মা ইসলামী লাইফের রিজিওনাল কো-অর্ডিনেটর জহিরুল ইসলাম হাজরা বলেন, এ বিষয়ে আমরা গ্রাহকদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। পলিসির মেয়াদ ১০ বছর শেষ হওয়ার আগে গ্রাহকদের টাকা দেওয়া হবে না। যারা ১০০ টাকার পলিসিতে মেয়াদ শেষে ২৪ হাজার টাকা দেওয়া হবে বলেছেন তার দায়িত্ব পদ্মা লাইফ নিবে না।

প্রতারিত গ্রাহকরা গত সেপ্টেম্বরে আলীকদম প্রেস ক্লাবের সভাপতির নিকট এ বিষয়ে নালিশ করেন। প্রেস ক্লাব সভাপতির সহায়তায় গ্রাহকরা পদ্মা ইসলামী লাইফের কক্সবাজার জোনাল অফিসের রিজিওনাল কো-অর্ডিনেটর জহিরুল ইসলাম হাজরার সঙ্গে আলীকদম অফিসে ২ দফায় বৈঠক করেন। বৈঠকে চকরিয়া অফিস থেকে আলীকদম ব্রাঞ্চের বিমা গ্রাহকদের পলিসি লেজার ও প্রিমিয়াম রেজিস্টার আনা হয়। এতে দেখা যায় গ্রাহকদের মাসিক সঞ্চয়ের একাধিক মাসিক কিস্তির টাকা লেজারে না তুলে আত্মসাৎ করা হয়েছে। পলিসি রেজিস্টারে কিস্তির টাকা না তুলার বিষয়ে কোন সদুত্তর দিতে পারেননি উপস্থিত কর্মকর্তারা।

অভিযোগপত্রে স্বাক্ষরকারী ফোরকান আরা বেগম (পলিসি নম্বর-১৪১১০০৩৯৪০-২) জানান, ‘আমরা গ্রামের সহজ-সরল ধর্মপ্রাণ মানুষ। পদ্মা লাইফের কর্মকর্তারা কোরআন ও হাদীস দিয়ে নসিহত করে পলিসি খুলতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করেন। আমরা তাদের কথা বিশ্বাস করে ২০০৭ সালে পদ্মা ইসলামী লাইফের বিমা পলিসি ক্রয় করি। আমরা বিমা পলিসি ক্রেতারা সবাই গরীব মানুষ। প্রতিমাসে ১০০ টাকা করে ৮ বছর ধরে নিয়মিত কিস্তির টাকা পরিশোধ করি। কিন্তু গত জুন থেকে আমাদের টাকা নেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের জমা দেওয়া অর্থ আত্মসাত করা হয়েছে। জমা করা টাকা ফেরত চাইলে তা ফেরত না দিয়ে নানা রকম কথাবার্তা বলছে কোম্পানীর লোকজন’।

অভিযোগপত্রে স্বাক্ষরকারী কাশমিন নাহার (পলিসি নং- ১৪১১০০১২০০-৩) বলেন, পদ্মা ইসলামী লাইফের চকরিয়া জোনের ইনচার্জ জহির আমাদের সাথে দু’দফা বৈঠক করেও কোন সমাধা দিতে পারেননি। পলিসির টাকা লেজারে না উঠানোর বিষয়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

পদ্মা ইসলামী লাইফের ব্যবস্থপনা পরিচালকের কাছে করা এ অভিযোগের অনুলিপি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের(আইডিআরএ) চেয়ারম্যান, বান্দরবান জেলা প্রশাসক, আলীকদম উপজেলার নির্বাহী অফিসার ও আলীকদম প্রেসক্লাবের সভাপতিকে দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে পদ্মা লাইফের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (উন্নয়ন), মিজানুর রহমান বলেন, ‘গ্রাহক ১২ হাজার টাকায় দশবছরে ২৪ হাজার টাকা পাবেন, যখন কোম্পানীর অবস্থা ভাল থাকে। যদি প্রতি বছর বছর কোম্পানী বোনাস দিয়ে দেয়। ২৪ হাজার টাকা কেন এরও বেশী বোনাস আসতে পারে। যদি বোনাস প্রতি বছর বছর দিতে না পারে তবে ১২ হাজারের নীচে নামবে না।  তিনি বলেন, গ্রাহকদের যে কোন অভিযোগ আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন