আলীকদমে ‘বিয়েপাগল’ কৃষি কর্মকর্তা নিজদপ্তরে স্ত্রীর হাতে লাঞ্চিত

Ali Ahamed, Krishi Officer_Alikadam

মমতাজ উদ্দিন আহমদ, আলীকদম (বান্দরবান):
     সকলেই বিস্ময়ে হতবাক। কিংকর্তব্যবিমুঢ়। কেউ ভাবতেই পারেনি এমনটি ঘটবে। অফিসকক্ষে হঠাৎ রুদ্রমূর্তিধারী বোরকা পরিহিতা এক মধ্যবয়স্ক নারীর প্রবেশ। অশ্রাব্য ভাষায় গালমন্দ ‘….তুই আমাকে রেহাই দিবি কিনা বল’। প্রতিউত্তর পাওয়ার আগেই শার্টের কলার চেপে হেঁচকা টান। টানের চোটে বেচারা কর্মকর্তার করুণদশা! ছিড়ে গেলো পরিহিত শার্টের বোতাম। সটকে পড়লেন সরকারী চেয়ারটি থেকেও! এ ঘটনাটি ঘটেছে বান্দরবানের আলীকদম উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়ে গত মঙ্গলবার বেলা সাড়ে এগারটার দিকে। এ প্রতিবেদক তখন সেখানে উপস্থিত।    

জানা গেছে, আলীকদম উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আলী আহমেদ প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া এ পর্যন্ত বিয়ে করেছেন আরো তিনটি। সর্বশেষ চতুর্থ স্ত্রীকে বিয়ে করার একবছর না পেরেতোই দিয়েছেন ‘তালাক’। আবার রীতিমত ঘরসংসারও করেছেন। বিবাহিতা স্ত্রীদের তালাক ও মোহরনা খরচ মেটানোর নামে প্রথম স্ত্রী থেকে নিয়েছেন কয়েক লাখ টাকা। কিন্তু প্রথম স্ত্রীর সাথে গুণধর এই সরকারী কর্মকর্তার প্রতারণার শেষ নেই। তাই শেষমেষ প্রথম স্ত্রীর হাতেই লাঞ্চিত হলেন গত মঙ্গলবার নিজের সরকারী কর্মস্থলেই।

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়ে কর্মরত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাগণ এবং অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অভিযোগ করেন, কৃষি কর্মকর্তার অনৈতিক কর্মকাণ্ডে তারা বিব্রত। সম্প্রতি তার দু’স্ত্রীর ঝগড়া বিবাদে তাদের দাপ্তরিক কাজও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আলী আহমেদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা জেলার বরুড়া উপজেলার জাঙ্গালিয়া গ্রামে। তার পিতার নাম মো. তমিজ উদ্দিন। ১৯৮৩ সালের ২৮ মার্চ বিয়ে করেন একই জেলার দাউদকান্দি উপজেলার ফজলুর রহমানের মেয়ে করিমুন্নেছাকে। তাদের সংসারে ২ ছেলে মেয়ে রয়েছে। ছেলে জাপানপ্রবাসী। সম্প্রতি মেয়ের বিয়ে হয়েছে।

করিমুন্নেছা জানান, অনুমতি ছাড়া তার স্বামী কৃষিবিদ আলী আহেমদ ২০০০ সালে ২য় বিয়ে করেন কুমিল্লার বরুয়া উপজেলার ষোড়শী এক মেয়েকে। কিছুদিন পর তাকে ৭০ হাজার টাকা মূল্যের একখন্ড জমি দিয়ে বিদায় করেন। এরপর ২০০৭ সালে ৩য় বিয়ে করেন একই জেলার অষ্টাদশী আরেক মেয়েকে। তাকেও ১ লক্ষ ৩০ হাজার টাকায় বিদায় করেন। কিন্তু ৩য় স্ত্রী বিদায়কালে ৪ মাস বয়সী শিশুকন্যাকে রেখে যান কৃষি কর্মকর্তার কাছে। বর্তমানে শিশুকন্যাটি তিনি (প্রথম স্ত্রী) প্রতিপালন করছেন।
    করিমুন্নেছা অভিযোগ করেন, ২০১২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর তার স্বামী আলী আহমেদ আলীকদম উপজেলায় চাকুরীসূত্রে বদলী হন। বর্তমান কর্মস্থলে যোগদানের ৩ মাস ১৭ দিনের মাথায় আবারো বিয়ে করেন স্থানীয় সোলেমানের বিধাবা মেয়ে তিন সন্তানের জননী মরিয়ম বেগম (৩৫)কে। এরপর থেকে শুরু হয় বিয়েপাগাল এ কর্মকর্তার নতুন দাম্পত্য কলহ!
    চতুর্থ স্ত্রী মরিয়ম বেগম জানান, গত একবছর পূর্বে তার ছবি ও কিছু কাগজপত্র ‘সত্যায়িত’ করার জন্য উপজেলা কৃষি অফিসে যান। সেখানে কৃষি কর্মকর্তা আলী আহমেদের নজরে পড়েন তিনি। প্রথমে কৃষি কর্মকর্তার তার অফিসের রেজাউলের মাধ্যমে পরে স্বয়ং কৃষি কর্মকর্তা তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। শেষমেষ ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর তারা বিয়ের পিঁড়িতে বসেন।
    বান্দরবান পৌরসভার নিকাহ্ রেজিস্টার এর বালাম নং- ১০/১০-১৩, পৃষ্ঠা- ২৩/১২ মূলে ১১২/১২ ক্রমিকে তাঁদের বিয়েটি মুসলিম বিবাহ আইনে রেজিস্ট্রী হয়। নিকাহ্নামা রেজিস্ট্রারের ২১ ক্রমিকে তার কোন স্ত্রী নেই বলে কাজীর কাছে স্বীকার করেন। নিকাহ্নামায় বরের বয়স ৪৯ কনের বয়স ৩৪ লেখা হয়।
    এদিকে, ৪র্থ স্ত্রীকে বিয়ের ১০ মাস তিন দিনের মাথায় ‘তালাক’ দেন কৃষিবিদ আলী আহমেদ! গাজিপুর সিটি কর্পোরেশনের টঙ্গীবাজার ৫৭নং ওয়ার্ডে দায়িত্বরত কাজির মাধ্যমে ২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর ‘তালাকে আহসান’ দেন। তালাকের কারণ হিসেবে ‘বনিবনা না হওয়া, অবাধ্য হওয়া এবং শরীয়তের পরিপন্থি হওয়া’ উল্লেখ করেন। 

চতুর্থ স্ত্রী মরিয়ম বেগম অভিযোগ করেন, তালাক প্রদানের পর গত ২২ জানুয়ারী তাকে নিয়ে চকরিয়ার একটি হোটেলে গিয়ে কৃষি কর্মকর্তা আলী আহমেদ রাতযাপন করেন। এছাড়াও একাধিকবার তার বাড়ি ও আত্মীয়ের বাড়িতে কৃষি কর্মকর্তা যান। বর্তমানে তিনি আড়াই মাসের অন্তসত্ত্বা। কিন্তু গর্ভস্থ সন্তানের স্বীকৃতি দিতে চাচ্ছেন না এই কৃষি কর্মকর্তা। ইসলাম ধর্মের প্রসিদ্ধ ফতোয়াগ্রন্থ ফাতহুল কাদীর, আলমগীরী, শামী, আইনী ও বাহরুর রায়েক-এ বলা হয়েছে, ‘মাসিক থেকে পবিত্র হবার পর দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন না করে স্ত্রীকে এক তালাক দেয়াকে “তালাকে আহসান বা সর্বোত্তম তালাক বলে”। এটি ‘রিজয়ী তালাক’ হিসেবেও পরিগণিত। স্ত্রীর ইদ্দত শেষ হওয়ার আগে স্বামী যদি দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে স্ত্রীর সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক বলবৎ রাখতে পারবেন। এজন্য কিছু করতে হবে না, শুধু সিদ্ধান্তই যথেষ্ট। যদি ইদ্দত শেষ হওয়ার পর স্বামী সেই স্ত্রীর সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক রাখতে চায় তাহলে কেবল নতুন করে (দেনমহর নির্দিষ্টসহ) বিয়ে করে নিতে হবে’। কিন্তু ‘তালাকে আহসানের’ পর ২ মাস ২৮ দিনের মাথায় এই কৃষি কর্মকর্তা শরীয়ামতে বিয়েতে না বসে গত ২২ জানুয়ারী চতুর্থ স্ত্রী মরিয়মের সাথে চকরিয়ার একটি হোটেল রাতযাপন করেন। এছাড়াও বাসায় ও আত্মীয়ের বাড়িতে রাতযাপন করেন বলে অভিযোগ মরিয়ম বেগমের।

কৃষি কর্মকর্তা আলী আহমেদ জানান, বড় স্ত্রীকে ঢাকার উত্তরায় সোয়া কোটি টাকা মূল্যের বাড়ির কিনে দিয়েছি। ছেলে মেয়েদের সাধ্যমত মানুষ করেছি! নীতিবাগীশ এই কর্মকর্তার অভিযোগ চতুর্থ স্ত্রী তার কথামত সংসার করছেন না। এতেই বিপত্তি বাঁধছে। তবে এই সোয়া কোটি টাকা তিনি কিভাবে আয় করলেন তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।  

বান্দরবান জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক আবুল কালাম বলেন, ‘বিষয়টি আমি তদন্ত করে অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো’। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোতাক্বাব্বীর আহমেদ বলেন, ইতোমধ্যে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনের নানা অভিযোগ সম্পর্কে অভিহিত হয়েছি। বিষয়টি নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন